নৌকার প্রার্থীর ছড়াছড়ি, মাঠে বিএনপি-জামায়াত

সাতক্ষীরা ৩ আসনে নৌকার লড়াইয়ে হকের বিরুদ্ধে আব্দুলাহ, বিএনপি’র প্রার্থী শহিদুল্লাহ

সাতক্ষীরা-৩ আসন

নৌকার প্রার্থীর ছড়াছড়ি, মাঠে বিএনপি-জামায়াত

শাকিলা ইসলাম জুঁই, সাতক্ষীরা

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জমে উঠেছে সাতক্ষীরার নির্বাচনী মাঠ। সাতক্ষীরা-৩ আসনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত (স্বতন্ত্র হিসেবে) ও জাতীয় পার্টির যেসব প্রার্থীরা মাঠে নেমেছে তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির হেভিওয়েট প্রার্থীই বেশি। নৌকার মাঝি হতে এই আসনে মাঠে নেমেছেন বেশ কয়েকজন পোড় খাওয়া নেতা। আওয়ামী লীগ চাইছে যে করেই হোক আসনটি ধরে রাখতে।

অপরদিকে বিএনপি চাইছে জামায়াতের সমর্থন নিয়ে আসনটি পুনরুদ্ধার করতে।

এদিকে আওয়ামী লীগের মাঠ প্রতিক্রিয়া বলছে, কেন্দ্র থেকে সবুজ সংকেত পেতে বেশ কয়েকজন হেভিওয়েট প্রার্থী চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে সঠিক প্রার্থী নির্বাচন আওয়ামী লীগের জয়ের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তা না হলে এ আসনটি বিএনপি-জামায়াত জোটের দখলে চলে যাবে।

এ আসন থেকে বর্তমান এমপি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা মন্ডলির সদস্য, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. আ ফ ম রুহুল হক আবারও মনোনয়ন চাইছেন। অন্যদিকে কেন্দ্রের সবুজ সংকেত পেতে মাঠে নেমেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ'র প্রফেসর, নর্দান ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এন্ড টেকনোলজি খুলনার উপাচার্য ড.আবু ইউসুফ মো. আব্দুল্লাহ। তিনি এলাকায় গণসংযোগ, মটর শোভাযাত্রা, মসজিদ-মন্দির ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনুদান দিচ্ছেন। গত রমজান মাসে হতদরিদ্র সহ দলীয় নেতা-কর্মীদের ইফতার সামগ্রী বিতরণসহ নানা তৎপরতার কারণে এরইমধ্যে আলোচনায় চলে এসেছেন।

অপরদিকে মামলার কারণে বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীদের তেমন মাঠে দেখা না গেলেও ড্যাবের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ডা. শহিদুল আলম প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিএনপি থেকে তার দলীয় মনোনয়ন অনেকটা নিশ্চিত বলে মনে করছেন স্থানীয় নেতা-কর্মীরা। আর জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন চাইছেন কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট স.ম সালাউদ্দিন। অন্যদিকে নিষিদ্ধ হওয়ায় ও নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না জামায়াত। তবে জনসমর্থন থাকলে জামায়াতের কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়তে পারবেন। এ আসনে জামায়াতের প্রার্থী হিসেবে মুহাদ্দেস রবিউল বাসারের নাম শোনা যাচ্ছে। তিনি ভিতরে ভিতরে মাঠে কাজ করছেন। তার অবস্থা বেশ শক্তিশালি বলে জানা গেছে।

এদিকে বিএনপি প্রকাশ্যে জামায়াতকে নিয়ে কাজ না করলেও তারা চাইছে জামায়াতের সহযোগিতা নিয়ে আসনটি পুনরুদ্ধার করতে। সেক্ষেত্রে জামায়াতের প্রার্থী শেষ মুহূর্তে এসে মাঠ ছেড়ে দেবেন এমন গুঞ্জনই শোনা যাচ্ছে।

ভৌগলিক দিক দিয়ে দেবহাটা উপজেলার ৫টি, আশাশুনি উপজেলার ১১টি ও কালিগঞ্জ উপজেলার ৪টি ইউনিয়নের সমন্বয়ে মোট ২০টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত সাতক্ষীরা-৩ নির্বাচনী আসন। এখানকার মোট ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ৯০ হাজার ৭ শত ৯৮ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৯৭ হাজার ৪৭২ জন ও নারী ভোটার ১ লাখ ৯৩ হাজার ৩২৬ জন। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হয়ে ডা. আ ফ ম রুহুল হক স্বাস্থ্যমন্ত্রী হন। তার সময়ে সাতক্ষীরায় মেডিকেল কলেজ স্থাপন,ব্রীজ,কালভাট,রাস্তাঘাট সহ বিভিন্ন খাতে উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু এ আসনে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে মাথা উচু করে দাঁড়াতে পারছে না দলীয় নেতা-কর্মীরা। তিনটি উপজেলায় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক বিরোধ চরম হওয়ায় বর্তমান সরকারের অভূতপূর্ব উন্নয়ন প্রচারের ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে দলটি।  

আশাশুনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবিএম মোস্তাকিমের  সাথে দলের সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. পিন্টু ও সাবেক এমপি ডা. মোকলেছুর রহমানের বিরোধ তুঙ্গে। এ বিরোধ শুধু আশাশুনি উপজেলাতে নয়, রয়েছে কালিগঞ্জ ও দেবহাটা উপজেলাতেও। দেবহাটা উপজেলা চেয়াম্যান ও মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জেলা আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক আব্দুল গনির সাথে রয়েছে ভাইস চেয়ারম্যান সেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মাহবুব আলম খোকনের দা-কুমড়া সম্পর্ক। এছাড়া এখানে আওয়ামী লীগের সভাপতি-সম্পাদকের সাথে বিরোধ রয়েছে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের তথ্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক অ্যাড. স.ম গোলাম মোস্তফার। কালিগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি উপজেলা চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শেখ ওহেদুজ্জামানের সাথে চরম রিরোধ রয়েছে দলের সাধারণ সম্পাদক ইউপি চেয়ারম্যান সাঈদ মেহদির। ফলে দলের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে দল-উপদল। সাংগঠনিক কার্যক্রম চরমভাবে ব্যহত হচ্ছে।

তবে ডা. আ.ফ.ম রুহুল হক এমপি মনে করেন, একবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও পরের বার এমপি নির্বাচিত হয়ে এলাকার উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন তিনি। স্বাস্থ্যমন্ত্রী হয়ে দেশের জন্য এমডিজি পুরস্কারসহ বেশ কিছু ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার বয়ে এনেছেন। দেশের স্বাস্থ্য সেবা সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে পৌছে দিতে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো সক্রিয় করায় আজ মানুষ তার সুফল পাচ্ছে। এইসব ইতিবাচক কর্মকাণ্ডই তার দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিত করবে।

তবে এ আসনে আওয়ামী লীগের নৌকার বৈঠা নিতে মাঠে দীর্ঘদিন কাজ করছেন সাতক্ষীরার দেবহাটা কুলিয়া  ইউনিয়নের কৃতি সন্তান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, নর্দান ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এন্ড টেকনোলজি খুলনার উপাচার্য প্রফেসর ড. আবু ইউসুফ মো. আব্দুল্লাহ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীল দলের কর্মকাণ্ডের সাথে তিনি আগে থেকেই জড়িত আছেন। দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার জন্য তিনি কয়েক বছর আগে থেকেই এলাকায় কাজ করছেন। প্রফেসর ড.আবু ইউসুফ মো. আব্দুল্লাহ ও তার কর্মীরা মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। রোজা, ঈদ, পূঁজায় এলাকার গরীব ও অসহায়দের নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করছেন। আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদেরও নানা সময় সাহায্য-সহযোগিতা করে অল্প সময়ের মধ্যে নির্বাচনী এলাকায় নিজেকে মেলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। মসজিদ, মন্দিরসহ বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে আর্থিক অনুদান দিয়েও পরিচিতি পেয়েছেন। মটর শোভাযাত্রা করে নৌকায় ভোট চেয়ে শেখ হাসিনা সরকারের উন্নয়নের লিফলেট বিতরণের মাধ্যমে তার পরিকল্পনার কথাও কৌশলে জানান দিয়েছেন এলাকাবাসীকে।

ড. আব্দুল্লাহ বলেন, দলীয় মনোনয়ন বড় কথা নয়, এলাকার মানুষের পাশে থেকে সারাজীবন কাজ করতে চাই। সাতক্ষীরার যেসব সমস্যা রয়েছে তা নিয়ে কাজ করছি। একমাত্র আমিই দলীয় নেতা-কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছি। সবাই আমাকে চাইছে। দলীয় মনোনয়ন নিয়ে এমপি হতে পারলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সঠিক মূল্যায়নের পাশাপাশি সাতক্ষীরার সার্বিক উন্নয়নে নিজেকে উৎসর্গ করবো।  

এদিকে এ আসন থেকে আওয়ামী লীগের অন্যান্যদের মধ্যে মনোনয়ন চাইছেন সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, জেলা পরিষদের সাবেক প্রশাসক ও সাবেক এমপি মনসুর আহমেদ। বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে তিনি এ আসন থেকে নৌকা প্রতীক নিয়ে পর পর দুই বার এমপি নির্বাচিত হন। এছাড়া মনোনয়নের জন্য মাঠে রয়েছেন আশাশুনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি উপজেলা চেয়ারম্যান এ বি এম মোস্তাকিম। তিনি এলাকায় উঠান বৈঠক, মটর শোভাযাত্রা, সভা সমাবেশ করে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা লে. কর্ণেল জমায়েত আলীও নৌকার হয়ে মনোনয়ন চাইছেন।

এদিকে বিএনপির হেভিওয়েট প্রার্থী হিসেবে প্রচারে নেমেছেন ড্যাবের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ডা. শহিদুল আলম। এলাকার মানুষের কাছে তিনি বেশ জনপ্রিয়। একজন কার্ডিওলজি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে তার রয়েছে যথেষ্ট সুনাম। বিএনপি সরকারের আমলে তিনি সরকারি চাকরিতে থাকাকালীন সাতক্ষীরার সাধারণ মানুষের পাশে থেকে তাদেরকে নানাভাবে চিকিৎসা সেবা প্রদান করেছেন। দলীয় নেতা-কর্মীর বাইরে সাধারণ মানুষের মধ্যেও রয়েছে তার গ্রহণযোগ্যতা।

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে 'মিথ্যা' রাজনৈতিক মামলা প্রতাহারের দাবি জানিয়ে কেন্দ্র বিএনপির নির্বাহী কমিটির সভাপতি ডা. শহিদুল আলম বলেন, গণমানুষের সকল মৌলিক ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি যে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে তাতে দেশের সাধারণ মানুষ এবং সকল রাজনৈতিক দল সমর্থন দিয়েছে। একটি নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলে বিশ্বাস করি ভোটের ব্যালটে জনগণ তার জবাব দেবে এবং বিএনপির প্রার্থী জয়জুক্ত হবে।

সম্পর্কিত খবর