শ্রাবণ মাসেই কেন প্রিয় মানুষগুলো চলে যায়?

চবি'র শাটল ট্রেনে ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে গান-গল্পে মেতে শহরে যেতেন রাজীব মীর।

শ্রাবণ মাসেই কেন প্রিয় মানুষগুলো চলে যায়?

ঊর্মিলা শ্রাবন্তি কর

শ্রাবণ মাস টি আমার খুব প্রিয়। কারণ বৃষ্টি আমার খুব প্রিয়। শ্রাবণে জন্ম হয়েছিল বলেই বাবা নাম রেখেছিলেন শ্রাবন্তী। কিন্তু এই শ্রাবণ মাসেই কেন আমার প্রিয় মানুষগুলো চলে যায় যারা অনেক জ্ঞানী - গুনী , যারা প্রতিভাবান, যারা সৃষ্টিশীল, যারা জীবন - রসিক।

হুমায়ুন স্যার চলে গেছেন এই শ্রাবণ মাসে। প্রিয় নাট্যকার ফারুক ভাই চলে গেলেন এই জুলাই মাসে। আর রাজীব মীর স্যার, আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সবচেয়ে প্রিয় শিক্ষক , যিনি আমাকে শিখিয়েছেন কিভাবে জীবনকে উপভোগ করতে হয় , চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে এই শ্রাবণ মাসেই, অত্যন্ত অল্প বয়সে।

রাজীব মীর স্যার আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন না।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ছিলেন তিনি। পহেলা বৈশাখের এক অনুষ্ঠানে উনার সাথে আমার পরিচয় হয়। অসম্ভব দিলখোলা স্বভাবের মানুষ ছিলেন তিনি। অসাধারণ ছিল উনার গানের গলা। শিক্ষক হয়ে - ও তিনি ছিলেন বন্ধুর মত। প্রথমে তিনি ছিলেন ষোল শহরে , তারপর ফায়েজ লেকে বাসা নিয়েছিলেন। ওনার বাসায় কত গিয়েছি। কত আড্ডা , কত স্মৃতি।

news24bd.tv

চবি'র শাটল ট্রেনে রাজীব মীরের সঙ্গে ঊর্মিলা শ্রাবন্তি কর

স্যার উনার জীবনের অনেক স্মৃতি শেয়ার করেছেন আমার সাথে। অসম্ভব জ্ঞানী মানুষ স্যার। উনার সাথে সেইসব আলোচনায় অংশগ্রহণ করে আমি সমৃদ্ধ হয়েছি। আইন বিভাগের ছাত্রী হয়ে - ও আমি সাংবাদিকতা বিভাগের ম্যাগাজিনের Proof Reading এর কাজ করেছি শুধু স্যারের সাথে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে। এমন - ও হয়েছে আমরা সকালে এক সাথে নাস্তা করেছি , স্যারের জন্য সকালের নাস্তা তৈরী করেছি , রান্না করেছি। শুক্রবার সকাল থেকেই টানা আড্ডা । একের পর এক গান। কখনো স্যার গাইতেন। কখনো আমি। আমার গান শুনে তিনি আমাকে আশীর্বাদ করেছিলেন , "তোমার অনেক বড় শত্রু - ও কখনো তোমার গানের বদনাম করতে পারবে না। "news24bd.tv

স্যার টাকা - পয়সার বিষয়ে ছিলেন উদাসীন। হাতখোলা মানুষ , কেউ টাকা চাইলে টাকা দিয়ে দিতেন। মাসের পনেরো দিনের মধ্যেই উনার বেতনের সব টাকা শেষ। আমাদের কাছে আফসোস করে বলতেন, " মাসে দুইবার বেতন হওয়া উচিৎ। এক তারিখে একবার ও পনেরো তারিখে আরেকবার। "

অত্যন্ত জ্ঞানী এই শিক্ষক কে খুব অপ্রীতিকর অবস্থায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করতে হয়েছিল। স্যার দু:খ করে বলেছিলেন , " হুমায়ুন আজাদ স্যার সহ অনেক খ্যাতিমান শিক্ষক - ই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে পারেননি। " স্যার যেদিন রাতের ট্রেনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন , সেদিন রেল স্টেশন ভরে গিয়েছিল উনার প্রিয় ছাত্র - ছাত্রীদের উপস্থিতিতে। স্থানীয় এম. পি. বা মন্ত্রী রেল স্টেশনে এলে এরকম দৃশ্য তৈরী হয়। সব ছাত্র - ছাত্রীরা একসাথে কাদছিলো। রেল - স্টেশনে উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে দেখছিল সেই নি:স্বার্থ ভালবাসার কান্না। যখন ট্রেনটি চট্টগ্রামের রেল স্টেশন ত্যাগ করে চলে যাচ্ছিল , স্যারের প্রিয় ছাত্ররা তখন - ও ট্রেনের পিছনে পিছনে দৌড়াচ্ছিল।

ঢাকায় এসে - ও স্যার নিয়মিত আমার খোজ - খবর নিতেন। উনি ঢাকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছিলেন। আমার শুটিং এ স্যার মাঝে মাঝে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র - ছাত্রীদের নিয়ে চলে আসতেন।

আমার সাথে শেষ যেদিন স্যারের আলাপ হল - স্যার বলেছিলেন , " তুমি তো কখনো বইমেলায় গিয়ে আমার বই কেনো না। এবার বইমেলায় গিয়ে আমার বই সংগ্রহ কোরো। " অত্যন্ত কষ্ট পাচ্ছি আজ। কারণ বইমেলায় গিয়ে স্যারের বই কেনা হয়নি এবারো। আর কখনো বইমেলায় যেয়ে স্যারের বই কেনার সুযোগ - ও আর পাব না।

রাজীব মীর স্যার অনেক উদার মনের মানুষ ছিলেন। আমাদের দুর্ভাগ্য , আমরা উনাকে ঠিকমত বুঝতে পারি নি। অনেকেই উনাকে ভুল বুঝেছে। অন্যায়ভাবে মিথ্যা অভিযোগে উনাকে অভিযুক্ত করেছে। স্যার, আমি আপনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। একজন জ্ঞানী শিক্ষক হিসেবে আপনার প্রকৃত মূল্যায়ন আমরা করতে পারিনি। আপনি আমাদের ক্ষমা করে দিয়েন।

স্যার আজ নেই। আমার চারদিকে শুধু নির্মম শুন্যতা। অন্তত আমার জন্য এই শুন্যতা কখনো দূর হবে না। (লেখকের ফেসবুক থেকে)

লেখক: মডেল, অভিনেত্রী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী