পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞায় কতটুকু ক্ষতি হল রাশিয়ার

সংগৃহীত ছবি

পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞায় কতটুকু ক্ষতি হল রাশিয়ার

অনলাইন ডেস্ক

ন্যাটোতে যোগ দেওয়া নিয়ে গত ২৪শে ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন আক্রমণ চালায় রাশিয়া। ইউরোপের দেশটিতে ক্রমাগত ভারী কামানের গোলা ও বিমান হামলা চালাচ্ছে ক্রেমলিন। আর পূর্ব ইউক্রেনের সেভেরোদোনেৎস্ককে ‘ভূতুড়ে শহর’ বানিয়ে ফেলেছে তারা। ইউক্রেনে আগ্রাসনের পর থেকেই মস্কোর ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আসছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও তাদের মিত্র দেশগুলো।

এসব নিষেধাজ্ঞায় পুতিনের দেশের কতটুকু ক্ষতি হয়েছে তা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।

প্রতিবেদনে বিবিসি জানায়, নিষেধাজ্ঞার জন্য বৈদেশিক ঋণের টাকা পরিশোধ করতে পারেনি রাশিয়া। আর এতেই নিজেদের প্রভাব দেখাচ্ছে পশ্চিমারা। তবে এরই মধ্যে বছরের শক্তিশালী মুদ্রায় পরিণত হয়েছে রাশিয়ার রুবল।

নিষেধাজ্ঞা মূলত কি?
নিষেধাজ্ঞাকে একধরনের শাস্তি বলা চলে। কোনো দেশ আগ্রাসী আচরণ বা আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করলে ওই দেশের ওপর অন্য কোনো দেশ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে। নিষেধাজ্ঞাগুলো প্রায়ই একটি দেশের অর্থনীতি কিংবা শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদদের মতো নাগরিকদের আর্থিক অবস্থার ওপর আঘাত হানতে জারি করা হয়। এর মধ্যে থাকতে পারে নির্দিষ্ট কোনো দেশে ভ্রমণ বিধিনিষেধ থেকে শুরু করে সমরাস্ত্রসংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞাও।

রাশিয়ার নিষেধাজ্ঞা 
ইউক্রেনে আগ্রাসনের পর থেকে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে পশ্চিমারা। নিষেধাজ্ঞায় তাদের প্রধান লক্ষ্যবস্তু ধনী ব্যক্তি, ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। নিষেধাজ্ঞার জন্য মার্কিন ব্যাংকগুলোতে থাকা রাশিয়ার ছয় হাজার কোটি ডলার আটকে দিয়েছে। এতে করে বৈদেশিক ঋণের টাকা পরিশোধ করতে পারছে না মস্কো।

এ ছাড়া আর্থিক লেনদেনের ব্যাপারে বার্তা আদানপ্রদানকারী আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক ‘সুইফট’ থেকে রাশিয়ার কয়েকটি ব্যাংককে বিচ্ছিন্ন করেছে পশ্চিমারা। এতে করে নিজেদের গ্যাস ও তেলের বিক্রির টাকাও পাচ্ছে না রাশিয়া।

অন্যদিকে নিজের দেশে থাকা রাশিয়া ব্যাংকের সকল সম্পদ ফ্রিজ করেছে যুক্তরাজ্য। এ ছাড়া রাশিয়ান সংস্থাগুলো অর্থ লোন নিতে পারছে না। এমনকি যুক্তরাজ্যের ব্যাংকগুলোতে অর্থ জমা করতে সীমাবদ্ধতা করে দিয়েছে।

তেল ও গ্যাস
তেল ও গ্যাস নির্ভর রাশিয়ার অর্থনীতি। রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের প্রথম ১০০ দিনে জ্বালানি থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে ক্রেমলিন। নির্ভরতা থাকলেও দেশটির জ্বালানির ওপর ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে পশ্চিমারা। নিষেধাজ্ঞাগুলো হল:
•   ২০২২ সালের পর থেকে সমুদ্র পথে রাশিয়া থেকে আর কোনো জ্বালানি না নিতে সম্মত ইইউ।
•   রাশিয়ার সব ধরনের তেল ও গ্যাস আমদানি নিষিদ্ধ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
•   ২০২২ শেষে রাশিয়া থেকে তেল না নেওয়ার ঘোষণা যুক্তরাজ্যের।
•   রাশিয়া থেকে একটি পাইপলাইনে আসা গ্যাস নে নেওয়ার বিষয়ে সাফ জানিয়েছে জার্মানি।
•   আগস্টের পর মস্কো থেকে আর কয়লা না নিতে একমত ইইউ।

রাশিয়ার গ্যাসের ওপর বেশি নিষেধাজ্ঞা দেয়নি ইইউ। এর কারণ দেশগুলোর ৪০ শতাংশ গ্যাসের যোগানদাতা মস্কো। তবে গত মার্চে সংস্থাটি থেকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলা হয়, এক বছরের মধ্যে তারা রাশিয়ার গ্যাস আমদানি এক তৃতীয়াংশ করে ফেলবে। তবে পরবর্তীতে এ পদক্ষেপ নিয়ে কথা বলেনি তারা।

ব্যক্তি নিষেধাজ্ঞা
আগ্রাসনের পর থেকেই পশ্চিমারা অন্তত এক হাজার রাশিয়ানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। যার মধ্যে দেশটির সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পুতিন ও তার পরিবারের সদস্যরা। ইতোমধ্যে পুতিন ও তার পরিবারের সদস্যদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করেছে পশ্চিমারা। এ ছাড়া রাশিয়ানদের জন্য চালু থাকা ‘গোল্ডেন ভিসা’ প্রক্রিয়া বন্ধ করেছে যুক্তরাজ্য।

শুধুমাত্র এসবেই ক্ষান্ত হননি পশ্চিমারা। পণ্য রফতানি, ফ্লাইট বন্ধ, সোনা ও বিলাসজাত দ্রব্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে পশ্চিমারা। অন্যদিকে রাশিয়া থেকে আমদানিকৃত অ্যালকোহলের ওপর ৩৫ শতাংশ ভ্যাট বাড়িয়েছে ব্রিটেন। এ ছাড়া বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কোম্পানি রাশিয়ায় নিজেদের ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন।

নিষেধাজ্ঞার পর মস্কোর অবস্থা
নিষেধাজ্ঞা শুরু পর থেকে রাশিয়ার অর্থনীতিতে ধস শুরু হয়। বেড়ে যায় বেকারত্ব। সুপারশপগুলো ভরা থাকলেও বিদেশি পণ্যের সংকট দেখা দেয়।

বিবিসি বলছে, নিষেধাজ্ঞা কবলিত রাশিয়ায় গত মে মাসে মুদ্রাস্ফীতি ১৭ দশমিক এক শতাংশে পৌঁছায়। খুচরা  বাণিজ্য ৮-৯ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। শুধুমাত্র মে মাসে গাড়ি বিক্রি ৮৩ দশমিক ৫ শতাংশ কমে যায়। দেশটির সরকারি পূর্বাভাসের মতে, ২০২২ সালে রাশিয়ান জিডিপি সাত দশমিক আট শতাংশ কমতে পারে। একই কথা বলছে আইএমএফ।

মস্কোর পরামর্শক সংস্থা ম্যাক্রোর  ক্রিস ওয়েফার বলেন, রাশিয়া যদি আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞাগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে না পারে তাহলে তাদের অর্থনৈতিক পতন ঘটবে। তবে ২০১৪ সালে একই অবস্থা দেখেছে পুতিন। কীভাবে নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে উঠা যায় তা নিয়ে তারা ভাল জানে।

রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া
পশ্চিমাদের প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়া অন্তত ২০০ পণ্যে আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে। সরকারি বন্ডের মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সুদের অর্থ প্রদানে বাধা দিচ্ছে। এমনকি বিদেশি শেয়ারহোল্ডারদের অর্থ প্রদান করতে রাশিয়ান সংস্থাগুলোকে নিষেধ করছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের তাদের সম্পদ বিক্রি করা থেকে বিরত রেখেছে।

অন্যদিকে তেল-গ্যাস বিক্রির অর্থ রুবলে পরিশোধ করার কথা জানিয়েছে ক্রেমলিন। এ জন্য রাশিয়ার একটি ব্যাংকে বিশেষ হিসাব খুলতে হবে। এর ব্যতিক্রম হলেই গ্যাস সরবরাহ চুক্তি স্থগিত করবে মস্কো।

মার্কিন ডলারের বিপরীতে রাশিয়ার মুদ্রা রুবলের মান ক্রমাগত বাড়ছে। বিশ্বে এ বছরের শক্তিশালী মুদ্রায় পরিণত হয়েছে রুবল। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রুবলের দাম ঘুরে দাঁড়ানোর কারণে রাশিয়া এখন সমস্যামুক্ত হলেও তা সাময়িক।

হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের অধ্যাপক জেফ্রে ফ্রানকেল বলেন, এ ধরনের পরিস্থিতি সাধারণত দেখা যায় না। সাধারণত কোনো দেশ যখন আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা ও সামরিক সংঘাতের মধ্যে থাকে, তখন দেশটি থেকে বিনিয়োগকারীরা সরে পড়ে। মুদ্রাপ্রবাহে স্থিরতা দেখা দেয়। এতে মুদ্রার মান কমতে থাকে। তবে দেশের মুদ্রা যেন বাইরে না যায় তা নিশ্চিত করতে রাশিয়া কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল। এসব পদক্ষেপের কারণে রুবলের চাহিদা তৈরি হয় এবং এর মূল্য বেড়ে যায়।
news24bd.tv/মামুন