যেভাবে রোগীদের হত্যা করতেন হ্যোগেল

পৃথিবীর ইতিহাসে ভয়ঙ্কর ১১ সিরিয়াল কিলারI প্রতীকী ছবি

যেভাবে রোগীদের হত্যা করতেন হ্যোগেল

নিউজ টোয়েন্টিফোর ডেস্ক

নাম নিলস হ্যোগেল। বয়স ৪১। পেশায় নার্স। সেবাই তার ধর্ম।

রোগীর প্রাণ বাঁচাতে নিজের সবটুকু বিলিয়ে দেওয়া তার নৈতিক কর্তব্য। অথচ, প্রাণ বাঁচানোর বদলে রোগীর প্রাণ নেওয়া ছিল তার নেশা। শতাধিক রোগীর প্রাণ কেড়ে নেওয়ার পর অবশেষে ধরা পড়লেন জার্মানির এই সিরিয়াল কিলার। খুনের দায়ে হ্যোগেল এখন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত।

হ্যোগেলের হাতে প্রাণ যাওয়া রোগীদের মধ্যে সবচেয়ে কমবয়সি ব্যক্তিটির বয়স ছিল ৩৪, আর সবচেয়ে বেশি বয়সের রোগীর বয়স ছিল ৯৬। ঊর্ধ্বতনদের কাছে নিজের দক্ষতা প্রমাণ করতে কিংবা একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পেতে হ্যোগেল এ কাজ করতেন বলে জানিয়েছেন কৌঁসুলিরা।

কীভাবে এ হত্যাকাণ্ড ঘটাতেন হ্যোগেল? জানা গেছে, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের শরীরে প্রাণঘাতী ইঞ্জেকশন প্রয়োগ করতেন তিনি। এতে হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে বা শরীরে রক্তচাপ কমে রোগী মারা যেত। ২০০৫ সালে ডেলমেনহোর্স্টে এক রোগীকে চিকিৎসক দেননি এমন একটি ইঞ্জেকশন প্রয়োগ করতে গিয়ে হ্যোগেল প্রথম ধরা পড়েন।

২০০৮ সালে হত্যা চেষ্টার অভিযোগে তার সাত বছরের কারাদণ্ড হয়। তার অপরাধের বিস্তৃতি জানতে ২০১৪ সালে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। শুরু হয় নতুনভাবে বিচারকাজ। কমিশন শত শত মেডিকেল রেকর্ড পরীক্ষা করে। কবর থেকে তুলে আনা হয় ১৩৪টি দেহাবশেষ। তাদের শরীরে প্রয়োগ করা ওষুধের মাত্রা পরীক্ষা করা হয়। তবে অনেক রোগীর মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলায় তদন্ত কঠিন হয়ে পড়ে।

পরবর্তীতে দুই রোগীকে হত্যা এবং আরও দুইজনকে হত্যা প্রচেষ্টার অভিযোগে হ্যোগেল দোষী সাব্যস্ত হন এবং তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তবে পরবর্তীতে তদন্তকারীরা জানতে পারেন, হ্যোগেলের অপরাধের শিকার হয়েছেন আরও অনেকে। এরমধ্যে গত মঙ্গলবার আরও ১০০ জন রোগীকে হত্যার কথা স্বীকার করেন তিনি।  

মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই জানিয়েছে, সিরিয়াল কিলাররা সাধারণত রাগ, উত্তেজনা, অর্থের প্রভাব ইত্যাদি কারণে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় সিরিয়াল কিলাররা একই নিয়মে তাদের হত্যার কাজ করে থাকে।

শুধু হ্যোগেলই নয়, বিশ্বের দেশে দেশে সিরিয়াল কিলারদের অস্তিত্ব দেখতে পাওয়া যায়। সেখানে পুরুষের পাশাপাশি আছে অনেক নারীও। বাংলাদেশেও গত দুই দশকে এমন একাধিক সিরিয়াল কিলারের সন্ধান মিলেছে। হত্যাই তাদের নেশা। কেউ রক্ত দেখে আনন্দ পায়, কেউ নির্যাতন করে ভুক্তভোগীর আর্তচিৎকার শুনে আনন্দ পায়। মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে এটা এক ধরণের মানসিক রোগ। প্রেমে ব্যর্থতা, পারিবারিক অশান্তিসহ পারিপার্শ্বিক নানা পরিস্থিতির কারণে সুস্থ মস্তিষ্কের একজন মানুষও এ ধরণের রোগে আক্রান্ত হতে পারে।  

পাঠকদের জন্য রইলো বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কয়েকজন ভয়ঙ্কর সিরিয়াল কিলারের পরিচিতি।

এরশাদ শিকদার
কুখ্যাত এই খুনির জন্ম বাংলাদেশের ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার মাদারঘোনা গ্রামে। আস্তানা গেড়েছিল খুলনায়। পিতার নাম বন্দে আলী। ৬০টিরও বেশি হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত এরশাদ শিকদারের ফাঁসি হয় ২০০৪ সালের ১০ মে। ১৯৬৬-৬৭ সালে এরশাদ শিকদার তার জন্মস্থান নলছিটি থেকে খুলনায় চলে আসেন। এরপর সেখানে কিছুদিন রেলস্টেশনের কুলির সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে রেললাইনের পাত চুরি করে বিক্রি করে এমন দলের সাথে যোগদান করেন। পরবর্তীতে তিনি তাদের নিয়ে নিজেই একটি দল গঠন করেন ও এলাকায় রাঙ্গা চোরা নামে পরিচিতি পান। ১৯৮২ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ ক্ষমতা দখল করার পর তিনি জাতীয় পার্টিতে যোগদানের মাধ্যমে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত তিনি খুলনার রেলওয়ের সম্পত্তি দখল, জোরপূর্বক ব্যক্তিগত সম্পত্তি দখল, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি ও অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হন। এরশাদের বিরুদ্ধে ৬০টিরও বেশি হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ আনেন তার এক সময়ের সহযোগী ও পরবর্তীকালে রাজসাক্ষী নূরে আলম। নূরে আলম ২৪টি হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে আদালতে জবানবন্দি দেন।

রসু খাঁ
বাংলাদেশের আরেক ভয়ঙ্কর সিরিয়াল কিলারের নাম রসু খাঁ। প্রেমে প্রতারিত হয়ে শপথ নিয়েছিল ১০১ জন নারীকে খুন করার। এরপর বাকি জীবন কাটিয়ে দেবেন সুফি হিসেবে! তবে তার ভাগ্য অতটা সুপ্রসন্ন হয়নি। ১১ খুনের পরই পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। রশিদ খাঁ তথা রসু খাঁর জন্ম চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ থানার মদনা গ্রামে। সে ক্ষেতমজুর আবুল হোসেন ওরফে মনু খাঁ  ছেলে।

মাহফুজ
২০ বছর বয়সী এই যুবক মাত্র চার ঘণ্টায় খুন করে তার ৫ জন নিকটাত্মীয়কে! ঘটনা নারায়ণগঞ্জের। খুনের অস্ত্র হিসেবে শিলপাটার শিল বেছে নিয়েছিলেন এই ঘাতক। শিলের আঘাতে সবাইকে নির্মমভাবে হত্যা করে। পুলিশের ভাষায় অপেশাদার খুনি হলেও মাহফুজের মনোবল এতটাই দৃঢ় ছিল যে, প্রথম খুনটি করার পরেও দরজা খুলে না পালিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় একে একে আরও তিনটি খুন করেন। এরপর অপেক্ষা করতে থাকেন। বাসায় ফিরে এলে অনুজ মামাতো ভাই শান্তকে খুন করেন। এরপর পোশাক পাল্টে তিনি যে হোসিয়ারিতে কাজ করতেন সেখানে গিয়ে গোসল করে ঘুমিয়ে পড়েন। পরে পুলিশের জালে আটকা পড়ে এ খুনি। খুনির ভাষ্যমতে, তার ছোট মামী লামিয়ার সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। এ সম্পর্ক জানাজানির পর অন্যরা বকাঝকা করলে তার ভেতর ক্ষোভ জন্ম হয়। এর জেরেই তিনি এ হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটান।

পিচ্চি বাবু
বাংলাদেশের আরেক সিরিয়াল কিলার পিচ্চি বাবু ওরফে বাবু ওরফে মোমিন। খুন করেছেন ৭টি, তার মধ্যে ৫জনই নারী। এই খুনি ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে মেয়েদের বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে বগুড়ায় নিয়ে খুন করতেন। প্রথম খুন করেন তরমুজ ব্যবসায়ী সামাদকে (৪০)। এরপর ২০১০ সালে সোনিয়া (২০) নামে এক নারীকে ঢাকা থেকে শিবগঞ্জের মেঘাখদ্দে নিয়ে ধর্ষণের পর খুন করেন। এভাবে লাকি আক্তার, তানিয়া, লিপি, শাপলা তার হাতে খুনের শিকার হন। পিচ্চি বাবুর সর্বশেষ শিকার তার স্ত্রীর ভাগ্নে সুজন (১৬)। খুন করতে চেয়েছিলেন স্ত্রী নিপাকেও। তবে শেষ পর্যন্ত সেটা আর পারেননি। এরপর নিপার সহায়তায় ঢাকার উত্তরখান থেকে পিচ্চি বাবুকে গ্রেপ্তার করা হয়।

জিল দ্য রাই
জিলকেই পৃথিবীতে আধুনিক সিরিয়াল কিলারদের পথিকৃৎ হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। ১৪০৪ সালে ফ্রান্সে জন্ম। তাঁর পুরো নাম জিল দ্য রাই। জিল নিজ হাতে প্রায় শতাধিক ব্যক্তিকে হত্যা করেছিল। যাদের বেশিরভাগই ছিল বালক শিশু। এরা সবাই ছিল ব্লন্ড চুল ও নীলচোখের অধিকারী। জিলের শিকারের প্রকৃত সংখ্যা জানা যায়নি। ধারণা করা হয় তার শিকার সংখ্যা প্রায় ৮০ থেকে ২০০টির মতো ছিল। আবার কারও কারও মতে এর সংখ্যা ৬০০টিরও বেশী।

টেড বান্ডি
তাকে বলা হয় আমেরিকার সবচেয়ে কুখ্যাত সিরিয়াল কিলার। জন্ম ১৯৪৬ সালে। ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত অসংখ্য নিরপরাধ তরুণীকে খুন করে সে। তরুণীকে সে টার্গেট করত, তার সামনে গিয়ে অসুস্থ হওয়ার ভান করত কিংবা একজন পুলিশম্যানের অভিনয় সাজাতো সে। তার গাড়িতে সবসময় শাবল থাকত। যার মাধ্যমে ভিকটিমকে মারা হত। মেরে ফেলার আগে ভিকটিমকে টেড ধর্ষণ করত। মেরে ফেলার পর তরুণীর সাথে আবার যৌন সম্পর্ক স্থাপন করত সে! পুলিশের হাতে ধরা পড়ার আগ পর্যন্ত ৩০ জনের বেশি তরণীকে খুন করে টেড। পরবর্তীতে তাকে ইলেক্ট্রিক্যাল চেয়ারে শক দিয়ে মারা হয়।

জেফরি ডাহমার
আমেরিকার সিরিয়াল কিলিঙের ইতিহাসে জেফরি ডাহমারও ভয়ঙ্কর একটি নাম! তার সিরিয়াল কিলিং জীবনে অসংখ্য মানুষ খুনের স্বীকার হয়। যাদেরকে সে নিজের বাসায় নিয়ে যেত এবং নির্মমভাবে হত্যা করত। প্রায় সব ভিকটিমকেই মারার পর তাদের অঙ্গহানি করা হতো। তাদের মাথার খুলি সে সাজিয়ে রাখত! কখনোবা মৃত ভিকটিমের মাংস খেত সে!  তারপর জেফরি-কে ৯০০ বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়! কিন্তু জেলের ভেতর সে আত্নহত্যা করে।

এলেকজান্ডার সলোনিক
রাশিয়ান সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার আগে থেকেই খুনোখুনিতে হাত পাকায় সে। দুই হাতে পিস্তল পরিচালনা এবং মল্লযুদ্ধে বিশেষ পারদর্শিতার জন্য তাকে রাশিয়ান সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দেয়া হয়। সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেয়ার পর আবার সে তার পুরনো পেশায় ফিরে যায়। দুই হাতে অস্ত্র পরিচালনার দক্ষতার উপর ভিত্তি করে হলিউডে তৈরি হয় “হিটম্যান এজেন্ট-৪৭” সিনেমা সিরিজটি। রাশিয়ান সেনাবাহিনীতে কাজ করার সুবাধে “এজেন্ট-৪৭”, “সুপারকিলার”- নামগুলো নিজের করে নেয় সে।

রিচার্ড কুকলিন্সকি
আমেরিকানদের কাছে “আইসম্যান” হিসেবে পরিচিত এই কুখ্যাত খুনী ২৫০ এরও বেশি মানুষকে হত্যা করে। ভিকটিমকে বরফে জমিয়ে মেরে ফেলত সে! তার এই অভিনব পদ্ধতি যাতে পুলিশের হাতে না যায় সেজন্য, মৃত দেহের আশপাশে বিভিন্ন ধরণের খুনের যন্ত্রপাতি রেখে যেত সে। এতে পুলিশও দ্বিধায় ভুগত! পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর তার নামে ৫ টি খুনের অভিযোগ আনা হয়! কারণ তার বেশিরভাগ খুনেরই কোন প্রমাণ থাকত না!

রিচার্ড ট্রেটন সেচ
কুখ্যাত এই সিরিয়াল কিলার ১৯৫০ সালের ২৩ মে আমেরিকায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। খুনের পর শিকারের রক্তপান ও মাংস ভক্ষণ করায় ‘ভ্যাম্পায়ার অব স্ক্রেরামেন্টো’ নামে পরিচিতি লাভ করেছিলেন এই খুনি। ১৯৭৭ সালের ২৯ ডিসেম্বর ৫১ বছর বয়সী ইঞ্জিনিয়ার এমরোস গ্রিফিনকে হত্যা করে 'খুনের মিশন' শুরু করেন রিচার্ড। এরপর টেরেসা ওয়ালিন নামে এক অন্তঃসত্ত্বা নারীকে হত্যা করে মৃতদেহের সঙ্গে যৌনকার্যে লিপ্ত হন। এরপর তার রক্ত দিয়ে গোসল করেন। এরপর খুন করেন প্রতিবেশী ৩৮ বছর বয়সী ইভেলিন মিরোথকে। মিরোথকে হত্যার পর তিনি একইভাবে ডন মেরিডিটথকে হত্যা করেন। মেরিডিটথকে হত্যার সময় রিচার্ড তার ৬ বছর বয়সী ছেলে জেসন, ২২ বছর বয়সী ভাগ্নে ডেভিডসহ আরও তিনজনকে গাড়ির ভেতর গুলি করে খুন করেন। হত্যার পর বাসায় ফিরে ডেভিডের রক্ত পান ও শরীরের মাংস ছিঁড়ে খেয়েছিলেন রিচার্ড। পরে মৃতদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পার্শ্ববর্তী চার্চে ফেলে আসতে গেলে এক ব্যক্তি তা দেখে ফেলেন। সেই পুলিশকে বিষয়টি জানায়। পরে তার তথ্য ও রিচার্ডের আঙুলের ছাপ পরীক্ষা করে রিচার্ডকে গ্রেপ্তার করা হয়। খুনের দায়ে ১৯৮০ সালে মৃত্যুদণ্ড হয় রিচার্ডের। তবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আগেই রিচার্ডকে তার সেলে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।

 

(নিউজ টোয়েন্টিফোর/আরকে)

সম্পর্কিত খবর