বৈশাখ উপলক্ষে বাঁশি ও ফুল তৈরিতে মেতেছে দেবীপুর-জামগ্রাম

বৈশাখ উপলক্ষে বাঁশি ও ফুল তৈরিতে মেতেছে দেবীপুর-জামগ্রাম

বাবুল আখতার রানা • নওগাঁ প্রতিনিধি

তিনদিন বাদেই বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ। নানা ধরনের খেলনা আর পণ্যের সমাহার নিয়ে বসবে বৈশাখী মেলা। কোথাও কোথাও মেলা চলবে সপ্তাহ কিংবা পুরো মাস জুড়ে। আর মেলাকে সামনে রেখে নলের বাঁশি ও নানান বাহারি রঙের কাগজ, কাপড় ও শোলা দিয়ে কৃত্রিম ফুল তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন নওগাঁর দেবীপুর ও আত্রাইয়ের জামগ্রামের কয়েকশ কারিগর।

 

নওগাঁ সদর উপজেলার দেবীপুর ও আত্রাই উপজেলার জামগ্রাম স্থানীয়দের কাছে বিশেষভাবে পরিচিত। অধিকাংশ মানুষের কাছে দেবীপুর গ্রামটি বাঁশির গ্রাম এবং ‘জামগ্রাম’ স্থানীয়দের কাছে ‘ফুলগ্রাম’ হিসেবে পরিচিত। গ্রাম দুটির পাঁচ শতাধিক পরিবারের প্রায় দুই হাজার মানুষ বাঁশি ও কৃত্রিম ফুল তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। সারা বছরই এসব মানুষ বাঁশি ও ফুল তৈরি করে।

তবে কেবল বৈশাখ এলেই তৃপ্তির হাঁসি ফুটে ওঠে কারিগরদের চোখে-মুখে।

news24bd.tv

নওগাঁর দেবীপুর গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়ির বারান্দা, আঙিনা ও বাড়ির বাইরের খোলা জায়গায় গাছের ছায়ায় কারিগরেরা বসে বাঁশি তৈরির কাজ করছেন। পরিবারের নারী-পুরুষ সবাই ব্যস্ত। কেউ নল খাগড়ার বা নলের গাছ কেটে বাঁশির বিভিন্ন ভাগ তৈরি করছেন। আবার কেউ সেই বাঁশিতে জরি ও বেলুন লাগাচ্ছেন।

রাস্তার পাশে গাছের ছায়ায় বসে বাঁশি তৈরি করছিলেন মেহের ও সালেহা দম্পতি। জানতে চাইলে তারা বলেন, বাঁশি তৈরি তাদের প্রধান পেশা। পরিবারের ছয় সদস্যের সবাই বাঁশি বানাতে পারে। এবার মেলা উপলক্ষে ইতোমধ্যে তারা ৩০ হাজার বাঁশি বিক্রি করেছেন। এখনো প্রায় ২০ হাজার বাঁশির অর্ডার আছে। পহেলা বৈশাখের আগেই এসব বাঁশি সরবরাহ করতে হবে। তাই পরিবারের কারোরই দম ফেলার সময় নেই। রাত-দিন কাজ করতে হচ্ছে।  

বাঁশির কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৫০ থেকে ৬০ বছর আগে সর্বপ্রথম এ গ্রামে আলেক মণ্ডল নামের এক ব্যক্তি বাঁশি তৈরির কাজ শুরু করেন। পরে ক্রমশ তার দেখাদেখি পুরো গ্রামের মানুষ এ পেশায় জড়িয়ে পড়ে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা এখান থেকে জরি ও বেলুন ছাড়া প্রতি হাজার বাঁশি ৮০০ থেকে ১২০০ টাকায় এবং জরি ও বেলুন লাগানোসহ প্রতি হাজার বাঁশি ১৬০০ থেকে ২০০০ টাকায় পাইকারি দামে কিনে নেন। এসব বাঁশিই আবার মেলায় গিয়ে প্রতিটি ৫ থেকে ১০ টাকা করে বিক্রি হয়। আবার অনেকে আছেন, যারা নিজের তৈরি বাঁশি মেলায় গিয়ে ফেরি করে বিক্রি করেন।  
news24bd.tv

আত্রাই উপজেলার ভোপাড়া ইউনিয়নের জামগ্রামে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এটি একেবারেই অবহেলিত একটি গ্রাম। গ্রামে ঢোকার একমাত্র রাস্তাটির বেহাল দশা। গত বছরের বন্যায় ভাঙনের ক্ষত এখনও বিদ্যমান। গ্রামে ঢুকতেই চোখে পড়ল গাছের ছায়ায়, বাড়ির উঠানে এবং বাড়ির বাইরের খোলা জায়গায় কয়েক মিলে এক সঙ্গে বসে রঙিন কাগজ, কাপড় ও শোলা দিয়ে বাহারী সব ফুল তৈরি করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।  

কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই গ্রামের প্রায় চারশ পরিবার সারা বছর কৃত্রিম ফুল তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করে। এই গ্রামের বেশির ভাগ মানুষই দরিদ্র। কৃষি কাজসহ গৃহস্থলি অন্যান্য কাজের পাশাপাশি গ্রামের অধিকাংশ পরিবারের নারী-পুুরুষ, ছোট-বড় সবাই কৃত্রিম ফুল তৈরি করে। সারা বছর ফুল তৈরি করলেও বৈশাখী মেলা, দুই ঈদ ও দুর্গা পূজার সময় বাঁশি বিক্রি বেড়ে যায়।  

পহেলা বৈশাখ থেকে শুরু করে মাস জুড়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে বৈশাখী মেলা। এসব মেলায় বিক্রির জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা জামগ্রাম থেকে গোলাপ, স্টার, সূর্যমুখি, কিরণমালা, মানিক চাঁদ, জবা, বিস্কুট, গাঁদাসহ বাহারি সব ফুল কিনে নিয়ে যান। সব মিলিয়ে প্রতি বছর এ গ্রাম থেকে ৫০ থেকে ৬০ লাখ ফুল দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। উৎপাদন খরচের চেয়ে দিগুণ দামে এসব ফুল বিক্রি হয়।  

এই গ্রামের বাসিন্দা আসাদুর রহমান বলেন, ‘এই ফুল তৈরিতে পরিবারের নারীদের সদস্যদের অবদান সবচেয়ে বেশি। মেয়েরা সাংসারিক কাজ শেষে অবসর সময়ে ফুল তৈরি করে। বৈশাখ মাসকে ঘিরে ফুল তৈরির জন্য পরিবারের বড়দের পাশাপাশি ছোটরাও ফুল তৈরিতে লেগে যায়। কারণ সারা বছরের রুটি-রুজির অনেকটাই এই সময় আমাদের উপার্জন হয়। ’
 
স্কুল শিক্ষক হোসেন আলী বলেন, ‘এক সময় এই গ্রাম খুবই অবহেলিত ছিল। কিন্তু বর্তমানে একটু হলেও উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। এই গ্রামে এখনো পর্যন্ত বিদ্যুৎ আসে নাই। তাই এই সব কারিগররা শত ইচ্ছে থাকলেও রাতে  ফুল তৈরির কাজ করতে পারে না। এছাড়া গ্রামের একমাত্র রাস্তাটি কাচা। একটু বৃষ্টি হলেই কাদা হয়ে যায়। তখন সেটি চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ে। তাই এই শিল্পটিকে আরও গতিশীল করার জন্য আমাদের প্রয়োজন আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বিদ্যুৎ।

রানা/অরিন/নিউজ টোয়েন্টিফোর

সম্পর্কিত খবর