ছাত্রীকে গণধর্ষণ: ৫ লাখ টাকায় সমঝোতা!

প্রতীকী ছবি

ছাত্রীকে গণধর্ষণ: ৫ লাখ টাকায় সমঝোতা!

সুমন বর্মণ • নরসিংদী

নরসিংদী সদর মডেল থানা পুলিশের বিরুদ্ধে ৪র্থ শ্রেণীর এক ছাত্রীকে গণধর্ষণের চাঞ্চল্যকর ঘটনায় ৫ লাখ টাকায় রফা-দফা করার অভিযোগ উঠেছে। পিতৃহারা প্রবাসী মায়ের এতিম মেয়েটি পুলিশ ও প্রভাবশালীদের চাপে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। তাদের  ভয়ে তটস্থ পুরো পরিবার। পুলিশের সহায়তায় ধর্ষণের ঘটনা ধামা চাপা দেয়ার খবর গ্রামে ছড়িয়ে পড়লে চরাঞ্চলজুড়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে।

গেল রোববার (২ সেপ্টেম্বর) মেঘনা নদীর দড়ি নবীপুর নামক স্থানে ওই স্কুল ছাত্রীকে গণধর্ষণের পর নদীতে ফেলে দেয় ধর্ষকরা। পরে সাঁতরিয়ে গভীর রাতে বিবস্ত্র অবস্থায় বাড়ি ফেরে সে।  

নির্যাতিত মেয়েটির বাড়ি সদর উপজেলার নজরপুর ইউনিয়নের চম্পকনগর গ্রামে। সে স্থানীয় আলিয়া মাদ্রাসার ৪র্থ শ্রেণীর ছাত্রী।

সরেজমিনে চম্পকনগর গিয়ে নির্যাতিত ছাত্রীর পরিবার ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাবা মৃত্যুর পর স্কুল ছাত্রী চম্পকনগরে মামার বাড়িতে থেকে পড়াশুনা করতো। গেল রোববার সন্ধ্যায় সে পাশ্ববর্তী কালাই গোবিন্দপুর বাজারে কসমেটিক্স কিনতে যায়।  

সেখান থেকে বাড়ি ফেরার পথে কালাই গোবিন্দপুর নওয়াব আলী স্কুলের পাশ থেকে একই গ্রামের সাদ্দাম মিয়া (২৫), সজিব (২২) ও ফরহাদ (২৩) স্কুল ছাত্রীকে অপহরণ করে নৌকায় করে মেঘনা নদীর মাঝ খানে নিয়ে যায়। সেখানে নৌকায় তারা পালাক্রমে ওই মেয়েটিকে ধর্ষণ করে।  

ধর্ষণের পর অভিযুক্তরা স্কুল ছাত্রীকে বিবস্ত্র অবস্থায় নদীতে ফেলে দেয়। পরে কালাই গোবিন্দ্রপুরের ইমানের বাড়িতে গিয়ে মেয়েটি আশ্রয় নেয়। খবর পেয়ে স্থানীয় ইউপি সদস্য মোস্তফা ও বাড়ির স্বজনরা গিয়ে মেয়েটিকে উদ্ধার করে।

এদিকে, ধর্ষকরা স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে উঠেপড়ে লাগে স্থানীয় ইউপি সদস্য মোস্তফা। তিনি সাবেক ইউপি সদস্য কামাল মেম্বার, আলি নূর ও ফজলুকে নিয়ে নির্যাতিত মেয়েটির পরিবার ও ধর্ষকদের মধ্যে সালিশের মাধ্যমে ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ার উদ্যোগ নেন। এরই প্রেক্ষিতে আয়োজিত গ্রাম্য সালিশে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের ঘটনা প্রমাণিত হওয়ায় প্রত্যেককে দেড় লাখ টাকা করে মোট সাড়ে ৪ লাখ টাকা জরিমানা ধার্য করেন। একই সঙ্গে এই ঘটনায় কোন মামলা না করার জন্য নির্যাতিত স্কুল ছাত্রীর পরিবারকে নির্দেশ দেয়া হয়।

কিন্তু কথামতো জরিমানার টাকা না দেয়ায় গতকাল (৫ সেপ্টেম্বর) সকালে নরসিংদী সদর থানা পুলিশের দ্বারস্থ হয় নির্যাতিত স্কুল ছাত্রীর পরিবার। কিন্তু বিধিবাম সদর থানা পুলিশও। তারাও অভিযোগকে মামলা হিসেবে নথিভুক্ত না করে উল্টো ৫ লাখ টাকায় ঘটনাটি সমঝোতা করে দেন।

গণধর্ষণের মতো চাঞ্চল্যকর ঘটনা পুলিশের হস্তক্ষেপে ধামাচাপা দেয়ার খবরে এলাকায় বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। কিন্তু ঘটনা সমঝোতা হওয়ায় পুলিশ ও প্রভাবশালীদের ভয়ে এই ব্যাপারে মুখ খুলতে রাজি হয়নি নির্যাতিত স্কুল ছাত্রী ও তার স্বজনরা। ধর্ষিতা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও তাকে বাঁধা প্রদান করেন মামা ইয়াছিন।

ইয়াছিন সাংবাদিকদের বলেন, যা হয়েছিল তা গ্রাম্য মাতব্বর ও পুলিশ সমাধান করে দিয়েছে। আমরা এই ব্যাপারে কোনো কথা বলতে চাইনা। তবে টাকার বিনিময়ে ধর্ষণের ঘটনা ধামাচাপা দিচ্ছেন, এমন অভিযোগের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি সরে যান।

এই ব্যাপারে জানতে চাইলে গ্রাম্য সালিশের বিচারক ইউপি সদস্য মোস্তফা সাংবাদিকদের বলেন, ‘মেয়েটি আমাদেরকে জানিয়েছে, একে একে ৩ জন তাকে ধর্ষণ করেছে। এরই প্রেক্ষিতে আমরা অভিযুক্ত ৩ জনকে দেড় লাখ টাকা করে জরিমানা করেছিলাম। কিন্তু তারা জরিমানার টাকা না দেয়ায় মেয়েটির পরিবার থানায় যায়। সেখানে ওসি সাহেব বিষয়টি সমাধান করে দিয়েছেন। তাই থানায় কোনো মামলা হয়নি। ’

পুলিশের অপর একটি সূত্রে জানা যায়, সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকতা (ওসি) সৈয়দুজ্জামান ৫ লাখ টাকায় গণধর্ষণের ঘটনাটি সমঝোতা করেন। এর মধ্যে নির্যাতিত ছাত্রীর পরিবারকে দেয়া হয়েছে আড়াই লাখ টাকা। আর বাকি টাকা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সার্কেল) শাহারিয়ার আলম ও থানা পুলিশের মধ্যে ভাগভাটোয়ারা হয়। তবে সাংবাদিকরা সরব হওয়ায় বেকায়দায় পড়ে পুলিশ। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে তড়িঘিড়ি করে আজ (৬ সেপ্টেম্বর,বৃহস্পতিবার) স্কুল ছাত্রীর নানির করা অভিযোগটি মামলাটি হিসেবে নথিভুক্ত করতে বাধ্য হয়েছে তারা।

জানতে চাইলে নরসিংদী সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সৈয়দুজ্জামান বলেন, ‘ঘটনাটি স্থানীয়ভাবে সমঝোতার চেষ্টা করা হয়েছে সত্য, কিন্তু পুলিশ সমঝোতা করেছে এটা সত্য নয়। আমরা নির্যাতিতার পরিবারকে বুঝানোয় অভিযোগ নিতে বিলম্ব করি। অভিযোগ পেয়ে মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করেছি। তাছাড়া বিষয়টি ওসি (তদন্ত) সালাউদ্দিন ডিল করেছেন। তিনি এই ব্যাপারে ভাল বলতে পারবেন। ’ টাকা নেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন,‘টাকা নিলে মামলা নিলাম কিভাবে?’

নরসিংদী পুলিশ সুপার সাইফুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘ধর্ষণের ঘটনা কেউ ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করলে, এমনকি সেটা যদি পুলিশও হয়, তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ’

 

সুমন▐ অরিন▐ NEWS24

সম্পর্কিত খবর