এমন ফাঁদে আপনি পড়েননি তো?

প্রতীকী ছবি

এমন ফাঁদে আপনি পড়েননি তো?

নিউজ টোয়েন্টিফোর ডেস্ক

সাতসকালে এমন খবর শুনে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না নুরুন নাহার। বলে কী লোকটা! কথা নেই বার্তা নেই, ২১ লাখ টাকা জিতেছি! একটু বিরক্তও হন তিনি। কেননা তিনি দেশের খবরা-খবর ভালোই রাখেন। এরকম অনেক ভুয়া লটারির খবর তিনি ইন্টারনেটে পড়েছেন, কলিগদের কাছেও শুনেছেন।

এবারই প্রথম তিনি নিজে এমন পুরস্কারের কথা জানলেন। এরপর যা হলো তা খুবই ভয়াবহ। শুনে অনেকেই হয়ত নুরুন নাহারকে বোকা বলবেন, কেউ আবার নিজের সঙ্গে ঘটে যাওয়া এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সঙ্গে মিলিয়ে নেবেন।
 
নুরুন নাহার রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত।
বড় হওয়ার স্বপ্ন আছে, তবে লোভী নন। হঠাৎ একটি অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন আসে তার মোবাইলে। তিনি যে মোবাইল অপারেটরের সিম ব্যবহার করেন, কলারের একই অপারেটরের নম্বর। ফোন রিসিভ করার সঙ্গে সঙ্গেই ওপাশ থেকে বলা হয় ‘গুড মর্নিং ম্যাম। আমি কাস্টমার সার্ভিস থেকে বলছি। আপনার জন্য একটি সুখবর আছে। আমাদের কোম্পানি থেকে শীতকালীন একটি লটারির আয়োজন করা হয় এবং আপনার এই নম্বরটি প্রথম পুরস্কার হিসেবে ২১ লাখ টাকা জিতেছে। ’  ফোন কেটে দেবেন কিনা ভাবছিলেন নুরুন নাহার। কিন্তু ফোন কাটার চিন্তাটা মুহূর্তেই বাদ দিলেন পরের কথাগুলো শুনেই।

ওপাশ থেকে বেশ সুন্দর করে বলছিলেন, ‘আপনি নিশ্চয় দুই দিন আগে বিটিভিতে রাত ৮টার সংবাদের পর প্রচারিত অনুষ্ঠানটি দেখেছেন ম্যাম। সেখানে মাননীয় বেশ কয়েকজন মন্ত্রীও উপস্থিত ছিলেন। আমাদের কোম্পানির সিইওসহ ৬৪ জেলার প্রতিনিধিরাও ছিলেন। সেই অনুষ্ঠানেই লটারিটি অনুষ্ঠিত হয়’। নুরুন নাহার বিটিভি দেখেন না বহু বছর। তিনি চিন্তায় পড়ে গেলেন। শুধু বললেন, ‘না, আমি দেখিনি। কিন্তু এটার প্রুফ কী?’ তখন তাকে জানানো হলো অল্প সময়ের মধ্যেই কাস্টমার সার্ভিস থেকে একটি কনফার্মেশন এসএমএস পাবেন ম্যাম। সেখানে প্রদত্ত ইনস্ট্রাকশন ফলো করতে হবে আপনাকে। আর তাছাড়া এই নম্বরটির প্রকৃত মালিক আপনি নিজেই তা ভেরিফাই করতে কিছু তথ্য দিতে হবে আপনাকে। ইনফরমেশন ভেরিফাই করার কথা বলে জেনে নেয় নুরুন নাহারের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক তথ্য। কিছুক্ষণ পর সত্যিই মোবাইল অপারেটরের নম্বর থেকে একটি কনফার্মেশন এসএমএস আসে। নুরুন নাহারের উত্তেজনা বেড়ে যায়। এরপর পুনরায় ফোন আসে নুরুন নাহারের নম্বরে। বলা হয় লটারি উইনার সিম হিসেবে সিমটি পুনরায় রেজিস্ট্রেশন করতে হবে যেটির ফি বাবদ ৩৫০০ টাকা প্রদান করতে হবে। দেওয়া হয় একটি বিকাশ নম্বর। নুরুন নাহার কিছুটা সন্দেহ আর কৌতূহল নিয়ে বিকাশের মাধ্যমে টাকা পাঠিয়ে দেন।

দুই দিন পর সেন্ট্রাল ব্যাংক লেখা একটি নম্বর থেকে এসএমএস আসে তার নম্বরে। যেখানে লটারি জেতার জন্য অভিনন্দন জানিয়ে বলা হয়— লটারিতে জেতা টাকা প্রসেস করার জন্য কিছু ব্যাংক চার্জ আছে। এই চার্জ পরিশোধ করতে মোবাইল অপারেটরের নির্দেশনা অনুসরণ করতে হবে। পরে আবার সেই নম্বর থেকে ফোন আসে নুরুন নাহারের কাছে। বলা হয় চার্জ বাবদ ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা বিকাশ করতে হবে। নুরুন নাহার সেন্ট্রাল ব্যাংকের এসএমএস পাওয়ার পর বিশ্বাস করতে থাকেন লটারি জেতার বিষয়টি। তাই চার্জ বাবদ টাকা পরিশোধ করে দেন দ্রুত। কিন্তু এ বিষয়টি নুরুন নাহার গোপন রাখেন। ২১ লাখ টাকা জিতে যাওয়ায় এতটাই তিনি উত্তেজনায় ছিলেন যে, নিজের স্বামীকেও তিনি বিষয়টি জানাননি। যদি তার স্বামী এতে বাধা দেন। তবে তো ২১ লাখ টাকা জলে যাবে। কয়েক দিন পর দুদকসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নামে এসএমএস আসে। সেন্ট্রাল ব্যাংক থেকে আবারও এসএমএস আসে। তাতে বলা হয়, এপ্রুভাল হয়ে গেছে। এখন ট্যাক্সের টাকা পরিশোধ করতে ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হবে। একটি বিকাশ নম্বরে টাকাগুলো পাঠিয়ে দিতে বলা হয়। নুরুন নাহারের কাছে এতগুলো টাকা ছিল না। তিনি তার ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে একদিনের কথা বলে দুই লাখ টাকা লোন করেন। পুরো টাকা ধাপে ধাপে বিকাশে পাঠিয়ে দেন। আবারও এসএমএস আসে। এভাবেই ধাপে ধাপে তিনি সাত লাখ টাকা বিকাশ করেন ২১ লাখ টাকার জন্য। আর এ জন্য তার নিজের স্বর্ণালঙ্কারও বিক্রি করেন। আবারও যখন টাকার জন্য বিকাশ নম্বর দেওয়া হয়, তখন তিনি সন্দেহ করতে থাকেন। আর টাকা দিতে পারবেন না বলে তিনি পাল্টা এসএমএস দেন। এরপর থেকেই সেই ফোনগুলো আর তিনি খোলা পাননি। তিনি বুঝতে পারেন প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়েছেন তিনি। জমানো টাকা, স্বর্ণালঙ্কার খুইয়ে এবং লোনে জর্জরিত নুরুন নাহার অসুস্থ হয়ে পড়েন।  

নুরুন নাহার জানান, এভাবে আমাকে কথাগুলো বলেছে, বিশ্বাস না করার উপায় ছিল না। বিশ্বাসীর অবিশ্বাস্য প্রতারণার ফাঁদে ফেলেছিল আমাকে।  

খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা গৃহবধূ বিলকিস আক্তারও পড়েছেন এমন চক্রের খপ্পরে। প্রিমিও গাড়ি লটারিতে জিতেছেন বলে একই কায়দায় তার কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে ১০ লাখ টাকা। বিলকিস আক্তারের স্বামী সাইফুল ইসলাম বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। তিনি জানান, বিবাহিত জীবনে স্ত্রীকে কখনই কোনো কিছুর প্রতি লোভ করতে দেখিনি। যে কোনো বিষয় আমার সঙ্গে শেয়ার করে। এমনই একজন মানুষকে প্রতারক চক্রের সদস্যরা সম্মোহন করে ফেলে। যে কারণে পুরো বিষয়টি আমার কাছেও গোপন রাখে। ফোনকল আসা থেকে শুরু করে টাকা জমা দেওয়া পর্যন্ত, কোনো কিছুই আমাকে বলেনি। ও যখন বুঝতে পারল যে, সে প্রতারণার শিকার হয়েছে, তখনই আমার কাছে খুলে বলল ঘটনাটি। আমি শুনেই বুঝতে পারি এরা ভয়ঙ্কর প্রতারক চক্র। এখন তো আর কিছু করার নেই। থানায় একটা অভিযোগ করেছি।

গত বছরের এপ্রিলে ঢাকায় পড়াশুনা করা মুক্তাদিরকে বাগেরহাটের মংলার একটি বিকাশ এজেন্টের দোকান থেকে সাড়ে ৭ হাজার টাকা পাঠান তার বড় ভাই। টাকা আসার ৫ মিনিটের মধ্যেই একটা নম্বর (০১৭৫৮২৫১৩৫৬) থেকে ফোন আসে। ওই বিকাশ এজেন্টের নাম ও কিছুক্ষণ আগে ভাইয়ের পাঠানো টাকার হুবহু বিবরণ দিয়ে জানায়, খাতায় নামটি পাশাপাশি থাকায় ভুল করে এই নম্বরে ফের সাতহাজার টাকা পাঠিয়ে দিয়েছেন। একইসঙ্গে বিকাশের মেসেজ আদলে একটি এসএমএসও আসে মুক্তাদিরের মোবাইলে। বিবরণ মিলে যাওয়ায় মুক্তদিরও সাতহাজার টাকা ফেরত পাঠিয়ে দেন ওই নম্বরে। পরক্ষণেই খেয়াল করেন বিকাশের আদলে যে মেসেজটি এসেছে তা কোন ব্যক্তিগত নম্বর থেকে পাঠানো। এরপর ব্যালেন্স চেক করে দেখেন আছে মাত্র ১৩৪ টাকা। এরপর ওই নম্বরে একাধিকবার ফোন দিলেও কেউ তা রিসিভ করেনি। বুঝে ফেলেন তার সরলতা ও সততার সুযোগ নিয়ে কেউ তাকে প্রতারিত করেছে। বাড়িতে ফোন করে বড় ভাইকে ওই দোকানে পাঠালে জানতে পারেন এমন ঘটনা ওই দোকান থেকে আগেও ঘটেছে। মোংলা থানার পুলিশও ঘটনা স্বীকার করে। তবে কেউ এখন পর্যন্ত আটক হয়নি এসব ঘটনায়। এরপর মুক্তাদির সংশ্লিষ্ট নানা দপ্তরে যোগাযোগ করে ওই নম্বরটি কোন জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে নিবন্ধন হয়েছে তা বের করেন। জানতে পারেন মোবাইল নম্বরটি মো. ফারুক হাওলাদার নামের একজনের। পিতার নাম আছমত আলী হাওলাদার। বাড়ি বরগুনার আমতলী। জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর-১৯৭৫০৪১০৯৩৯১২০০৯৯। এই একই জাতীয় পরিচয়পত্রের অনুকূলে আরও তিনটি সিমের (০১৭০৬৬৯৫১০৩, ০১৭৬৭৭০৮৫৩১ ও ০১৭৩৯৭০১৪৫০) নিবন্ধন রয়েছে। মুক্তাদির বলেন, মংলা থানায় মৌখিকভাবে বিষয়টি জানানো হয়েছিল। পুলিশ বলেছে, অভিযোগ দিতে পারেন। এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে এখানে। আমরা অনেকদিন ধরেই এই চক্রকে ধরার চেষ্টা করছি। কিন্তু, মোবাইল নম্বর ট্রাক করে ব্যক্তি খুঁজে বের করার প্রযুক্তি আমাদের কাছে নেই। তাই সম্ভব হচ্ছে না।

নিজের ই-মেইল চেক করতে গিয়ে যেন চক্ষু চড়কগাছ  চট্টগ্রামের হিমেলের। বিশ্বখ্যাত একটি অটোমোবাইল কোম্পানির ১০ সৌভাগ্যবান বিজয়ীর তালিকায় রয়েছে তার নামও! মার্কেটিং পলিসির অংশ হিসেবে সারাবিশ্ব থেকে লটারির মাধ্যমে ওই ১০ জনকে দেওয়া হবে একটি করে নতুন বিএমডব্লিউ গাড়ি এবং সঙ্গে প্রাইজমানি হিসেবে ৭ লাখ ব্রিটিশ পাউন্ড! এমন ই-মেইল পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হিমেল ভেবে পাচ্ছিলেন না কী করবেন। এত টাকা কীভাবে খরচ করবেন তার ছক কষতে থাকেন। এরই মধ্যে পান দ্বিতীয় ই-মেইল। তাতে লেখা, ৬ জানুয়ারি তার প্রাইজমানি নিয়ে বাংলাদেশে আসছেন মার্টিন জনসন নামে এক প্রতিনিধি। ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত এ দেশে অবস্থান করবেন ওই ব্রিটিশ নাগরিক। নিরাপত্তার স্বার্থে লটারি জেতার এ খবরটি কাউকে না জানানোর জন্য বলা হয়। একই সঙ্গে কাস্টমস ছাড়পত্রের জন্য হিমেলকে ৪০০ মার্কিন ডলার প্রস্তুত রাখতে বলা হয়। এবার ৪০০ মার্কিন ডলার দেওয়ার ব্যাপারে দ্বন্দ্বে পড়ে যান হিমেল। তিনি বুঝতে পারেন, এটি প্রতারক চক্রের কাজ। যে কারণে তিনি পাল্টা মেইলে ডলার দিতে পারবেন না বলে জানিয়ে দেন। এরপর ওইদিক থেকে আর কোন মেইল আসেনি।  

লোভে পড়েননি বলে এ যাত্রায় রক্ষা পান হিমেল। চট্টগ্রামের হিমেল রক্ষা পেলেও রেহাই পাননি নুরুন নাহার, বিলকিস আক্তার। সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসেছেন কলাবাগানের গৃহবধূ স্বর্ণালী বিশ্বাস, উত্তরার কলেজছাত্র ফাহিম আহমেদ। পড়াশুনার জন্য আনা খরচের টাকা প্রতারক চক্রের হাতে তুলে দিয়েছেন মুক্তাদির। এদের মতো প্রায় প্রতিদিনই প্রতারণার শিকার হচ্ছেন হাজারো মানুষ। প্রযুক্তি ব্যবহারে ভয়ঙ্কর ফাঁদ পেতে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারক চক্র। আর এই চক্রের সদস্য শুধু দেশের মানুষই নয়, রয়েছে বিদেশিরাও। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে মাঝে-মধ্যে এরা ধরা পড়লেও তাদের দৌরাত্ম্য থেমে নেই। দিন দিন তারা নিত্যনতুন কৌশলে হাতিয়ে নিচ্ছে টাকা। পুলিশ, গোয়েন্দা ও র‌্যাব জানায়, প্রতারক চক্র সারা দেশে ভয়ঙ্কর প্রতারণার জাল ছড়িয়ে দিয়েছে। চক্রের সদস্যরা অত্যন্ত স্মার্ট। তারা অনর্গল ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু ভাষায় কথা বলেন। তাদের রয়েছে মানুষকে সম্মোহন করার জাদুকরী কৌশল। পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, প্রতারক চক্রের সদস্যদের অধিকাংশই আইটি এক্সপার্ট হয়ে থাকে।

এরা একসময় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করত। কোনো কারণে চাকরি চলে যাওয়ায় প্রতারণা পেশায় নেমে যায়। মোবাইল ফোন অপারেটর কর্তৃপক্ষ বলছে, এ ধরনের ফোনকলের কোনো ভিত্তি নেই। ফোন কোম্পানি থেকে এ ধরনের লটারি কখনো করা হয় না। পুলিশ জানায়, এ ধরনের অসংখ্য অভিযোগ তারা পেয়েছে। কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগ এসব নিয়ে কাজ করছে। প্রতিনিয়ত চক্রের দেশি-বিদেশি সদস্যদের গ্রেফতার করছে। যেখানেই খবর পাওয়া যাচ্ছে, সেখানেই অভিযান চালানো হচ্ছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) জনসংযোগ শাখার উপ-কমিশনার (ডিসি) মাসুদুর রহমান বলেন, আমাদের জীবন যত তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর হচ্ছে, ততই বাড়ছে এ ধরনের ডিজিটাল প্রতারণার সংখ্যা। প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে প্রতারক চক্রের কাজের ধরন। তাই বদলাতে হবে, সচেতন হতে হবে সবাইকে। নিশ্চিত না হয়ে অপরিচিত কারও কথায় আর্থিক লেনদেনের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।  তথ্য সহায়তা: বাংলাদেশ প্রতিদিন

সম্পর্কিত খবর