ভেঙে পড়েছে চট্টগ্রাম নগরীর সড়ক ব্যবস্থা

ভেঙে পড়েছে চট্টগ্রাম নগরীর সড়ক ব্যবস্থা

নিজস্ব প্রতিবেদক

বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ব্যস্ততম সড়ক পোর্ট কানেক্টিং রোড। অতিরিক্ত যানবাহনের চাপে প্রায়ই যানজট লেগে থাকে এ সড়কে। তার ওপর কয়েক মাস ধরে চলছে সড়কটির উভয় পাশের ড্রেন উন্নয়নের কাজ। ড্রেনের উত্তোলন করা মাটি স্তূপ করে রাখা হয়েছে সড়কে।

এতে আরো বাধাগ্রস্ত হচ্ছে সড়কটিতে যানবাহন চলাচল।

বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতার কারণে এমনিতেই বেহাল নগরীর মুরাদপুর থেকে অক্সিজেন পর্যন্ত সাড়ে ৩ কিলোমিটার সড়ক। এর মধ্যেই ওয়াসার পাইপলাইন স্থাপনের জন্য সড়কটির দুই পাশে চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। এতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে সড়কটি ব্যবহারকারী পথচারী ও যানবাহনকে।

একই অবস্থা আগ্রাবাদ অ্যাকসেস রোড, কালুরঘাট-বহদ্দারহাট সড়ক ও শাহ আমানত সংযোগ সড়কেরও। এসব সড়কের কোনোটিতে চলছে সংস্কার ও উন্নয়ন, আবার কোনোটিতে ওয়াসার পাইপলাইন সংযোগের কাজ। এসব উন্নয়নকাজের ধীরগতি ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতার কারণে অনেকটা ভেঙে পড়েছে বন্দরনগরীর সড়ক ব্যবস্থা।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, পোর্ট কানেক্টিং সড়কের নয়াবাজার থেকে নিমতলা বিশ্বরোড পর্যন্ত দুটি প্রকল্পের আওতায় রাস্তা ও পাশের ড্রেনের উন্নয়নকাজ চলছে। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ড্রেনের মাটি তুলে রাস্তার পাশেই স্তূপ করছে। বৃষ্টিতে সেই মাটি ধুয়ে কাদায় একাকার হয়ে যাচ্ছে রাস্তা ও এর আশপাশ। বড়পুল থেকে মহেশখাল কালভার্ট পর্যন্ত এলাকার পূর্ব পাশের দোকানগুলোর বেশির ভাগই বন্ধ রাখতে হচ্ছে ড্রেনের উন্নয়নকাজের জন্য।

news24bd.tv

দুর্ভোগের শিকার স্থানীয় ব্যবসায়ী রাশেদুল হক বলেন, ব্যবসা করার মতো পরিবেশ না থাকায় দোকান বন্ধ রেখেছি ৪ মাস। এখন অন্যত্র দোকান খুঁজছি। তার মতো আরো অন্তত ১০ দোকানদার বড়পুল এলাকা থেকে অন্যত্র সরে যাওয়ার চেষ্টা করছেন বলে জানান তিনি।

নগরীর মুরাদপুর থেকে অক্সিজেন পর্যন্ত সাড়ে ৩ কিলোমিটার সড়ক ঘুরে দেখা যায়, ওয়াসার খোঁড়াখুঁড়ির কারণে সড়কের পুরোটাই ভাঙাচোরা। বেশির ভাগ সড়ক বিভাজকও তছনছ হয়ে গেছে।

পাইপ, ইট, বালি, রড, সিমেন্টসহ নানা নির্মাণসামগ্রী এলোমেলোভাবে পড়ে আছে সড়কের বিভিন্ন স্থানে। কিছুদূর পরপর বড় বড় গর্ত। সাড়ে ৩ কিলোমিটার এ সড়ক পাড়ি দিতে যেখানে ১০ মিনিট লাগার কথা, সেখানে এখন দিনের বেলায় লাগছে গড়ে এক-দেড় ঘণ্টা। রাতের অবস্থা অবর্ণনীয়।

স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. মোবারক আলী বলেন, ‘যথেষ্ট দুর্ভোগ নিয়ে এ সড়কে মানুষ যাতায়াত করছে। জলাবদ্ধতা ও বৃষ্টিতে সড়ক কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও যোগাযোগ উপযোগী ছিল। কিন্তু পাইপলাইন বসাতে ওয়াসার খোঁড়াখুঁড়ির কারণে সড়কটির অবস্থা এখন ভয়াবহ। ওয়াসার কাজের কারণে মানুষ দুর্ভোগের শিকার হলেও জনগণ গালাগাল করছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে। ’

নগরীর আরেক গুরুত্বপূর্ণ সড়ক আগ্রাবাদ-অ্যাকসেস রোডেও চলছে উন্নয়নকাজ। লাকী প্লাজা মোড় থেকে বড়পুলের দিকে যেতেই পুরো সড়কটির অবস্থা প্রায় নাজুক। রাস্তার দুই পাশে নতুন করে চলছে নালা নির্মাণের কাজ। কোথাও রাখা হয়েছে নালা থেকে তোলা মাটি, আবর্জনা, কোথাও বালি, পাথরসহ চলমান সংস্কারকাজের উপকরণ। বেপারিপাড়া মোড় থেকে শুরু করে মুহুরীপাড়া হয়ে বড়পুল পর্যন্ত সড়কটিতে এ বেহাল অবস্থা বিরাজ করছে। তবে সবচেয়ে ভোগান্তি বেশি বেপারিপাড়া মোড়ে। এখানে রাস্তার দুই পাশে চলছে নালা সংস্কারকাজ এবং একপাশে রাস্তা বন্ধ করে রাখা হয়েছে নির্মাণসামগ্রী।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্ষার আগেই শেষ হচ্ছে না আগ্রাবাদ-অ্যাকসেস রোডের উন্নয়নকাজ। প্রকল্পের জন্য আমদানি করা পাথর শুল্কায়ন জটিলতায় এক মাস ধরে খালাস করতে পারেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এতে নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। ফলে এ বছরের বর্ষায়ও দুর্ভোগ পোহাতে হবে নগরবাসীকে।

প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স রয়েল অ্যাসোসিয়েটসের স্বত্বাধিকারী মো. দিদারুল আলম বলেন, আমদানি করা পাথর খালাস নিয়ে ঝামেলা করছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। নিয়ম অনুযায়ী প্রকল্পের কাজের বিল থেকে সরকার ৭ শতাংশ ইনকাম ট্যাক্স ও ৬ শতাংশ ভ্যাট কেটে নেয়। ফলে সরকারি প্রকল্পের জন্য আমদানি করা পাথর শুল্কায়নে ভ্যাট দেয়ার কথা নয়। কিন্তু আমদানিকৃত পাথরে ভ্যাট দাবি করছে চট্টগ্রাম কাস্টমস ও শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ। এতে আমদানিকৃত পাথর গত ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রামে পৌঁছলেও এখনো খালাস নেয়া সম্ভব হয়নি। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর অসহযোগিতার কারণে চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ সড়কটির উন্নয়নকাজে বিলম্ব হচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি।

কালুরঘাট সেতু থেকে বহদ্দারহাট সংযোগ সড়কটি  ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ। উত্তর ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন এ সড়ক দিয়ে নগরীতে চলাচল করে। কিন্তু নিয়মিত সংস্কার না করায় সড়কটি এখন যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, সড়কটির বিভিন্ন অংশে কার্পেটিং উঠে গেছে, স্থানে স্থানে সৃষ্টি হয়েছে ছোট-বড় অসংখ্য গর্ত। অনেক স্থানে খানাখন্দে পানি জমে যানবাহন চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। বিভিন্ন পয়েন্টে প্রায় সময় লেগে থাকছে অসহনীয় যানজট। সংস্কারের অভাবে দুই লাইন সড়কটির এক লাইন দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে।

সড়কটির কালুরঘাট-বহদ্দারহাট পর্যন্ত পুরো সড়কই ভাঙাচোরা। এর মধ্যে কাপ্তাই রাস্তার মাথা, বাহির সিগন্যাল, সিঅ্যান্ডবি মোড়, পুরাতন চান্দগাঁও থানা, পাঠাইন্না গোদা, চান্দগাঁও বাস টার্মিনাল, বহদ্দারহাট, শুলকবহর ও মুরাদপুর মোড়ের অবস্থা খুবই করুণ। এসব স্থান দিয়ে যানবাহন চলাচল করছে চরম ঝুঁকি নিয়ে।

এক বছরের বেশি সময় ধরে উন্নয়নকাজ চলছে শাহ আমানত সেতু সংযোগ সড়কের। সড়কটি দক্ষিণ চট্টগ্রাম, বান্দরবান ও কক্সবাজারকে সংযুক্ত করেছে চট্টগ্রাম নগরীর সঙ্গে। কিন্তু উন্নয়নকাজ ধীরগতিতে চলায় যাতায়াতকারীদের নিত্য ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। কারণ খুবই সংকীর্ণ সড়ক দিয়ে যান চলাচল করতে হচ্ছে এখন। ফলে ভেঙে পড়েছে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা। বিশেষ করে বৃহস্পতি ও শুক্রবার যানজটে মানুষের অসহনীয় ভোগান্তিতে পড়তে হয়।

প্রকল্প ব্যবস্থাপক এবং দোহাজারী সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী তোফায়েল মিয়া বলেন, প্রকল্পের কাজ শুরু করতে একটু বিলম্ব হয়েছে। গত বছর বৃষ্টির কারণে কয়েক মাস কাজ বন্ধ ছিল। এখানে অনেক কালভার্ট ও সেতু ভেঙে নির্মাণ করতে হচ্ছে। পিডিবির বৈদ্যুতিক লাইন সরাতেও সময় লেগেছে। প্রকল্পের নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে কাজ পুরো শেষ না হলেও একটা পর্যায়ে যেতে পারব বলে আশা করছি।

চট্টগ্রাম নগরীর সড়ক ব্যবস্থার এ দশার জন্য উন্নয়নকাজে সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। এতে জনভোগান্তি যেমন হচ্ছে, তেমনি বন্দরনগরীর ব্যবসায়িক কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে বলে মনে করছেন তারা।

নগর পরিকল্পনাবিদ ও সাউদার্ন ইউনিভার্সিটির উপ-উপাচার্য প্রকৌশলী আলী আশরাফ এ প্রসঙ্গে বলেন, চট্টগ্রাম নগরীর সঙ্গে সংযুক্ত বেশির ভাগ সড়কের ভয়াবহ অবস্থা। উন্নয়ন-সংস্কারের নামে দীর্ঘদিন ধরে অকেজো হয়ে আছে গুরুত্বপূর্ণ এসব সড়ক। বাণিজ্যনগরীর সড়কগুলো এভাবে অভিভাবকহীন পড়ে থাকা পুরো অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বন্দর থেকে পণ্য খালাস করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছাতে সময় ও অর্থের অপচয় হচ্ছে। উন্নয়নকাজে সংশ্লিষ্ট সংস্থার সমন্বয় না থাকায় চট্টগ্রাম নগরীর সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা অকেজো হয়ে পড়েছে।

অরিন/নিউজ টোয়েন্টিফোর

সম্পর্কিত খবর