দারিদ্র্যের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসছে বাংলাদেশ

সংগৃহীত ছবি

ফরেন পলিসিনিউজে সজীব ওয়াজেদ জয়ের নিবন্ধ

দারিদ্র্যের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসছে বাংলাদেশ

অনলাইন ডেস্ক

উন্নয়নের পাশাপাশি দারিদ্র্য নিরসন করে বিশ্বজুড়ে প্রশংসা কুড়িয়েছে বাংলাদেশ। পদ্মা সেতু নির্মাণ সেই অর্জনকে আকাশছোঁয়া উচ্চতায় নিয়ে গেছে। এক সময়ে পশ্চিমাদের দেয়া ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ তকমা পাওয়া বাংলাদেশের কাছে আজ দারিদ্র্যের ফাঁদ পরাভূত হয়েছে। বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ ও ইতিবাচক পদক্ষেপ তুলে ধরতে যুক্তরাষ্ট্রের সাময়িকী ‘ফরেন পলিসিনিউজে’ একটি নিবন্ধ লিখেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়।

 
নিউজ টোয়েন্টিফোরের পাঠকদের জন্য লেখাটির হুবহু অনুবাদ নিচে তুলে দেয়া হলো:

বাংলাদেশিরা দীর্ঘদিন ধরে যা জেনে আসছেন, বিশেষজ্ঞরাও তা নিশ্চিত করেছেন, সেটা হচ্ছে—দারিদ্র্যের জন্য জনসংখ্যা দায়ী না। অর্থনৈতিক দুর্দশা থেকে দরিদ্র মানুষের মুক্তির বাধা সম্পদের অভাব—ইচ্ছা কিংবা মেধা না। বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও অতি গরিব মানুষেরা একটি অনন্ত চক্রে আটকা পড়েছে।

কিন্তু এ অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব, আর তা করে দেখিয়েছে বাংলাদেশ।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশটি জনসংখ্যার ঝুঁকিপূর্ণ অংশকে দারিদ্র্যের ফাঁদ থেকে বের করে নিয়ে এসেছে। এ ক্ষেত্রে নেয়া সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপগুলোর মধ্যে একটি গৃহহীন ও বাস্তুচ্যুতদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করে দেয়া। ১৯৯৭ সালে আশ্রয়ণ প্রকল্পের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। চলতি বছরের শেষে ৩০ হাজারসহ এ প্রকল্পের অধীন দেড় লাখের বেশি পরিবারকে ঘর হস্তান্তর করা হয়েছে।

এছাড়াও প্রকল্পটির অধীন সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। খাবার পানি সরবরাহ, স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবার পরিকল্পনাও বাস্তবায়ন করেছে সরকার। কৃষি খামারের উদ্যোক্তা হওয়া, গবাদিপশু পালন ও ডিজিটাল দক্ষতা অর্জনেও নাগরিকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।

আশ্রয়ণ প্রকল্প নেয়ার পর এখান থেকে দুই লাখ ৯৮ হাজারেরও বেশি পরিবার সহায়তা পেয়েছে। এ প্রকল্প লাখ লাখ মানুষের জীবন বদলে দিয়েছে। পুরুষ-শাসিত অতীত ঐতিহ্য থেকে দেশকে বের করে নিয়ে আসতে সহায়তা করেছে এই প্রকল্প। যা একটি বড় সফলতা। সম্পত্তিতে এখন নারীর অধিকার পুরুষের সমান। আশ্রয়ণ প্রকল্প থেকে দেয়া সম্পদে স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই মালিকানা থাকে। এই অধিকারের বদৌলতে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা অর্জন করেছেন নারীরা।

একটি সম্ভাবনাময় আধুনিক দেশ হিসেবে আবির্ভূত হতে নারীর ক্ষমতায়ন বাংলাদেশের জন্য অপরিহার্য। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের ২০২১ সালের সূচক অনুসারে, লিঙ্গ বৈষম্য কমিয়ে আনতে বাংলাদেশের বড় ধরনের অগ্রগতি হয়েছে। যদিও এখনো অনেক কাজ বাকি আছে, তবে বাংলাদেশের নারীরা যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন।

নারীর উন্নয়নের কারণেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার যেখানে ছিল ৪৭ দশমিক পাঁচ শতাংশ, ২০২০ সালে তা কমে এসেছে ২০ দশমিক পাঁচ শতাংশে। আর ২০০৯ সালে চরম দারিদ্র্য ছিল ১৯ দশমিক ৩ শতাংশ, ২০২০ সালে তা কমে হয়েছে ১০ দশমিক পাঁচ শতাংশে। দৈনিক আয় এক দশমিক ৯০ ডলারের কম হলে তাকে চরম দারিদ্র্য বলা হয়।

‘অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির’ জন্য সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রশংসা করেছে বিশ্ব ব্যাংক। বাংলাদেশকে ‘দারিদ্র্য নিরসনের’ মডেল হিসেবে আখ্যায়িত করেছে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানটি। দারিদ্র্য হার কমার পাশাপাশি বাংলাদেশ দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। ২০০৯ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে, মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ৭১০ থেকে বেড়ে দুই হাজার ৬৪ মার্কিন ডলার হয়েছে।

এইচএসবিসি ব্যাংকের সাম্প্রতিক পূর্বাভাস বলছে, ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৬তম বড় অর্থনীতির দেশ। এর বড় একটি কারণ, গত দুই দশক ধরে বাংলাদেশের জিডিপি ছয় শতাংশের মতো ছিল।

ভিন্ন ভিন্ন গ্রামীণ অঞ্চলকে যুক্ত করতে বাংলাদেশের ভৌত অবকাঠামো ও অনলাইন সংযোগ শক্তিশালী করা হয়েছে। আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে দেয়া সহায়তার কারণে এসব গ্রামাঞ্চল সমৃদ্ধ হয়েছে। দেশের সব অঞ্চলগুলোর মধ্যে সংযোগ স্থাপন করতে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। শনিবার (২৫ জুন) জাঁকজমক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এটি উদ্বোধন করা হবে। দেশের জিডিপিতে বাড়তি দুই শতাংশ যোগ করবে এই সেতু। যাতায়াত সহজ করতে ও পণ্য পরিবহন উন্নয়নে রাজধানী ঢাকায় মেট্রো রেল এবং উড়াল সড়ক নির্মাণ কাজ চলছে।

অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যকরণও পথ দেখাচ্ছে। তৈরি পোশাক ও বস্ত্রশিল্পও বাংলাদেশের বড় অর্থনৈতিক উৎস। এছাড়া বাংলাদেশে ব্যাকরুম অনলাইন সেবারও সমৃদ্ধি ঘটেছে। ২০২১ রাজস্ব বছরে এক দশকের মধ্যে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় তিনগুণ বেড়ে দুই হাজার ২২৭ মার্কিন ডলার হয়েছে। যা প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের চেয়েও বেশি। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চায়ন সর্বকালের সেরা চার হাজার ৮০০ কোটি মার্কিন ডলার হয়েছে। এক সময়ে পশ্চিমাদের তকমা দেয়া ‘তলাবিহীন ঝুড়ির’ দেশটিতে অর্থনৈতিক উন্নতি নজর কাড়ার মতো।

এছাড়া বিশ্বের দরিদ্রতমের তকমা কাটিয়ে চলতি বছরে নিম্ন-মধ্য-আয়ের দেশের মর্যাদা পেয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্য দিয়ে দেশটি ২০২৬ সাল নাগাদ জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তীর্ণ হওয়ার পথে রয়েছে।

বাস্তবিক অর্জনের মধ্যে বিমূর্ত কিছু থাকে না। চল্লিশ বছর বয়সী আলেয়া বেগমের উদাহরণ দেয়া যাক। আবর্জনার স্তূপে পরিণত হওয়া একটি খালের পাশে পরিবার নিয়ে তার বসবাস। ছিন্নবস্ত্রই তার অভাবের সাক্ষ্য দিচ্ছিল। তার নাজুক নড়বড়ে আশ্রয় কেন্দ্রটি ভেঙে খালে পড়ে গেলে আট ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তাকে ভয়ানক কষ্টের মধ্যে দিন পার করতে হচ্ছিল। এ ঘটনার পর তার স্বামীও তাকে ছেড়ে চলে যায়। নিঃসঙ্গ, কপর্দকশূন্য ও আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে সে।

কিন্তু আশ্রয়ণ প্রকল্পের অধীন একটি ঘর তৈরি করে দেয়া হলে তার জীবন বদলে যায়। আবাসন ও খাবার পাওয়ায় তাকে আর অনাহার কিংবা জোরপূর্বক শ্রমের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে থাকতে হয়নি। আশ্রয়ণ প্রকল্পের সুবিধাভোগী হিসেবে তাকে একটি ব্যবসার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এর মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো উপার্জনের মুখ দেখে সে। বাংলাদেশের এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে। কাজেই অন্য সব দেশেও তা ঘটতে পারে।

news24bd.tv/আলী