ভয়ঙ্কর মৃত্যুফাঁদ ত্রিভুবন বিমানবন্দর! [ভিডিও]

প্রতীকী ছবি

ভয়ঙ্কর মৃত্যুফাঁদ ত্রিভুবন বিমানবন্দর! [ভিডিও]

নিউজ টোয়েন্টিফোর ডেস্ক

বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক বিমানবন্দর হিসেবে পরিচিতি রয়েছে কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের। কাঠমান্ডুর এই এয়ারপোর্টে ইউ-এস বাংলার ফ্লাইটসহ অন্তত ৭০টি এয়ারক্রাফট দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে। এসব দুর্ঘটনায় ৬৫০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। বিমানের পাশাপাশি সেখানে হেলিকপ্টারও বিধ্বস্ত হয়েছে।

একটু ভুল হলেই মৃত্যু। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ত্রিভুবনে বিমান ওঠা-নামা করানোর জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ নিতে হয়। কারণ, আর দশটি সাধারণ বিমানবন্দর থেকে এটি সম্পূর্ণ আলাদা।

হিমালয় পর্বতমালার কারণে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় একটি দেশ নেপাল।

তাই প্রতিদিন প্রচুর যাত্রীও আসা-যাওয়া করেন এখানে। কিন্তু, সেখানকার বিমানবন্দরটি যেন এক মৃত্যুফাঁদ। পর্বতের কারণে দূর থেকে আস্তে আস্তে নিচে নেমে আসার সুযোগ এখানে নেই। অনেকটা খাঁড়াভাবে নামিয়ে আনতে হয় উড়োজাহাজকে। এছাড়া প্রায়ই ঘন কুয়াশা ঘিরে ফেলে ত্রিভুবন বিমানবন্দরকে। দেখা যায় না রানওয়ে। এ কারণে ফ্লাইট পরিচালনায় বিপত্তিতে পড়তে হয় পাইলটদের। পাহাড় ঘেরা এই বিমানবন্দরটি কাঠমান্ডু উপত্যকায় এবং শহরের কেন্দ্র থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে। একের পর এক বিমান দুর্ঘটনার কারণে এই বিমানবন্দরটির নিরাপত্তা নিয়ে প্রায়শই আলোচনা হয়।  

 

উইকিপিডিয়া বলছে, নিয়মিত বিমান চলাচল শুরু হওয়ার কিছু দিন পরই একটি দুর্ঘটনা ঘটে ১৯৭২ সালের মে মাসে। থাই এয়ারওয়েজের একটি বিমান অবতরণ করার সময় রানওয়ে থেকে ছিটকে পড়ে। তাতে ১০০ জনের মতো যাত্রী ও ১০ জন ক্রু ছিলো। তবে নিহত হন একজন।

১৯৯২ সালে থাই এয়ারওয়েজের একটি এয়ারবাস অবতরণ করার জন্যে বিমানবন্দরের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় একটি পাহাড়ে বিধ্বস্ত হয়। এতে ১১৩ জন যাত্রীর সকলেই নিহত হয়।

একই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে হয় আরো একটি বড় ধরনের দুর্ঘটনা। পিআইএর বিমানটি বিধ্বস্ত হলে বিমানের ভেতরে থাকা ১৬৭ জনের সবাই প্রাণ হারায়।

১৯৯৫ সালে রয়্যাল নেপাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান বেষ্টনী ভেঙে মাঠের ভেতরে ঢুকে যায়। তাতে দু’জন নিহত হযন।

১৯৯৯ সালের জুলাই মাসে লুফথানসার একটি বিমান এয়ারপোর্ট থেকে উড়ান শুরু করার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই বিধ্বস্ত হয়। তাতে পাঁচজন ক্রু সদস্য নিহত হয়।

ওই একই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে নেকন এয়ারের একটি বিমান ত্রিভুবন বিমানবন্দরের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় একটি টাওয়ারের সাথে সংঘর্ষে কাঠমান্ডু থেকে ১৫ কিলোমিটার পশ্চিমে একটি অরণ্যে বিধ্বস্ত হয়। এতে ১০ জন যাত্রী ও ৫ জন ক্রুর সবাই নিহত হন।

২০১১ সালে বুদ্ধ এয়ারের একটি বিমান বিমানবন্দরের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় দুর্ঘটনায় ১৯ জন আরোহীর মধ্যে একজন শুরুতে প্রাণে বাঁচতে সক্ষম হলেও পরে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় মারা যান। বলা হয় খারাপ আবহাওয়া ও নিচুতে থাকা মেঘের কারণে ওই দুর্ঘটনা ঘটেছিলো।

২০১২ সালে সিতা এয়ারের একটি বিমান উড্ডয়নের পরপরই সম্ভবত একটি শকুনের সাথে ধাক্কা খাওয়ার পর বিধ্বস্ত হয়। এতে ১৯ জন আরোহীর সবাই মারা যান। ২০১৫ সালে তুর্কি এয়ারলাইন্সের একটি বিমান ঘন কুয়াশার মধ্যে নামতে গিয়ে সমস্যার মধ্যে পড়ে। ৩০ মিনিট ধরে এটি বিমানবন্দরের উপর উড়তে থাকে। দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় নামতে পারলেও সেটি রানওয়ের থেকে ছিটকে মাঠের ঘাসের উপর চলে যায়। ২২৭ জন যাত্রীকে সেখান থেকে নিরাপদে উদ্ধার করা হয়। ২০১৭ সালের মে মাসে সামিট এয়ারলাইন্সের একটি বিমান দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। সর্বশেষ গতকাল (১২ মার্চ) দুর্ঘটনার শিকার হলো ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের বিমানটি।

বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, ত্রিভুবন হচ্ছে নেপালের একমাত্র ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। এর ব্যবস্থাপনা অপর্যাপ্ত ও দুর্বল। ২০১৬ সালের প্রথম দিকে একটি টুইন অটার টার্বোপ্রোপ উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হলে এর ২৩ জন যাত্রীর সবাই প্রাণ হারান।

কেন এত বিপজ্জনক এ বিমানবন্দর?

এই রুটে নিয়মিত চলাচল করা পাইলটরা জানিয়েছেন দুর্ঘটনার কারণ। তাঁরা জানিয়েছেন, ত্রিভুবনে উড়োজাহাজ ওঠা-নামা করানোর জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ নিতে হয়। এখানে হিসাবে একটু ভুল হলেই বিপদ। অনেক অত্যাধুনিক উড়োজাহাজও এখানে দুর্ঘটনায় পড়ছে।

তারা বলেন, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪ হাজার ৪০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত ত্রিভুবন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। চারপাশের উচুঁ পাহাড়-পর্বতে ঘেরা। এখানে উড়োজাহাজ অবতরণ করাতে যেমন সতর্ক থাকতে হয়, তেমনি ওঠানোর সময় তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে হয়। ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নের পর থেকে এক ঘণ্টা সময় লাগে কাঠমান্ডুর আকাশসীমায় যেতে। বোয়িং কিংবা এয়ারবাসের উড়োজাহাজগুলো ৩২ হাজার ফুট থেকে ৩৬ হাজার ফুট উচ্চতা দিয়ে সেখানে উড়ে যায়। তবে ত্রিভুবনে অবতরণের সময় প্রধান বাধা একটি বিশাল পাহাড়, এটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮৭০০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত। ত্রিভুবন বিমানবন্দরের নয় মাইল দূরে রয়েছে এই পাহাড়। এ জন্য এই রানওয়েতে কোনো উড়োজাহাজই সোজা অবতরণ করতে পারে না। ওই পাহাড় পেরোনোর পরপরই দ্রুত উড়োজাহাজ অবতরণ করাতে হয়।

ত্রিভুবন বিমানবন্দরের আরেক বিপত্তির কারণ, এখানে অটোমেটিক ল্যান্ডিং সিস্টেমও নেই। এ পদ্ধতি থাকলে বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে রানওয়ের ৫০ ফুট পর্যন্ত উচ্চতায় থাকা উড়োজাহাজকে নির্দেশনা দেওয়া যায়। শাহজালালসহ বিশ্বের অন্যান্য বিমানবন্দরে অবতরণের সময় সাধারণত ৮০০ মিটার দূর থেকে রানওয়ের দিকে লক্ষ রাখেন পাইলটরা। কিন্তু অটোমেটিক ল্যান্ডিং সিস্টেম না থাকায় তিন কিলোমিটার দূর থেকে ত্রিভুবনের রানওয়ের দিকে লক্ষ রাখতে হয় তাঁদের। তা ছাড়া এর রানওয়ের দুই পাশেই রয়েছে পাহাড়। কোনো কারণে উড়োজাহাজ ত্রিভুবন বিমানবন্দর এলাকা পেরিয়ে গেলে আবার নতুন হিসাব কষে অবতরণ করাতে হয়।

এছাড়া উড্ডয়নের ক্ষেত্রে পাহাড়ের কারণে উড়োজাহাজ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আকাশের ওপর নিয়ে যেতে হয়। কারণ, ২৫ হাজার ফুট উচ্চতার অসংখ্য পর্বত রয়েছে। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সাড়ে ১১ হাজার ফুট ওপরে নিয়ে যাওয়ার পরই পাইলট ঠিক করেন কোন দিকে তাঁর উড়োজাহাজকে নিয়ে যাবেন।

সম্পর্কিত খবর