শামসুর রাহমান: সমপ্রাণ নিয়ে চিরসখা-কবি

কবি শামসুর রাহমান।

শামসুর রাহমান: সমপ্রাণ নিয়ে চিরসখা-কবি

নিউজ টোয়েন্টিফোর ডেস্ক

গোলাম কিবরিয়া পিনু
কবি শামসুর রাহমানের নৈকট্য অনুভব করি সেই কবে থেকে, তা নির্দিষ্ট তারিখের আওতায় ফেলে বলা যাবে না। তবে সেই কিশোরবেলায় যখন কবিতার প্রতি অনুরক্ত হতে থাকি, তখন থেকেই শামসুর রাহমানের কবিতার সঙ্গে বন্ধনমৈত্রী গড়ে ওঠে। সেই বন্ধনমৈত্রীতে তাকে ভাবতে শুরু করি, তিনি আমার চিরসখা-কবি। এক বয়সী না হলেও মনে হয়, তিনি সমপ্রাণ নিয়ে এক কাছের মানুষ।

ব্যক্তিগত বা মুখোমুখি যোগাযোগ হাতে গোনা কয়েকবার হয়েছে মাত্র। কিন্তু হরিহর-আত্মা নিয়ে মনে হয়, তিনি আমারও স্বজন, আমারও চির পরিচিত পরিজন। তার কবিতাই প্রধানত এ ধরনের অনুরাগ মিশ্রিত সম্পর্কের ভিত্তিমূল তৈরি করে দিয়েছে।

শামসুর রাহমান এমন এক কবি-যার কবিতা প্রায় ৪৫ বছরের অধিককাল ধরে গভীরভাবে পড়ে আসছি পাঠক হিসেবে।

ধারাবাহিকভাবে এত দীর্ঘদিন ধরে এ দেশের খুব কম কবি আমার পাঠস্পৃহা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। তার প্রকাশিত প্রায় সব কবিতার ওপরই চোখ পড়েছে। তার কবিতা চোখের সামনে পড়েছে অথচ পড়িনি--এমনটি হয়নি। তবে সব কবিতাই যে ভালো লেগেছে সমানভাবে, তা নয়। কোনো কবিতা বেশ টেনেছে, কোনো কবিতা কম টেনেছে তুলনামূলকভাবে। স্বীকার করি, তার কবিতায় এক ধরনের সহজাত আকর্ষণ রয়েছে। সে আকর্ষণ থেকে দূরে থাকা সম্ভব হয়নি। এ কি শুধু মুগ্ধতা, আসক্তি ও পাঠক হিসেবে পক্ষপাতমূলক হৃদয়গ্রন্থি উন্মোচনের প্রেষণা? সাহস, রুচি, দৃষ্টিভঙ্গি, আধুনিক জীবনবোধ ও স্বদেশ নিয়ে স্বপ্ন নির্মাণে এবং ব্যক্তিগত বহুবিধ পর্যায়ের অনুভব ছুঁয়ে ছুঁয়ে জীবন উপলব্ধি করার জন্য তিনি তার কবিতাকে শিল্পশক্তিতে সংহত করেছেন। তা ক'জন কবি পারেন? তাই কবি হিসেবে শামসুর রাহমান আমার প্রিয় কবি।

কবি-প্রতিকৃতি হিসেবে শামসুর রাহমানকে পেয়েছি পাঠক হিসেবে আমার জীবনকালে অনেক ঘটনা, তুলনামূলক কাব্য-বিবেচনা এবং বিভিন্ন ভূমিকার মধ্যে দিয়ে। এর মিথস্ক্রিয়ায় নির্মিত হয়েছে তার সম্পর্কে সমকালীন এক ধরনের সমীক্ষা। ব্যক্তিগত এই সমীক্ষা সূক্ষ্মভাবে হলেও পাঠক হিসেবে কোনো কবির কবিতা গ্রহণ বা বর্জন করার অধিকার প্রদান করে সমকালে। পরে হয়তো এই সমীক্ষা ভিন্ন বিবেচনায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। পাঠক হিসেবে নিজস্ব বোধ-আকাঙ্ক্ষা, রুচি, অন্যান্য বহু বিবেচনা ও পরীক্ষণ হয়তো তখন অপরিহার্য হয়ে দেখা দেবে কবির মূল্যায়নে।

আশ্চর্য হতে হয় তার অদম্য সৃজনশীল কর্মকাণ্ডর বিন্যাস দেখে। তিনি  সেই ধরনের কবি-যিনি সুশৃঙ্খলভাবে কবিতা নির্মাণে জীবনকে যতটা সম্ভব বিনিয়োগ করেছেন। এক্ষেত্রে সফলও হয়েছেন। তার ওই সৃজনমুখর আত্মশক্তি যে কোনো পাঠক, কবি ও মানুষের কাছে এক অনুপ্রেরণামূলক দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তার দর্শন বা কাব্যবিশ্বাসকে বারবার বদলিয়ে তিনি চোরাস্রোতে ছেড়ে দেননি। দৃঢ়তার সঙ্গে সেই দর্শন বা কাব্যবিশ্বাসকে তিনি সংরক্ষিত রেখেছেন। ফলে বাংলা কবিতা, বিশেষত বাংলাদেশের কবিতায় যে মধ্যযুগীয় সংকীর্ণ দর্শন বা কাব্যবিশ্বাস বেশ প্রভাববলয় তৈরি করে ফেলেছিল, তা অনেকটা তিনি এককভাবে প্রতিরোধ করেছেন।

এই ভূমিকা বাংলা কবিতা, বিশেষত বাংলাদেশের কবিতাকে মুক্ত-স্বাধীন ও আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিনির্ভর জীবনমুখী পথে এগিয়ে যাওয়ার স্পর্ধা আরও সম্ভাবনাময় করে তুলেছে।

শামসুর রাহমান নিজস্ব বোধ থেকে উৎসারিত বিবেচনায় এ দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনা বা উল্লেখযোগ্য অভিঘাতকে কবিতায় প্রাণ দিয়েছেন। সেই বোধ জনগণের প্রগতিমুখী চেতনাকে সমৃদ্ধ করেছে। তার যে স্বদেশানুভূতি তা এই ভূখণ্ডের কাঙ্ক্ষিত সংস্কৃতিমানকে সংরক্ষণ ও পরিব্যাপ্ত করেছে। কবি হিসেবে তিনি আমার প্রিয় প্রতিকৃতিও। তার ব্যক্তিত্বেরই প্রতিরূপ হিসেবে যেন তার কবিতা উন্মুখ। মনে হয়, তার কবিতা ও ব্যক্তিত্ব অবিচ্ছিন্নতা নিয়ে একই যোগসূত্রে উদ্ভাসিত। তাই তার কবিতা এবং তিনি হয়ে ওঠেন গ্রাহ্য অনেক ক্ষেত্রে, ব্যবধান সৃষ্টি হয় কমই। বাংলা কবিতাকে তিনি বিশেষ মর্যাদায় শুধু অধিষ্ঠিত করেননি, ভাব ও শৈলীকে নিজের মতো করে কবিতায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তা অনন্য সৃষ্টি হিসেবে পাঠকের মস্তিষ্কে অনুরণিত হবে বহুদিন। শামসুর রাহমান সম্পর্কে কিছু বিচ্ছিন্ন ভূভাগ টেনে নিয়ে শুধু আমার ব্যক্তিগত অনুভূতি প্রকাশ করলাম।

লেখক: কবি, প্রবন্ধকার ও ছড়াকার।

(নিউজ টোয়েন্টিফোর/তৌহিদ)

সম্পর্কিত খবর