বাংলাদেশে পাওয়া অমিক্রনের নতুন উপধরন কতটা শক্তিশালী

সংগৃহীত ছবি

বাংলাদেশে পাওয়া অমিক্রনের নতুন উপধরন কতটা শক্তিশালী

অনলাইন ডেস্ক

যশোরে দুই ব্যক্তির শরীরে করোনার অমিক্রন ধরনের যে দুই উপধরন প্রথম পাওয়া গেছে, তা ব্যাপক মাত্রায় সংক্রমণ ছড়ানোর ক্ষমতা রাখে। দেশে এখন যে ব্যাপক হারে করোনা ছড়াচ্ছে, তার পেছনে এই দুই উপধরন দায়ী বলে মনে করছেন মহামারি বিশেষজ্ঞ ও ভাইরাসবিদেরা। তাঁরা বলছেন, আগে করোনা হয়ে যাওয়া ব্যক্তি বা টিকা নেওয়া ব্যক্তির শরীরের সৃষ্টি হওয়া অ্যান্টিবডিকে এই উপধরন ফাঁকি দিতেও সক্ষম। তবে এরপরও টিকা এখানে একটি সুরক্ষার কাজ করবে।

আর মাস্ক পরাসহ করোনাবিধি মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই।

উপধরন কী, অমিক্রনের নতুন উপধরন
ভাইরাসের বৈশিষ্ট্যই হলো এর প্রতিনিয়ত নতুন রূপ লাভ হয় এবং মিউটেশন হয়। আর এভাবে নতুন নতুন রূপ ধারণ করে। ভাইরাসের মূল বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ন রেখে এর শাখা-প্রশাখা বিস্তার হলো সাবভেরিয়েন্ট বা উপধরন।

বাংলাদেশে গত বছরের ডিসেম্বরে অমিক্রন ধরন শনাক্ত হয়। দেশে প্রথম অমিক্রনে সংক্রমিত হন জিম্বাবুয়েফেরত বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের দুই সদস্য। গত বছরের ৯ ডিসেম্বর দেশে প্রথম অমিক্রনে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার খবর জানা যায়।  

এরপর দেশে এর ব্যাপক বিস্তার ঘটে। গত ফেব্রুয়ারি থেকে করোনা শনাক্তের সংখ্যা কমে আসতে থাকে। গত ২৫ মার্চ থেকে ১২ জুন পর্যন্ত দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১০০-এর নিচেই ছিল। এরপর প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে। এর মধ্যে গত মঙ্গলবার যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) জিনোম সেন্টারে দুই ব্যক্তি অমিক্রনের নতুন উপধরনে (বিএ৪/৫) আক্রান্ত বলে শনাক্ত করা হয়। ওই দিন যবিপ্রবি এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, জিনোম সেন্টারের একদল গবেষক ওই দুই ব্যক্তির কাছ থেকে নেওয়া নমুনার জিননকশা (জিনোম সিকুয়েন্স) বিশ্লেষণ করে করোনার নতুন এই উপধরন শনাক্ত করেন।

বিএ৪ এবং বিএ৫ দুটি ভিন্ন উপধরন। যশোরে এ দুটির মধ্যে ঠিক কোনটিতে দুজন আক্রান্ত হয়েছেন, তা এখনো নির্দিষ্ট করা যায়নি—শনাক্তের চেষ্টা চলছে বলেন যবিপ্রবির অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও জিনোম সেন্টারের সহযোগী পরিচালক ইকবাল কবীর।

যশোরে দুজনের দেহে উপধরন শনাক্ত হলো যেভাবে
যশোরে দুজন করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে অমিক্রনের নতুন উপধরনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। যবিপ্রবির গবেষক দল জানায়, আক্রান্ত দুজনের মধ্যে একজনের বয়স ৪৪, আরেকজনের বয়স ৭৯ বছর। তাঁদের মধ্যে একজন করোনার বুস্টার ডোজের টিকা এবং অন্যজন দুই ডোজ টিকা নিয়েছেন। আক্রান্ত ব্যক্তিদের শরীরে জ্বর, গলাব্যথা, সর্দি-কাশিসহ বিভিন্ন মৃদু উপসর্গ রয়েছে। তাঁরা দুজনই স্থানীয়ভাবে সংক্রমিত হয়েছেন বলে গবেষকেরা ধারণা করছেন।

যবিপ্রবির অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও জিনোম সেন্টারের সহযোগী পরিচালক ইকবাল কবীর বলেন, দুজনের মধ্যে সত্তরোর্ধ্ব ব্যক্তির চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে যাওয়ার রেকর্ড আছে। আরেক ব্যক্তি কয়েক দিন আগে কক্সবাজারে গিয়েছিলেন। দুজনের মধ্যে একজনের বাড়িতে তিন মাস আগে কুয়েত থেকে এক আত্মীয় এসেছিলেন। তবে তাঁর মাধ্যমে ছড়ানোর কোনো কারণ নেই। এই দুজনের কারোরই ভারতে যাওয়ার নিকট কোনো ইতিহাসও নেই।

বিএ৪ এবং বিএ৫-এর বৈশিষ্ট্য কী
মহামারি বিশেষজ্ঞ ও ভাইরাসবিদেরা বলছেন, বিএ৪ এবং বিএ৫ দ্রুতগতিতে সংক্রমণ ঘটায়। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, এই দুই উপধরনের বিস্তার ঘটে দ্রুতগতিতে। বিশ্বের একাধিক দেশে এটি এখন ব্যাপক হারে সংক্রমণ ঘটাচ্ছে। মহামারি বিশেষজ্ঞ মুশতাক হোসেন বলেন, উত্তর কোরিয়া, চীনের সাংহাই, যুক্তরাষ্ট্রসহ নানা দেশে এর বিস্তারে ব্যাপক হারে করোনা ছড়িয়েছে। এখন যুক্তরাষ্ট্রেও এই দুই উপধরনের প্রভাবে সংক্রমণ বাড়ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের গত মঙ্গলবার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত সপ্তাহে মোট সংক্রমণের ৩৫ শতাংশই ঘটেছে বিএ৪ এবং বিএ৫ উপধরনের প্রভাবে। এর আগের সপ্তাহে মোট শনাক্তের ২৯ শতাংশ ছিল এই দুই উপধরনে।

ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের বৃহস্পতিবার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই দুই উপধরনের যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে প্রাধান্য বিস্তার করবে।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রথম জিনরহস্য উন্মোচনের কাজে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (সিএইচআরএফ) অণুজীববিজ্ঞানী সেঁজুতি সাহা। তিনি এই দুই উপধরন নিয়ে বললেন, দুটি উপধরন মারাত্মক রকমের সংক্রামক। আর এরা শরীরে সৃষ্ট অ্যান্টিবডিকে ফাঁকি দিতে সক্ষম। এই ক্ষমতার জন্য ইতিমধ্যে অ্যান্টিবডি থাকা ব্যক্তিও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন।
মুশতাক হোসেনের মন্তব্য হলো, এই দুই উপধরনের সংক্রমণের গতি দ্রুত হলেও, অমিক্রনের মতোই বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করে না।

বিএ৪ এবং বিএ৫ নিয়ে গবেষণা
বিএ৪ এবং বিএ৫ উপধরনটি করোনায় আক্রান্ত হয়ে এবং টিকা ও বুস্টার ডোজ নেওয়া ব্যক্তির শরীরে সৃষ্টি হওয়া অ্যান্টিবডিকে ফাঁকি দিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের বেথ ইসরায়েল ডিকোনেস মেডিকেল সেন্টারের এক গবেষণায় এ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে বুধবার এটি প্রকাশিত হয়। তবে সেখানে বলা হয়, করোনার টিকা এরপরও মারাত্মক পরিস্থিতি হওয়া থেকে সুরক্ষা দিতে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।  

দেশে কেন এবারের সংক্রমণ, কত দিন চলতে পারে
দেশে ২০২০ সালের ৮ মার্চ প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়। করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ১৮ মার্চ। ডা. মুশতাক হোসেন মনে করেন, চলতি মাসে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধির যে প্রবণতা দেখা দিয়েছে, এটি পঞ্চম ঢেউ। তাঁর হিসাবে, প্রথম ঢেউ ছিল ২০২০ সালের মার্চ থেকে আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত। দ্বিতীয় ঢেউটি শুরু হয় ২০২১-এর ফেব্রুয়ারিতে। এটি করোনার আলফা ধরন দিয়ে শুরু হয়ে বিটা দিয়ে শেষ হয়। করোনার ডেলটা ধরন দিয়ে তৃতীয় ঢেউয়ের শুরু হয়েছিল ২০২১ সালের এপ্রিল মাস থেকে, এটি চলে জুলাই। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে চতুর্থ ঢেউ অমিক্রন ধরন দিয়ে শুরু হয়। এটি চলে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। আর চলতি জুন মাসে শুরু হয়েছে পঞ্চম ঢেউ।

এ পর্যন্ত দেশে করোনায় সর্বোচ্চ সংক্রমণ হয় গত বছরের জুলাই মাসে। সে সময় এক দিনে আক্রান্তের সংখ্যা ১৬ হাজার অতিক্রম করেছিল।

মুশতাক হোসেন মনে করেন, এই পঞ্চম ঢেউয়ে সংক্রমণ গত বছরের জুলাই মাসের কাছাকাছি চলে যেতে পারে। তবে আগামী দেড় সপ্তাহের মধ্যে সংক্রমণ কমতে পারে।
চতুর্থ ঢেউ থেকে মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার কারণ প্রসঙ্গে মুশতাক হোসেনর বক্তব্য, ‘আমাদের টিকা নেওয়া জনগোষ্ঠীর সংখ্যা যথেষ্ট থাকলেও, স্বাস্থ্যবিধির বিষয়টি উপেক্ষিত ছিল। এর কারণেই আমরা টিকা নিয়েও বেশি সময় ধরে সংক্রমণের ধীরগতি বজায় রাখতে পারিনি। ’

news24bd.tv/arif