রমজানে ডায়াবেটিক রোগীর করণীয়

প্রতীকী ছবি

স্বাস্থ্য সংলাপ

রমজানে ডায়াবেটিক রোগীর করণীয়

নিউজ টোয়েন্টিফোর ডেস্ক

রমজান এলেই ডায়াবেটিক রোগীরা দুঃশ্চিন্তায় পড়ে যান। কীভাবে তারা রোজা রাখবেন, কীভাবে খাবেন, ওষুধ পরিবর্তন করতে হবে কিনা, ইনসুলিন কীভাবে নেবেন ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে ভাবনায় পড়েন। আসলেই রোজার সঙ্গে ডায়াবেটিক রোগীদের রসায়ানটা একটু আলাদা। নিয়ম না মানলে ঘটতে পারে প্রাণহানির মতো ঘটনা।

আবার নিয়ম মেনে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চললে সুস্থ দেহেই রোজা পালন সম্ভব। এ ব্যাপারে নিউজ টোয়েন্টিফোরের সরাসরি প্রশ্নোত্তরভিত্তিক স্বাস্থ্য বিষয়ক অনুষ্ঠান 'স্বাস্থ্য সংলাপ'- এ পরামর্শ ও দিক নির্দেশনা দিয়েছেন এ্যাপোলো হাসপাতালের কনসালটেন্ট ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আহসানুল হক আমিন এবং বারডেম হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ ডা. মো. ফিরোজ আমিন।

অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ডা. তানিয়া আলম।  

প্রশ্ন: রমজানে ডায়াবেটিক রোগীরা কী ধরণের সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যান।

ডা. ফিরোজ: যারা রোজা রাখতে চান, তারা রমজানের দুই-তিন মাস আগে চিকিৎসকের কাছে এসে পরীক্ষা করানো উচিত। তিনি রোজার জন্য উপযুক্ত কিনা সেটা যাচাই করে যদি ওষুধ বদলানোর দরকার পড়ে, সেটা করে রোজা রাখতে হবে। কিন্তু, বাস্তবতা হলো বাংলাদেশে ৭০-৮০ ভাগ রোগী কখনোই ওইভাবে আসেন না। কিছু রোগী সপ্তাহখানেক আগে এসে বলেন তিনি রোজা রাখতে চান। তখন বিষয়টা একটু জটিল হয়ে যায়।

অন্যসময় আমরা দিনে খাই, রাতে ঘুমাই। রোজার সময় দেখা যায় ১০ ঘণ্টা খাই, ১৪ ঘণ্টা না খেয়ে থাকি। এই দীর্ঘ সময় না খাওয়ার জন্য অনেকের সুগার বেশি কমে যায়। কেউ কেউ ভাবেন রমজানে বেশি খাওয়া যাবে। তারা বেশি খেয়ে ফেলেন। ফলে সুগার বেড়ে যায়। তখন আমাদের কাছে আসেন। এমন পরিস্থিতিতে রোগীকে স্বাভাবিক অবস্থায় আনা জটিল হয়ে যায়।

প্রশ্ন: ডায়াবেটিক রোগীদের রোজা রাখায় কোন বিধি-নিষেধ আছে কিনা?
ডা. আহসানুল হক: কিছু নিষেধাজ্ঞা তো অবশ্যই আছে। আমাদের দেখতে হয় তার ডায়াবেটিসের ওপর ভালো নিয়ন্ত্রণ আছে কিনা। এছাড়া অন্যান্য অসুখ-বিসুখ আছে কিনা। যেমন: হার্টের সমস্যা, কিডনির সমস্যা। এগুলো নিয়ন্ত্রণে না থাকলে রোজা না রাখাই ভালো। যার রোজা শুরুর কিছু দিন আগেও হাইপোগ্লাইসোমিয়া (সুগার কমে যাওয়া) হয়েছে এবং বারে বারে এটা হচ্ছে, এমন রোগীর রোজা রাখা ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়া গর্ভবতী মায়েরা খুব ভালো অবস্থায় না থাকলে আমরা রোজা রাখার পরামর্শ দেই না। এই বিষয়গুলো রোজার কয়েক মাস আগে যাচাই করে ঠিক করে নেওয়া দরকার।

প্রশ্ন: রোজা আসলে ইনসুলিন বন্ধ করে ওষুধ শুরু করা যাবে কিনা?
ডা. ফিরোজ: কারও শরীরে যখন ইনসুলিন তৈরি করার ক্ষমতা কমে যায় তখনই ইনসুলিন দেওয়া হয়। প্রয়োজন না হলে দেওয়া হয় না। যে ট্যাবলেটগুলো আমরা দেই তা কখনো ইনসুলিন তৈরি করে না। লেবু চাপ দিলে রস বের হয়, কিন্তু লেবুতে রস না থাকলে হাজার চাপ দিলেও রস বের হবে না। ট্যাবলেট ইনসুলিন তৈরি করে না। তারা লেবুর মতো করে চাপ দিয়ে শরীর থেকে ইনসুলিন বের করে। যাচাই না করে রোগীর কথায় যদি ইনসুলিন বন্ধ করে আমরা ট্যাবলেট দেই, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় ওই রোগী কিছুদিনের মধ্যেই হাই সুগার নিয়ে কোন না কোন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। দেখা যায় বেচারা আর রোজাই রাখতে পারলো না। এজন্য তিন-চার মাস আগে আসলে হয়ত ইনসুলিন বন্ধ করে কিছুদিন পর্যবেক্ষণে রেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়।

প্রশ্ন: রোজার সময় ডায়াবেটিক রোগীর ব্যায়াম বা হাঁটাহাঁটির ব্যাপারে কী পরামর্শ?
ডা. আহসানুল হক: রোজা রাখা অবস্থায় দিনের বেলায় ব্যায়াম বা হাঁটাহাঁটি করা যাবে না। তারাবি পড়লে বাড়তি ব্যায়ামের দরকার নেই। অনেকের না হাঁটলে ভালো লাগে না। তারা ইফতারির পরে হাঁটতে পারবেন। অনেকে বেশি পরিমান ইফতার করেন, আবার সেহরিতে খান। এটা শরীরের জন্য ভালো না। রোজা ছাড়া তিন বার খাই। রোজার সময়ও ক্যালরিটা ওইভাবে ভাগ করে খাওয়া উচিত।

প্রশ্ন: রোগী কীভাবে বুঝবে তার সুগার বা শর্করা কমে গেছে?
ডা. ফিরোজ: দুইটা পদ্ধতি। এক. লক্ষণ, দুই. সুগার পরীক্ষা করা। ইসলামি চিন্তাবিদরা ফতোয়া দিয়েছেন, রোজার সময় সুগার পরীক্ষা করলে রোজা ভাঙবে না। যখনই দেখবেন খারাপ লাগছে, দুর্বল লাগছে, শরীর ঘামছে, ক্ষুধা লাগছে, হাত-পা কাঁপছে, মেজাজ খারাপ লাগছে তখনই সুগারটা পরীক্ষা করবেন। ৫ এর নিচে দেখলে রোজা ভেঙে ফেলবেন।

প্রশ্ন: অনেকে ওষুধ খান। ওষুধ খাওয়ার সময়েরও পার্থক্য আছে। তারা কী করবে?
ডা. ফিরোজ: কিছু ট্যাবলেট আছে শরীর থেকে ইনসুলিন বের করে। কিছু ট্যাবলেট আছে ইনসুলিন প্রক্রিয়াকে কর্মক্ষম রাখতে সাহায্য করে। যেমন একজন রোগী শুধু মেটফরমিন খাচ্ছে বা ভিলডাগ্লিপটিন খাচ্ছে বা সিটাগ্লিপটিন খাচ্ছে, এই ধরণের ওষুধে হাইপো হওয়ার সুযোগ নেই। অর্থাৎ, রক্তে শর্করার পরিমান কমে যাবে না। কিন্তু, এর সঙ্গে যদি আরেকটা সালফোনেরিয়া গ্রুপ যেমন গ্লিমিপিরাইড জাতীয় কোন ওষুধ যোগ হয় তখন হাইপো হওয়ার সুযোগ থাকে। এজন্য যে ওষুধটা রক্তে শর্করা কমিয়ে দিতে পারে সেটা আমরা ইফতারির সময় খাওয়ার কথা বলি। পানি দিয়ে রোজা ভেঙে ওষুধ খেয়ে ইফতার করবে। যদি দুই বেলা ওষুধ খেতে হয় তখন সেহরিতে ডোজ কমিয়ে দেই। কারণ, সারাদিন না খেয়ে থাকলে এমনিতেই সুগার লেবেল কম থাকবে।  

দর্শকের প্রশ্ন: আমার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আছে, তবে কিডনিতে সমস্যা, রোজা রাখতে পারবো?
ডা. ফিরোজ: কিডনির রোগীকে নানা ওষুধ খেতে হয়। এ ধরণের রোগী যদি রোজা রাখেন এবং লম্বা একটা সময় না খেয়ে থাকেন, পানি শূন্যতার সুযোগ থাকে, তখন তার কিডনি অকার্যকর হয়ে পড়ার একটা আশঙ্কা থাকে। আমরা রোজা রাখতে নিষেধ করতে পারি না। তবে এ ধরণের রোগী অনেক ঝুঁকিপূর্ণ।

প্রশ্ন: ইফতারে খেজুর, জিলাপি খাওয়ায় ঝুঁকি কতটা?
ডা. আহসানুল হক: খেজুর আমাদের ইফতারের একটা অংশ। এটা খাওয়া সুন্নত। একটা খেজুর দিয়ে সুন্নত পালন করা যায়। এর বিভিন্ন উপাদান শরীরের জন্য প্রয়োজনও। তবে জিলাপি না খাওয়া ভাল।

প্রশ্ন: ডায়াবেটিক রোগী অন্তঃসত্ত্বা হলে তার রোজা রাখার ক্ষেত্রে পরামর্শ কী?
ডা. ফিরোজ: অন্তঃসত্ত্বা নারীর নিজের জন্যও শক্তির প্রয়োজন আছে, শিশুটির জন্যও শক্তির প্রয়োজন আছে। আপনাকে দেখতে হবে আপনার সুস্থতা এবং বাচ্চার সুস্থতা। খাদ্য চাহিদা পূরণ না হলে মা-বাচ্চা উভয়ই দুর্বল বোধ করবে। শিশুর বৃদ্ধি ঠিকমতো হবে না। আরও কিছু সমস্যা তৈরি হতে পারে। ডায়াবেটিক রোগীরা লম্বা সময় না খেয়ে থাকলে কিছু জটিলতা তৈরি হতে পারে। এটা একটা ধর্মীয় ব্যাপার। আমরা তাদেরকে রোজা রাখতে নিষেধ করতে পারি না। বোঝানোর চেষ্টা করি। আল্লাহ রোজা রাখতে বলেছেন, আবার অসুস্থ হলে না রাখতেও বলেছেন। গর্ভবতী হলে রোজা না রাখার ক্ষেত্রে ধর্মীয় একটা অনুমতিও আছে, আলেম-ওলামারা বলে থাকেন। আপনি তো পরেও রাখতে পারবেন। গর্ভকালীন সময়ে ডায়াবেটিক রোগীর রক্তে শর্করা খালি পেটেই রাখতে চাই ৫ এর নিচে। দুপুরে এবং রাতে খাওয়ার পর ৬দশমিক ৭ এর নিচে রাখতে চাই। এমন কন্ট্রোল যদি রোজা রাখা অবস্থায় রাখতে চাই ৭০-৮০ ভাগ রোগীর হাইপো (রক্তে শর্করা কমে যাওয়া) হবে। গর্ভবতী ডায়াবেটিক রোগীর শর্করা কঠোর নিয়ন্ত্রণে না রাখলে বাচ্চার গ্রোথ অস্বাভাবিক বড় হয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে নানা জটিলতা তৈরি হতে পারে।

প্রশ্ন: রোজার দুই-তিন মাস আগে কেন চিকিৎসকের কাছে যেতে হয়?

ডা. ফিরোজ: এসময় আমরা রোগীর ব্লাড সুগারটা দেখি। শুধু সকাল-বিকাল না, সারাদিনেরটা দেখি। যদি মেশিন থাকে, বাসাতেই ৫-৬ বার পরীক্ষা করে রিপোর্টটা নিয়ে আসবে। কিডনি লেবেলটা দেখি। ইলেক্ট্রোলাইট দেখি। অনেক ওষুধ আছে যেগুলো খেলে লবন পানি কমে যেতে পারে। এমন কোন তারতম্য আছে কিনা সেটা দেখি। হিমোগ্লোবিন লেবেলটা দেখি। কিছু কিছু ওষুধ লিভারের এনজাইমটা বাড়িয়ে দিতে পারে, সেটা দেখি। ইউরিনে কোন ইনফেকশন আছে কিনা, অ্যালবুমিন যাচ্ছে কিনা, আবার অ্যালবুমিন বেশি যাওয়ার কারণে রক্তে অ্যালবুমিন কমে গেলে শরীরটা ফুলে যায় কিনা- এগুলো আমরা দেখি। অামেরিকান ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশনের সুপারিশ আছে যে, প্রত্যেক ডায়াবেটিক রোগীর ছয় মাস পর পর, অন্তত বছরে একবার হলেও এই সকল পরীক্ষা করাতে হবে।  

প্রশ্ন: নতুন ডায়াবেটিক রোগীদের ক্ষেত্রে কী পরামর্শ দেন?

ডা. আহসানুল হক: ডায়াবেটিস 'ডি' দিয়ে শুরু, চিকিৎসাও তিনটা 'ডি'। ডায়েট, ডিসিপ্লিন, ড্রাগ। কীভাবে খাবার নিয়ন্ত্রণ করবেন, ব্যায়াম করবেন সেগুলো বুঝিয়ে বলি। ডায়াবেটিসের অনেক ধরণের ওষুধ আছে। কিছু ওষুধ ইনসুলিন নিঃসরণে কাজ করে, কিছু ওষুধ শরীরের ভেতরে থাকা ইনসুলিনকে কাজ করায়। প্রথম অবস্থায় রোগীর শরীরে থাকা ইনসুলিনকে কাজ করায় এমন ওষুধ দেই।

প্রশ্ন: নতুন এক ধরণের মেশিন এসেছে শরীরে লাগিয়ে রাখা হয়। এটা আসলে কী?
ডা: ফিরোজ: ইনসুলিন পাম্প। একটা সময় এটার অনেক দাম ছিল। ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশন সরকারের সঙ্গে কথা বলে ট্যাক্স কমানোর পর এখন দেড় থেকে দুই লাখ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়। এটাতে সুবিধা-অসুবিধা দুটোই আছে। শিক্ষিত না হলে, প্রযুক্তি সম্পর্কে জ্ঞান না থাকলে তাদের জন্য এটা সমস্যা। কারণ, চালাতে পারবে না। আবার প্রযুক্তি জ্ঞান থাকলে এটা অত্যন্ত ভালো একটা যন্ত্র। শরীরে একটা পাম্প লাগানো থাকে। একটা সুই দিয়ে সবসময় ইনসুলিন চলতে থাকে। একটা মানুষের দুই ধরণের ইনসুলিন দরকার পড়ে। একটা খালি পেটে ডায়াবেটিস কমানোর জন্য, আরেকটা খাওয়ার পরে কমানোর জন্য। এই পাম্প দিয়ে সার্বক্ষণিক একটা পরিমান ইনসুলিন শরীরে যেতে থাকে। যখন কোন কিছু খাওয়ার দরকার পড়ে তখন এক ইউনিট ইনসুলিন চাপ দিয়ে নিয়ে নেবে। বেশি চিনিযুক্ত কোন খাবার খেতে হলে একবারে দুই ইউনিট ইনসুলিন নিয়ে নিল। ফলে কোথাও গিয়ে খাওয়া নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করার দরকার পড়ে না। একটু বেশি টাকা খরচ করলে রিমোট দিয়েও ইনসুলিনের পরিমান নির্ধারণ করে নিয়ে নেওয়া যায়।

ডা. আহসানুল হক: আসলে এই পাম্প ডায়াবেটিক রোগীদের জীবনযাপন অনেক সহজ করে দিয়েছে। এটা শুনতে অনেক কঠিন কিছু মনে হতে পারে। কিন্তু, এটা খুবই ইউজার ফ্রেন্ডলি।

প্রশ্ন: এই রোজায় ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য শেষ পরামর্শ কী?
ডা. ফিরোজ: যেসব খাবার হঠাৎ সুগার বাড়িয়ে দেয়, যেমন- শরবত, জিলাপি সেগুলো ইফতারে খাবেন না। তারাবিতে যাওয়ার আগে কিছু খেয়ে নিবেন। তারাবি লম্বা সময়। ওখানে আবার হাইপো হয়ে যেতে পারে। প্রচুর পানি খেতে হবে। সেহরিতে শেষ সময়ে খাবে।

সম্পর্কিত খবর