‘মি-টু’-কে ‘ঝাল’ মেটানোর হাতিয়ার করা ক্ষতিকর

ফরিদ কবির

‘মি-টু’-কে ‘ঝাল’ মেটানোর হাতিয়ার করা ক্ষতিকর

ফরিদ কবির

‘আমি জানি যে একজন আমাকে পছন্দ করে। এটা আমি জানি আর উপভোগও করি। অর্থাৎ আমাকে সে যে পছন্দ করে এটা ভাবতে ভালো লাগে (বয়সের দোষও হতে পারে) কিন্তু তার মানে কি এই- নির্জনে সে আমাকে আমার এই জানার কারণে জাপটে ধরা‚ চুমু খাওয়া বা আরো কিছু করার অধিকার রাখে?’

আমার এক ফেসবুক বন্ধু লিখেছেন ওপরের পোস্টটি।  

তার পোস্টটি পড়ে এটাই মনে হচ্ছে, তিনি ছেলেটিকে পছন্দ করলেও বা বিষয়টি উপভোগ করলেও ছেলেটির প্রতি তার ভালোবাসা তেমন জন্মায়নি।

এর ফলে ছেলেটির ঘনিষ্ট হতে চাওয়ার বিষয়টি তার মধ্যে বিরক্তি জাগিয়েছে। এমন একটা পরিস্থিতি সব সময়েই স্পর্শকাতর। ভুল বোঝাবুঝিরও জন্ম হয় এমনই পরিস্থিতিতেই।

এমন ঘটনায় ছেলেটি যদি ভাবে, মেয়েটি তাকে প্রশ্রয়ই দিচ্ছে তাহলে তার পক্ষে মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরা বা চুমু খাওয়ার চেষ্টা করা দোষের হবে কিনা সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ।

হ্যাঁ, ছেলেটি যদি জোরজবরদস্তি করে তাহলে তা অন্যায়। মেয়েটির ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাকে স্পর্শ করাও অনৈতিক। কিন্তু, এমন পরিস্থিতিতে যে ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ আছে, সেটা আমার এই ফেসবুকবন্ধুর কথায় স্পষ্ট।

তবে, এমন ঘটনার পর যদি ছেলেটি বুঝতে পারে মেয়েটির তাতে সায় নেই এবং এ ক্ষেত্রে মেয়েটির কাছে যদি সে দুঃখ প্রকাশ করে বা ক্ষমা চায়, তাহলে তার নিষ্পত্তি সঙ্গে সঙ্গেই হতে পারে। কিন্তু এ রকম কোনো ঘটনায় কোনো ছেলেকে নিপীড়ক বলে চিহ্নিত করা সমীচীন নয় বলেই মনে করি।

আমাদের দেশে ছেলে-মেয়ে বা নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্কটা সব সময়েই স্পর্শকাতর। এটাও বলা দরকার, ভালো লাগা ও ভালোবাসার মধ্যে আছে বিশাল ফারাক। এটা খুব কম পুরুষই বুঝতে পারেন। স্রেফ ভালোলাগার ভিত্তিতে যে কোনো মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ট হওয়া যায় না, তা ওপরের পোস্ট পড়লেই স্পষ্ট হয়।

সমস্যাটা হয় অন্য জায়গায়। যখন প্রেম-ভালোবাসার পর প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। ব্রেকআপের পর নিরানব্বই শতাংশ ক্ষেত্রেই নারী-পুরুষের সম্পর্কটা খুবই তিক্ততার পর্যায়ে পৌঁছায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শত্রুতার পর্যায়েও। এমন পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে কেউ যদি পুরোনো ‘ঝাল’ মেটায় তাহলে তা হবে খুবই দুঃখজনক।

‘মি-টু’ আন্দোলন কোনোভাবে ব্যক্তিগত ‘ঝাল’ মেটানোর হাতিয়ার হলে তা যেমন ক্ষতিকর হবে, তেমনি কেউ মৃত বা খ্যাতিমান কারোর বিরুদ্ধে যৌননিগ্রহের অভিযোগ তুলে বিখ্যাত হওয়ার চেষ্টা করলে সেটাও হবে এ আন্দোলনের জন্য সমান ক্ষতির।

প্রসঙ্গক্রমে একটা কথা না বললেই নয়। জীবনে প্রচুর নারীর সঙ্গে আমি মিশেছি। বিয়ের আগে যেমন, বিয়ের পরেও। আমার ধারণা, যে পুরুষ নারীদের সঙ্গে কম মেশার সুযোগ পান তাদের মধ্যে অবদমন থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। আমার ধারণা মেয়েরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিগ্রহের শিকার হন এমন পুরুষের হাতেই। ব্যতিক্রমও থাকতে পারে।  

আমি নিজে নানা বয়সী মেয়ে বা নারীদের সঙ্গে সহজেই মিশতে পারি। এর কৃতিত্ব অবশ্য আমার রুমমেটের। কারণ তিনি এ বিষয়টাকে সহজে মেনে নিতে পারেন। তিনি সহজভাবে নেন বলেই আমি যে কোনো নারীর সঙ্গে খুব সহজে মিশতে পারি। অামি অনেক নারীকে জানি, যারা তাদের স্বামীদের মেয়ে বন্ধুদের বিষয়ে খুবই কঠোর। স্বামীদের প্রাক্তন প্রেমিকাদের বিষয়ে তো আরো কঠোর। এমন পুরুষরা একটা অবদমনের মধ্যে থাকেন এবং তাদের একটা বড় অংশ পরে নারী-নিপীড়ক হয়ে ওঠেন বলেই আমার ধারণা। মনস্তত্ত্ববিদরা অবশ্য ভালো বলতে পারবেন।

তো এই যে আমি সহজে যে-কোনো নারীর সঙ্গে মিশতে পারছি, এর ফলে নারী বিষয়ক কোনো অবদমন, কোনো ‘রং ডিজায়ার’ বা ‘ইনহিবিশন’ আমার নাই।  

যদিও একবারই, অল্প বয়সে আমার পা পিছলেছিল, একটা মেয়েকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোরজবরদস্তি আমি চুমু খাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম- সে ঘটনা আমি ফেসবুকে লিখেছিও। সেই মেয়েটি অবশ্য আমার চেষ্টা সফল হতে দেয়নি। বছর দুয়েক আগে প্রকাশিত আত্মজীবনীমূলক বই ‘আমার গল্প’-এ সে ঘটনার বিস্তারিত আছে। কিন্তু, সম্ভবত সেই শেষবারই অমন একটা কাণ্ড আমি করেছিলাম।

ফেসবুকে আসার পর এখানে কোনো নারীবন্ধুর সঙ্গে কখনো কোনো অসঙ্গত আচরণ করেছি বলে মনে পড়ে না। কাউকে কখনো কোনোভাবে বিরক্ত করেছি বলেও মনে পড়ে না।

সত্যি বলতে খুব ঘনিষ্ট সম্পর্ক না হলে নিজে থেকে কারোর ইনবক্সেও আমি যাই না!

কিন্তু এ কথা আমার স্ত্রীসহ আমার নারীবন্ধুরা ভালোই বলতে পারবেন, প্রতিনিয়ত ফেসবুকেও কতোটা নিগ্রহের শিকার তাদের হতে হয়।  

‘মি-টু’ নিয়ে বাংলাদেশের মতো রক্ষণশীল দেশের নারীরাও যে সহজে চর্চা করতে পারছে, কেউ কেউ মুখ খুলে বলতে পারছে, সেটাকে আমি খুবই গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি বলেই মনে করছি।

এটা যতো বেশি জোরদার হবে, পুরুষদের মধ্যে যৌননিগ্রহের আগ্রহ ও সাহসও ততোই কমে আসবে।

কিন্তু একটা সাহস পুরুষরা না দেখালে সে পুরুষ কীসের? দেখা যাচ্ছে, কোনো নারী যখন কোনো পুরুষের বিরুদ্ধে যৌননিপীড়নের অভিযোগ তুলছেন তখনই সেইসব পুরুষ তার প্রতিবাদ করে জানাচ্ছেন, এসব অভিযোগ মিথ্যা, বানোয়াট।

যে মেয়েটিকে আমি তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে জবরদস্তি চুমু খেতে চেয়েছিলাম আজ সে আমার বিরদ্ধে এমন অভিযোগ তুললে আমি সে অভিযোগ ঠিকই স্বীকার করে নিতাম। বলতাম, হ্যাঁ, অভিযোগ সত্য। আমি ভুল করেছিলাম। অন্যায় করেছিলাম। আমি খুবই দুঃখিত। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও।

মেয়েটি আমাকে ক্ষমা করতো কি না জানি না। কিন্তু অপরাধবোধ থেকে তো আমার কিছুটা মুক্তি মিলতো।

এখন তুলসিপাতাটা যতোটা ধোয়া দেখাচ্ছে, তাতে তো একসময় মাটির দাগ ছিলোই, এটা স্বীকার করে নিতে আমার আপত্তি নেই।  

লেখক: সাংবাদিক

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

(নিউজ টোয়েন্টিফোর/তৌহিদ)

সম্পর্কিত খবর