রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে শেখ হাসিনার ভূমিকা সর্বমহলে প্রশংসিত

প্রতীকী ছবি

রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে শেখ হাসিনার ভূমিকা সর্বমহলে প্রশংসিত

অনলাইন প্রতিবেদক

রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূমিকা প্রশংসিত হচ্ছে সর্বত্র। এবার সংকট তৈরির পর এর স্থায়ী সমাধানে বিশ্বব্যাপী বাস্তবমুখী ভূমিকা নিয়েছেন তিনি নিজেই। এ ব্যাপারে জাতিসংঘকে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। একইসঙ্গে মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে সহিংসতার মুখে জীবন বাঁচাতে দেশ ছেড়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের দিয়েছেন আশ্রয়।

মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক মহলের চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে নিয়েছেন চতুর্মুখী পদক্ষেপ। প্রধানমন্ত্রীর এসব উদ্যোগ বিশ্ব গণমাধ্যমেও প্রশংসিত হচ্ছে। নোবেলজয়ী মালালা ইউসুফজাই রোহিঙ্গা ইস্যু তুলে ধরে বাংলাদেশের কাছ থেকে পাকিস্তানকে শিক্ষা নিতে বলেছেন।  

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুটি একইসঙ্গে ভৌগলিক সার্বভৌমত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত, অন্যদিকে মানবিকও।

মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর নির্বিচার হামলা ও নির্যাতনে গত ২ আগস্টের পর অন্তত ৯৫ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। আইওএম’র তথ্যমতে এ সংখ্যা ১ লাখ ২৬ হাজারের ওপরে। এছাড়া সীমান্তে অপেক্ষা করছে আরও লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। গত বছরও মিয়ানমারে সহিংসতার সময় বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে আনুমানিক ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা। সেখানে তাদের হত্যা করা হচ্ছে, ধর্ষণ করা হচ্ছে, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। তারা প্রাণ বাঁচাতে নিজ দেশ ছেড়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এদের নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছেন। আবার শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতিতে তাদেরকে নিজ দেশে প্রত্যাবাসনের মাধ্যমে দীর্ঘদিনের সমস্যাটির স্থায়ী সমাধানে আন্তর্জাতিক মহলে কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছেন। এজন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনাও দিয়েছেন।  

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে এবার চতুর্মুখী কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। এরমধ্যে আছে সরাসরি মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক পর্যায়ে কূটনৈতিক আলোচনা। এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রের সহায়তা পেতে কূটনৈতিক উদ্যোগ। জাতিসংঘ, ইইউ, ওআইসি, আসিয়ানসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে বহুপাক্ষিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা। ঢাকাস্থ সকল কূটনৈতিক মিশন ও আন্তর্জাতিক সংস্থাকে নিয়মিত ব্রিফিং প্রদান। বিদেশে বাংলাদেশ মিশনে নিয়মিত ব্রিফিং নোট পাঠানো। এছাড়া বিবিসি, সিএনএস, আল জাজিরা, গার্ডিয়ানসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে সঠিক তথ্য তুলে ধরতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ।  

এদিকে রোহিঙ্গাদের ত্রাণ সহায়তা দিতে আজ বৃহস্পতিবার ঢাকায় এসেছেন তুরস্কের ফার্স্ট লেডি এমিনি এরদোয়ান। এর আগে গত শুক্রবার রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়িপ এরদোয়ান। তিনি একে গণহত্যা বলেও উল্লেখ করেন। এর আগের দিন তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদকে ফোন করে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ের ব্যাপারে বাংলাদেশকে সহায়তার অঙ্গীকার করেন। এ ছাড়া তিনি মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চিকেও হুঁশিয়ার করেন।

বিশেষজ্ঞদের মতে একটা মুসলিম দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যে দায়িত্ব পালন করার কথা শেখ হাসিনা তাই করছেন। দুঃসময়ে আর্তমানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দিকে। তাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছেন, নিরীহ জনগোষ্ঠীর ওপর বর্বর হামলা বন্ধ করতে বিশ্ব জনমতও তৈরির প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন।  

এ ব্যাপারে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশিদ বলেন, নিজ দেশ মিয়ানমারে হত্যা, নির্যাতনের শিকার হয়ে রোহিঙ্গারা এখন বাংলাদেশে স্রোতের মতো ঢুকছে। এত মানুষের বাসস্থান, ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করা আমাদের জন্য দুস্কর। এছাড়া এতে নানা ধরণের ঝুঁকি রয়েছে। অর্থনৈতিক ঝুঁকি, সামাজিক নিরাপত্তার ঝুঁকি, অপরাধ বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এখানে মানবিক দিকটিও গুরুত্বপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রী তাদেরকে আশ্রয় দেওয়ায় বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিই শুধু উজ্জ্বল হয়নি, হাজারো নিরীহ মানুষ প্রাণে বেঁচেছে। বিশ্বের অনেক দেশ ও সংস্থা বাংলাদেশের এই উদ্যোগের প্রশংসা করেছে। ইতোমধ্যে কিছু দেশ এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সহযোগিতার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে।

তিনি বলেন, বিষয়টা সমাধানে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও প্রভাবশালী দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। রোহিঙ্গাদের কারণে যাতে দুই দেশের সম্পর্কে অবনতি না হয়, তাই মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বজায় রেখেই বিষয়টা সমাধানের চেষ্টা করছে। এগুলো প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শিতা। ইতোমধ্যে আমেরিকা রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিবৃতি দিয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমার সফর করেছেন। মিয়ানমারের অন্যতম সমর্থক চীনও তাদের সুর নমণীয় করেছে। আন্তর্জাতিক চাপ বাড়লে মিয়ানমারও নমণীয় হবে। আগে মিয়ানমার রোহিঙ্গা ইস্যুতে কারও সঙ্গে আলোচনায়ই রাজি ছিল না। এখন তারা আলোচনায় রাজি হচ্ছে। এজন্য কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে সঠিক তথ্য তুলে ধরার ব্যবস্থা করতে হবে। একইসঙ্গে যতদিন রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে প্রত্যাবাসন করা না যায় ততদিন কীভাবে নিরাপত্তার ঝুঁকিগুলো কমানো যায় সেই কৌশল নির্ধারণ করতে হবে।

অপরদিকে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার বলেন, ৪০ বছর ধরে রোহিঙ্গারা আমাদের ওপর বোঝা হয়ে আছে। তারা আমাদের নিরাপত্তার জন্য বিষফোড়া। হত্যা, নির্যাতনের মুখে তারা বছর বছর বাংলাদেশে পাড়ি দিচ্ছে। সর্বশেষ সহিংসতার ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী সংকট সমাধানে ভারসাম্যপূর্ণ যে উদ্যোগ নিয়েছেন তা প্রশংসণীয়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনকে নানা কৌশলে বোঝানোর চেষ্টা করছেন। একদিকে সীমান্তে বিজিবি রোহিঙ্গাদের বাধা দিয়ে আন্তর্জাতিক মহলকে বার্তা দিচ্ছে ‘রোহিঙ্গারা আমাদের জন্য বোঝা। তাদেরকে নিজ দেশে জায়গা করে দেওয়া হোক। ’ অন্যদিকে যারা ঢুকছে তাদেরকে আশ্রয় দিয়ে মানবিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হচ্ছে। এতে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হচ্ছে। ইন্দোনেশিয়া, তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে। তারা সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। সরকার যেভাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিষয়টা তুলে ধরছে তাতে ভবিষ্যতে আরও অনেকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে।

তবে এ ক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে বলে মনে করেন সাবেক এ সেনা কর্মকর্তা। তিনি বলেন, বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে ’৭১ এর পর থেকেই দেশি-বিদেশি একটা চক্র সক্রিয়। তারা চাইবে রোহিঙ্গা ইস্যুটিকে জিইয়ে রাখতে। বিষয়টা মাথায় রাখতে হবে। সাহায্যের ছদ্মবেশে কেউ যাতে সন্ত্রাসে মদদ দিতে না পারে সেদিকে নজর রাখতে হবে। তিনি বলেন, ক্ষমতাধর অনেক রাষ্ট্র এখনো রোহিঙ্গা ইস্যুতে মুখ খুলছে না। এখানে ভূরাজনৈতিক স্বার্থ জড়িত। তবে বিষয়টা বেশি করে আন্তর্জাতিক ফোরামে আলোচনার ব্যবস্থা করতে পারলে অনেকেই কথা বলতে বাধ্য হবে।

এদিকে তিন দশকের বেশি সময় ধরে প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশের আশ্রয় ও মানবিক সহায়তা প্রদানের বিষয়টি ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সকল সদস্য আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের প্রশংসা করেছে। বর্তমানেও বিশ্ব গণমাধ্যমে উঠে আসছে বাংলাদেশের মহানুভবতার দৃষ্টান্ত। সাধুবাদ জানাচ্ছে বিশ্ব নেতৃত্ব। রোহিঙ্গা নিধনকে গণহত্যা বলে দাবি করে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বলেছেন, যেসব দেশ গণতন্ত্রের দুয়া তুলে এ গণহত্যা দেখেও দেখছে না তারাও মিয়ানমারের এ গণহত্যায় ইন্ধন দিচ্ছে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ায় তিনি বাংলাদেশের প্রশংসা করেন এবং প্রয়োজনে তুরস্ক বাংলাদেশে ত্রাণ সহায়তা পাঠাবে বলে জানান।

মিয়ানমারে সহিংসতার মধ্যে সম্প্রতি রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে দেশটির সরকারের সঙ্গে আলোচনার পর ঢাকায় আসেন ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেনটো মারসুদি। তিনি রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশের প্রশংসা করে বলেন, ‘‘আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও বলেছি, আমরা বাংলাদেশের পাশে থাকব। তবে আমাদের সংকট সমাধানের উপায় খুঁজতে হবে। রোহিঙ্গাদের উপর এই অমানবিক নির্যাতনের অবসান হতে হবে। ''

এদিকে মিয়ানমারে দমন-পীড়নের মুখে যে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে, কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালিতে বনবিভাগের ৫০ একর জমিতে তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করেছে জেলা প্রশাসন। কয়েকদিনে উখিয়ার কুতুপালং থেকে থাইংখালী পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে পাহাড়ে পাহাড়ে গড়ে বাঁশ আর পলিথিনের অসংখ্য ঝুপড়ি গড়ে তুলেছে রোহিঙ্গারা। রোহিঙ্গাদের নতুন বসতি দেখা গেছে টেকনাফ সীমান্তবর্তী হোয়াইক্যং ইউনিয়নসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকাতেও।

ডয়চে ভেলে এক প্রতিবেদনে বলেছে, মিয়ানমারে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গারা হত্যা, ধর্ষণ, সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের সাত শতাধিক বাড়ি। রোহিঙ্গারা আশ্রয়ের জন্য বাংলাদেশে ছুটে আসছেন। বাংলাদেশ তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছে। একইসঙ্গে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের বিষয়টি আরো জোরালোভাবে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক ফোরামে তুলে ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাংলাদেশে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে এক সপ্তাহের মধ্যে দু'বার ডেকে পাঠানো হয়েছে। রোহিঙ্গাদের প্রবেশে বিজিবি কড়াকড়ি আরোপ করলেও, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের প্রতি মানবিক আচরণের নির্দেশ দিয়েছেন।
 

সম্পর্কিত খবর