‘পোশাকে মিলছে স্ব স্ব সম্প্রদায়ের পরিচয়’

ভাষার ভিন্নতা, তেমনি রয়েছে পোশাকের বৈচিত্র্যতা

‘পোশাকে মিলছে স্ব স্ব সম্প্রদায়ের পরিচয়’

ফাতেমা জান্নাত মুমু,রাঙামাটি

তিন পার্বত্য জেলা মিলে বসবাস করে ১০ ভাষাভাষির ১১টি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী। এরা হচ্ছে- চাকমা, খিয়াং, তঞ্চঙ্গ্যা, মারমা, রাখাইন, খুমী, ম্রো, চাক, বম, পাংখোয়া ও ত্রিপুরা। এসব নৃ-গোষ্ঠীদের যেমন রয়েছে ভাষার ভিন্নতা, তেমনি রয়েছে পোশাকের বৈচিত্র্যতা। যেন পোশাকে মিলছে স্ব স্ব সম্প্রদায়ের পরিচয়।

এসব পেশাক দেখতে যেমন আকর্ষনীয় তেমনি চাহিদাও অনেক। তাই রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলায় ঘুরতে গিয়ে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের বাহারি পোশাক কিনে আনেননি এমন মানুষ খুব কমই আছেন। এক সময় এসব পোশাক কিনতে হলে আসতে হতো পার্বত্যাঞ্চলে। কিন্তু বর্তমানে দেশের বিভিন্ন দোকানেই পাওয়া যাচ্ছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক।
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের পোশাক ও গহনায় ভিন্নতা থাকায় তা ফ্যাশন হিসেবেই ব্যবহৃত হচ্ছে সমতলের মানুষের কাছে।

জানা যায়, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের মধ্যে চাকমা, তঞ্চঙ্গ্যা ও ত্রিপুরা নারীরা নিচের অংশে যেটা পরিধান করে তার নাম-পিনন আর যেটা উপরের অংশে পড়ে সেটা হচ্ছে হাদি অর্থাৎ পিনন-হাদি। এ পোশাকটি উজ্জ্বল রং আর বুননে চমৎকারভাবে তৈরি। আবার অনেক গোষ্ঠীর মধ্যে দেখা যায় তারা একখন্ড কাপড় এক প্যাঁচে জড়িয়ে পরছেন। চাকমারা একে ডাকে কোমরকাটা নামে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনো ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারীরা জুম থেকে তুলা সংগ্রহ করে সুতা তেরি করে। আর সে সুতা থেকে কোঁমড় তাতে পিনন-হাদি তৈরি করে তারা। এক জোড়া পিনন হাদি তৈরি করতে অনন্ত ১০ থেকে ১৫দিন সময় লাগে। এ পিনোন হাদি তৈরি করতে প্রথমে রদং বাশেঁর (বাশেঁ গায়ে ছিদ্র করা) ওপর ছোট ছোট বাঁশ বসিয়ে দিয়ে সুতা গাঁথা হয়। পরে বাইন (কোমর তাঁতে) বিভিন্ন নকশা সংবলিত ক্যাটালক দেখে পিনোন হাদি তৈরি করতো। কিন্তু বর্তমানে জুম পোশাকের বাহার এখন আধুনিক তরুণীদের কাছে একটি আকর্ষনীয় পোশাক। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন শপিং মলে মিলছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকের আদলে তৈরি সালোয়ার-কামিজ, ফতুয়া, শার্ট, পাঞ্জাবি ও শাড়ি। বিশেষ করে পর্যটন এলাকার বিভিন্ন ফ্যাশন হাউজগুলো তরুণদের কথা মাথায় রেখে এসব পোশাকের পাশাপাশি নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্রও বিক্রি করছেন। এ পোশাকের  চাহিদা অনেক থাকায় বিক্রিও হচ্ছে জমজমাট। এতে করে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের ঐতিহ্য সংষ্কৃতি, তেমনি অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হচ্ছে ব্যবসায়ীরা বলে জানালেন স্থানীয় তাঁত বস্ত্রব্যবসায়ী বাবর টেক্সটাইলের মালিক এলেন বড়–য়া।

এক বস্ত্রব্যবসায়ী বলেন, তাদের নিজেদের তাঁতে বেশির ভাগ কাপড় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের পোশাকের আদলে তৈরি। কারণ এসব পোশাকের চাহিদা অনেক। তাই ব্যবসাও বেশ লাভ জনক।

একটা সময় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারীরা নিজেদের প্রয়োজনে পিনন-হাদি তৈরি করতো। সুতা রঙ করতো বিভিন্ন ফুল, ফল, পাতা কিংবা গাছের ছাল দিয়ে। এই ভেষজ উপকরণ ব্যবহার করেই সুতার নানা রঙ অর্থাৎ লাল, কাল নীল ও হলুদ করা হতো। তবে কালের বিবর্তনে নানা রঙের সুতা বাজারে মিলছে বলে পিনন হাদি তৈরি করা অনেকটা সহজ হয়ে গেছে। এছাড়া এখন আর তেমন কেউ কষ্ট করে কোমর তাঁতে কাপড় বুনছেনা। পার্বত্যাঞ্চলে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন তাঁত শিল্প। এখন চাকমা, তঞ্চঙ্গ্যা ও ত্রিপুরাদের বেশির ভাগ তাঁতের তৈরি পিনন হাদি বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। তবে কালের পরিবর্তনে বিলুপ্ত হচ্ছে - খিয়াং, খুমী, ম্রো, চাক, বম, পাংখোয়াদের পোশাক । সংরক্ষন অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে বেশিরভাগ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের ঐতিহ্য, পোশাক, কৃষ্টি ও সংষ্কৃতি বলে দাবি পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতির সভা নেত্রী জয়িতা চাকমার।

 

সম্পর্কিত খবর