নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার জোয়াড়ী ইউনিয়নের নওপাড়া গ্রামে পরকীয়ার অপবাদ দিয়ে গ্রাম্য সালিশে তালাক দেওয়া গৃহবধূ ও তার পরিবারের সদস্যরা এখনও আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। গ্রাম প্রধানদের অব্যাহত হুমকির মুখে পুলিশ ও সাংবাদিকদের সঙ্গে কোনো কথা বলতে রাজি হচ্ছেন না তারা। থানায় মামলা করতে যেতেও সাহস করেননি তারা। গ্রামে বসবাসের স্বার্থে পুরো বিষয়টিকে ভাগ্যের নির্মম পরিহাস বলেই মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন তালাকপ্রাপ্ত গৃহবধূ ও তার পরিবার।
এই প্রতিবেদক বুধবারও ওই এলাকায় গিয়ে গৃহবধূ রুনা খাতুন ও তার পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে গেলে মাতব্বরের লোকজন প্রতিবেদকসহ গৃহবধূ রুনা ও তার পরিবারের সদস্যদের পিছু ছাড়েন না। হুমকি দিয়ে বলা হয়, গ্রামের মানুষ যেখানে বিচার করেছে সেখানে কারও কিছু বলার নেই। যদি কেউ কিছু বলে তা মাতব্বরদের কাছে শুনতে হবে। এই প্রতিবেদক ওই বাড়িতে গেলে কয়েকজন গ্রাম প্রধান ও তাদের লোকজন বাড়িটির সামনে অবস্থান নেয়।
গ্রামের মাতব্বর মোহম্মদ আলীর স্ত্রী সাবেক মহিলা ইউপি সদস্য রহিমা বেগম প্রতিবেদককে বলেন, গ্রামের সব মানুষ বিচার করেছে। এখন কারও কিছু বলার নাই। তিনি গৃহবধূ রুনা ও তার পরিবারকে হুমকি দিয়ে বলেন, গ্রামে থাকতে হলে নিজেদের দোষ স্বীকার করে সাংবাদিককে বলে দে। অপকর্ম করায় তোকে তালাক দিয়েছে তোর স্বামী একথা বলে দে। আর প্রতিবেদককে উদ্দেশ্য করে বলেন, মেম্বার এবং মাতব্বরদের সিদ্ধান্ত মেনেই তারা স্বামী-স্ত্রী তালাক নিয়েছে। এসময় তিনি তার মাতব্বর স্বামী মোহম্মদ আলীসহ অন্য মাতব্বরদের ফোন করে ফসলের মাঠ থেকে গ্রামে আসতে বলেন।
অভিযুক্ত আলমগীরের মা প্রতিবেদককে জানান, তার ছেলে ঘটনার সময় ছিল না। অথচ তার ছেলের সঙ্গে রুনার অনৈতিক সম্পর্কের কথা বলে রুনাকে ঘরে তালা দিয়ে রাখা হয়। এমন খবর পেয়ে তার ছেলে ভয়ে বাড়িতে আসেনি। পরে সালিশ ডেকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে রুনা ও তার স্বামী আলমকে তালাক দিতে বাধ্য করে। মাতব্বরসহ তাদের সমর্থকরা এখন তাদের হুমকি দিচ্ছে আলমগীরের সঙ্গে রুনার বিয়ে দেবে। তারা রুনার ঘর ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়ে তালাক নিতে বাধ্য করেছে।
রুনার স্বামী আলম জানান, তিনি তার স্ত্রীর অনৈতিক কর্মের কথা শুনেছেন দেখেননি। তার পরিবারের কেউ দেখেওনি। গ্রামের মানুষ বলেছে এবং প্রমাণ হাজির করায় গ্রামবাসীর উপস্থিতিতে তার স্ত্রীকে তালাক দিয়েছেন।
এদিকে বুধবার গণমাধ্যমে এ ব্যাপারে প্রতিবেদন প্রকাশের পর স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন বিষয়টি নিয়ে নড়েচড়ে বসে। বুধবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে উপপরিদর্শক
তহসেনুজ্জামানের নেতৃত্বে পুলিশের একটি টিম নওপাড়া গ্রামে ওই গৃহবধূর বাড়িতে যায়। কিন্তু এসময় ওই বাড়িসহ আশেপাশে গ্রাম প্রধানদের বিচরণে চরম আতঙ্কে ছিল পরিবারটি। এ সময় পুলিশ থানায় এনে এ ব্যাপারে মামলা করানোর কথা বললে গৃহবধূ রুনা খাতুন তাতে রাজী হন। কিন্তু গ্রাম থেকে উচ্ছেদ করে দেওয়া হবে বলে প্রধানদের দেওয়া হুমকির কারণে রুনার বাবা আব্দুর রহমান তাকে থানায় যেতে নিষেধ করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা জানান, রুনার বাবা আব্দুর রহমান একজন দরিদ্র ভ্যান চালক। বাড়ির ভিটা ছাড়া তেমন কোনো জমি-জিরাত নেই। কোনো ছেলে সন্তানও নেই তার। কয়েক বছর আগে দূরবর্তী অন্য গ্রাম থেকে এ গ্রামে এসে বাড়ি করে মেয়ে দুটিকে নিয়ে কোনো রকমে দিন কাটাচ্ছেন। গ্রামে নিজের কোনো স্বজন না থাকায় প্রধানদের এসব অনাচারের প্রতিবাদ না করে নীরবে মুখ বুঝে সহ্য করে যাচ্ছেন তারা। মাতব্বর ও তাদের লোকদের রক্ত চক্ষুর কাছে নতি শিকার করতে বাধ্য হয়েছেন। দুই মেয়ে নিয়ে খেয়ে না খেয়ে শান্তিতে বাস করার জন্য মাতব্বরদের কাছে নতি শিকার করেছেন।
বুধবার পুলিশ বাড়িতে গেলেও মামলা করতে না চাওয়ার কারণ জানতে চাইলে রুনার বাবা আব্দুর রহমান মোবাইলে জানান, কপালে যা ছিল তাই হয়েছে। পুলিশ তো আর প্রতিদিন আমাকে পাহারা দেবে না। এক মেয়ে নিয়ে লড়তে গিয়ে শেষে মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও হারাতে চাই না।
থানায় গেলে প্রধানরা বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তারা যা বলেছে, উপস্থিত সবাই শুনেছে, আমি আর কিছু বলতে চাই না।
বড়াইগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহরিয়ার খান জানান, এ ব্যাপারে আমরা যথেষ্ট আন্তরিক। তাদের নিরাপত্তাসহ বিষয়টি নিয়ে কী করা যায় সে ব্যাপারে আমরা তৎপর আছি। যেকোনো সময় তারা অভিযোগ দিতে পারেন। অভিযোগ পেলেই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি ভিকটিমের পরিবারের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখা হবে। এরপরও পুলিশের নজরদারী রয়েছে।
(নিউজ টোয়েন্টিফোর/নাসিম/তৌহিদ)