নাটোরের ‘পাখাপল্লী’ হাঁপানিয়ার গল্প ...

তালপাখা তৈরিতে ব্যস্ত হাঁপানিয়ার নারীরা [ছবি: নিউজ টোয়েন্টিফোর]

নাটোরের ‘পাখাপল্লী’ হাঁপানিয়ার গল্প ...

নাটোর প্রতিনিধি

‌‘তোমার তালপাখার বাতাসে প্রাণ জুড়িয়ে আসে আমার....’- প্রাণটা জুড়িয়ে যায় বলেই তালের পাখাকে বলা হয় ‘প্রাণের সখা’। গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহে ক্লান্ত প্রকৃতির বুকে পরিশ্রান্ত শরীরকে একরাশ শান্তির পরশে জুড়িয়ে দিতে তালপাখার জুড়ি মেলা ভার।

শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গি আর মমতার বুননে হাতে তৈরি তালপাখাই জীবন-জীবিকার অন্যতম মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার জামনগর ইউনিয়নের হাঁপানিয়া ফকিরপাড়া গ্রামের মানুষদের। বছরের ছয় মাস হাতপাখা তৈরি তাদের দিয়েছে বাড়তি উপার্জনের সুযোগ।

নারীদের করে তুলেছে স্বাবলম্বী। তবে প্রয়োজনীয় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও ঋণ সুবিধা না থাকায় সম্ভাবনাময় এ শিল্পটি বিকশিত হচ্ছে না।  

নাটোর শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হাঁপানিয়া গ্রামটিতে তালগাছ না থাকলেও এখন তালপাতার গ্রাম নামেই এর পরিচয়। সরেজমিন গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, এখানকার প্রায়  শতাধিক পরিবার পাখা শিল্পের সাথে জড়িত।

পরিবারের নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, ছোট-বড় সকলেই তালপাখা তৈরির সাথে জড়িত।  

ফাল্গুনের শুরুতে তালপাখার চাহিদা বেশি থাকে বলেই সবাই এই কাজে মননিবেশ করেন। তালপাখা তৈরির কারিগররা জানান, এর প্রধান কাঁচামাল ডাগুরসহ তালপাতা। উত্তরের জেলা নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে তালপাতা কিনে আনতে হয় পৌষ মাসের শুরুতে। প্রতিটি পাতা ডাগুরসহ কিনতে খরচ পড়ে ৫ থেকে ৭ টাকা।  

news24bd.tv

এই ডাগুরগুলোকে পাখার আকারে গোল করে কাটা হয় সতর্কতার সাথে। এরপর রোদে শুকানো হয় কয়েকদিন। শুকানো শেষে গুচ্ছ হয়ে থাকা ডাগুরের সঙ্কুচিত পাতা প্রসারিত করা হয় বাঁশের তৈরি কাঠির মাধ্যমে। পাতার একেকটি শিরা প্রসারিত করে কয়েক শিরা মিলে দুই প্রান্তে আটকানো থাকে কাঠি। এভাবে রাখার পর তালপাতা স্বাভাবিক প্রসারিত আকার ধারণ করলে গোলাকার পাখাটি রঙ করা বাঁশের খিল দিয়ে দু’পাশ আটকে সেলাই করে দেয়া হয়।  

একটি তালপাখা কাঁচামাল থেকে তৈরি করতে খরচ হয় আরো ২ থেকে ৩ টাকা। গড়ে ১০ থেকে ১১ টাকা দামের তালপাখার কারিগররা দেশের বিভিন্নস্থান থেকে আসা পাইকারদের কাছে বিক্রি করেন ১২ থেকে ১৫ টাকায়। প্রধানত রাজধানী ঢাকা, টাঙ্গাইল, খুলনা, পাবনা ও সিরাজগঞ্জে তালপাখার চাহিদা মেটায় হাঁপানিয়ার পাখা।

news24bd.tv

তালপাখা তৈরিতে পুরুষদের সঙ্গে সমানতালে কাজ করেন নারীরাও। সংসারের নিত্য কাজকর্মের পাশাপাশি পৌষের শুরু থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত পাখা তৈরি করে বাড়তি আয় করছেন তারা। তবে শ্রম অনুযায়ী মজুরি একেবারেই কম। একশ’ পিস পাখা তৈরি করলে মজুরি পান মাত্র ৩৫ টাকা! অথচ তারা এই কাজে এতটাই দক্ষ যে, ৩ থেকে ৫ জন নারী একসাথে বসলে ঘণ্টায় ৩০০টি পাখা অনায়াসে বানিয়ে দিতে পারেন।  

হাঁপানিয়া গ্রামের ষাটোর্ধ্ব  বৃদ্ধা সাবেজান বেগম জানান, তিনি এ গ্রামে বউ হয়ে আসার পর থেকে অদ্যবধি তালপাখা তৈরি করছেন। তালপাখা বানিয়েই তিনি তার সন্তানদের মানুষ করেছেন, বিয়ে দিয়েছেন। এখন তার পুত্রবধূও সংসারে বাড়তি উপার্জনের জন্য পাখা তৈরি করেন।

সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ আলাউদ্দিন বলেন, গত ৪ দশক ধরে তালপাখাই আমার জীবিকার উৎস। কিন্তু এতগুলো বছর পাখা তৈরি করলেও সরকারি কোন সহায়তা বা ঋণ পাইনি। এখানকার পাখার চাহিদা বরাবরই বেশি। তাই ঋণ সহায়তা পেলে আরো বেশি পাখা তৈরি করা সম্ভব।

মুনসুর আলী নামে অপর এক পাখা প্রস্তুতকারী বলেন, গ্রীষ্মের শুরুতে যে পরিমাণে পাখা এ গ্রাম থেকে সরবরাহ করা হয়, তাতে সরকারের উচিত আমাদের গ্রামকে ‘পাখাপল্লী’ হিসেবে গ্রামটিকে ঘোষণা করা। নিজস্ব পুঁজি কম থাকায় কোন কারিগরের পক্ষে বেশি পাখা বানানো সম্ভব হয়না।

স্কুল শিক্ষার্থী সুমি খাতুন জানায়, গরমের শুরুতে নিজেই পাখা তৈরি করায় ভাই ও দির মজুর বাবার ওপর লেখাপড়ার খরচ চালানোর জন্য চাপ দিতে হয় না। তালপাখা তাকে অল্প বয়সেই স্বনির্ভর করে তুলেছে। ’ 

 হাঁপানিয়া গ্রামবাসীর তালপাখা তৈরির খবর জানতে পেরে গ্রামটি সরেজমিনে ঘুরে দেখেন নাটোরের জেলা প্রশাসক শাাহিনা খাতুন। তাদের সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে নিউজ টোয়েন্টিফোরকে তিনি বলেন, স্বনির্ভর এ উদ্যোগকে আমি সাধুবাদ জানাই। তাদের কাজের পরিধি প্রসারিত করার জন্য সব ধরনের সহায়তার ব্যবস্থা করা হবে। আমি গ্রামবাসীর সঙ্গে আলোচনা করে তাদের চাহিদা পূরণে সর্বাত্মক চেষ্টা করবো। ’

সত্যিই, হাঁপানিয়া বঙ্গভূমিতে লুকিয়ে থাকা স্বনির্ভর আর সৃজনশীল মানুষদের প্রাণের গ্রাম। চাইলে আপনিও চলে আসতে পারেন এই ‘তালপাখার রাজ্যে’।

নাসিম/অরিন/নিউজ টোয়েন্টিফোর

সম্পর্কিত খবর