মাতৃঋণের সূর্য : বঙ্গমাতার জন্য শোকগাথা

বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব

মাতৃঋণের সূর্য : বঙ্গমাতার জন্য শোকগাথা

ড. সাবিনা ইয়াসমিন

‘মাতা না থাকিলে ধরিত্রীর অর্থ নাই। জীবনের উৎসব নাই। আয়োজনের আনন্দ নাই। জগৎ ব্যাপিয়া মাতৃঋণের সূর্য জ্বলিয়া থাকে’।

(ইনকা সভ্যতায় মাতৃবন্দনা)

মাতৃঋণ কখনো পরিশোধ করা যায় না। তবে মাতৃহারা সন্তান মায়ের জন্য শোক করতে পারে। যে শোকের ব্যাপ্তিও আমৃত্যু। প্রার্থনা করতে পারে।

যতদিন দেহে প্রাণ থাকে। কিন্তু, যে মায়ের মৃত্যু স্বাভাবিক নিয়মের বাইরে গিয়ে হয়, তাও আবার ঘাতকের গুলিতে, সপরিবারে, সেই মায়ের জন্য শোক প্রকাশের ভাষাও যেন মুক, স্তব্ধ হয়ে যায়। প্রার্থনাও বাণীহারা। শুধু থাকে ঋণ স্বীকারের ডালি।  

বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব। ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ৮ আগস্ট গোপালগঞ্জ জেলার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বেঁচে থাকলে এবছর তাঁর বয়স হতো ৯৩ বছর। তাঁর ডাকনাম ছিল রেনু। শৈশবেই পিতৃ-মাতৃহীন রেনুর সাথে মাত্র তিন বছর বয়সে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে বিয়ে হয়। শেখ মুজিবের পরিবারের সাথেই বেড়ে ওঠেন তিনি। তখন তিনি শেখ মুজিবের পিতা-মাতার কাছে কন্যার মতোই আদর-যত্ন পান। সংসার শুরু হয় জাতির পিতার এন্ট্রাস পাশের পর, মাত্র দশ বছর বয়সে। শেখ মুজিবের সাথে যখন তার বিয়ে হয়, তখন শেখ মুজিবও ছিলেন বাবা-মায়ের আদরের খোকা। তখনও তিনি শেখ মুজিব হয়ে ওঠেননি।  

পরবর্তীতে খোকা থেকে শেখ মুজিব, কর্মীদের প্রিয় মুজিব ভাই, মুজিব ভাই থেকে বঙ্গবন্ধু বা জাতির পিতা হয়ে ওঠার প্রতিটি পর্বে পাশে থেকে কখনো নেপথ্যে, কখনো প্রকাশ্যে তাঁকে সাহস দিয়েছেন, অনুপ্রেরণা দিয়েছেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। জাতির পিতার জীবনের বহু সঙ্কটে তিনি অত্যন্ত ধৈর্য এবং বুদ্ধিমত্তার সাথে সংসার সামলেছেন।  

সংসারের পাশাপাশি তিনি জাতির পিতার পক্ষে দেশের মানুষের দায়িত্বও কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন জাতির পিতার যোগ্য সহধর্মিনী। তাঁর সহিষ্ণুতার কথা জাতির পিতা আমৃত্যু মনে রেখেছিলেন। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ রাজধানীর আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয়ে মহিলা ক্রীড়া সংস্থার অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন বঙ্গবন্ধু। সেখানে তিনি নারীর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে গিয়ে বলেন, ‘আমার জীবনেও দেখেছি, গুলির সামনে আমি এগিয়ে গেলেও কোন দিন আমার স্ত্রী আমাকে বাধা দেয় নাই। এমনও আমি দেখেছি যে, অনেকবার আমার জীবনের ১০/১১ বছর আমি জেল খেটেছি। জীবনে কোনদিন মুখ খুলে আমার ওপর প্রতিবাদ করে নাই। তাহলে বোধ হয় জীবনে অনেক বাধা আমার আসত। এমন সময়ও আমি দেখেছি যে, আমি যখন জেলে চলে গেছি, আমি এক আনা পয়সা দিয়ে যেতে পারি নাই আমার ছেলেমেয়ের কাছে। আমার সংগ্রামে তার দান যথেষ্ট রয়েছে। পুরুষের নাম ইতিহাসে লেখা হয়। নারীর নাম বেশি ইতিহাসে লেখা হয় না। ’

স্বামী জেলে গেলে ও সংসার খরচের টাকা পয়সা না থাকলে স্ত্রীরা যে স্বামীকে রাজনীতিতে নিরুৎসাহিত করবেন এবং উপার্জনমুখী হতে বলবেন- স্বাভাবিক নারীদের জন্য এটা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব তা করেননি। তিনি যে ভবিষ্যতে বঙ্গমাতা হয়ে উঠবেন। সেই দেশমাতার বীজ তাঁর মধ্যে ছিল। তাই তো স্বামী জেলে গেলে তিনি দৃঢ়তার সাথে বলতে পারতেন ‘জেলে থাকো, আপত্তি নেই, তবে স্বাস্থ্যের দিকে নজর রেখো। তোমাকে দেখে আমার খুব মন খারাপ হয়ে গেছে। তোমার বোঝা উচিৎ আমার দুনিয়ায় কেউ নাই। তোমার কিছু হলে বাঁচব কি করে? এ যেন ঝিনুকের মতো, ‘ঝিনুক’ নীরবে সহো, ঝিনুক নীরবে সয়ে যাও, ভেতরে বিষের বালি, মুখ বুজে মুক্তা ফলাও।

এই কথাতেই বোঝা যায় যে, স্বামীর প্রতি তাঁর ভালোবাসারও যেমন কমতি ছিল না, তেমনি রাজনীতিতেও তাঁর আপত্তি ছিল না। একই রকম ভালোবাসা জাতির পিতারও ছিল বঙ্গমাতার প্রতি। অসমাপ্ত আত্মজীবনী বা কারাগারের রোজনামচাতে তিনি বার বার উল্লেখ করেছেন সে কথা। জেলখানায় থাকাকলীন তাঁর মাধ্যমেই বেশির ভাগ সময়ই জাতির পিতা দলীয় নেতা-কর্মীদের সাথে যোগাযোগ করতেন। গ্রেফতার হয়ে যেতে পারেন, এটা জানার পরও বঙ্গমাতা সেই দায়িত্ব অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পালন করতেন।  

শেখ হাসিনার লেখায় আমরা দেখি, ‘জেলখানায় দেখা করতে গেলে আব্বা তাঁর মাধ্যমেই দলীয় নেতা-কর্মীদের খোঁজ-খবর পেতেন। আব্বার দিক-নির্দেশনা নেতা-কর্মীদের কাছে পৌঁছে দিতেন আম্মা। আব্বা কারাবন্দী থাকাকালে সংসারের পাশাপাশি সংগঠন চালানোর অর্থও আমার মা যোগাড় করতেন। তিনি কখনও ব্যক্তিগত, পারিবারিক সুখ-স্বাচ্ছন্দের দিকে তাকাননি। একদিকে যেমন সংসারের দায়িত্ব পালন, অন্যদিকে মামলা পরিচালনার ব্যবস্থা করা, দলকে সংগঠিত করা, আন্দোলন পরিচালনা সহ প্রতিটি কাজে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা অত্যন্ত দক্ষতা ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। ’

বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা- সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এমপিও তাঁর এক স্মৃতিচারণে একই রকম বক্তব্য প্রদান করেন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু জেলে থাকাকালে আওয়ামী লীগ অফিসের ভাড়া বাকি পড়ে যাওয়ায় বাড়িওয়ালা এ বিষয়ে তাদেরকে বার বার তাগিদ দিলে তাঁরা (প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাকসহ) কয়েক ঘন্টার সময় প্রার্থনা করে দ্রুত মোটর সাইকেলে গিয়ে বঙ্গমাতার স্মরণাপন্ন হন ও সমস্যার কথা খুলে বলেন। তখন বঙ্গমাতা তাদেরকে ভাড়ার টাকা দিয়ে দেন।  এরকম রাজনৈতিক সহযোগিতা ছাড়াও রাজনৈতিক বিচক্ষণতাও ছিল তাঁর প্রখর।  

১৯৬৬ সালে বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা প্রকাশ ও প্রচারের সময় জাতির পিতাকে গ্রেফতার করা হয় এবং কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। তখন ছয় দফার দাবী আদায়ের লড়াইয়ে গোপনে প্রচার-প্রচারণা চালানো এবং একই সাথে দলের নেতা-কর্মীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন তিনি। বাসা থেকে আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে সেখান থেকে বোরখা ও স্যান্ডেল পরে জনসংযোগে বেরিয়ে পড়তেন। ৭ জুনের হরতাল তাঁর প্রচেষ্টাতেই সফল হয়েছিল। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুকে আটকের ছয় মাস পর পাকিস্তান সরকার তাঁকে প্যারোলে মুক্তির প্রস্তাব দিলে বঙ্গমাতা দৃঢ়তার সাথে তা প্রত্যাখানের জন্য বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করেন। তিনি কঠিন স্বরেই বলেন, ‘প্যারোলে মুক্তি নিলে মামলার আর ৩৩ জন আসামির কি হবে’। বঙ্গবন্ধু প্যারোলের প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন এবং পাকিস্তান সরকার তাঁকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। (৬৯ এর গণ অভ্যুত্থানএবং ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গমাতার অবদান সব সময় বাঙালি কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করবে)।  

৭১ এর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পূর্ব রাত্রে বঙ্গবন্ধু যখন অস্থির ভাবে পায়চারি করছিলেন তখন বঙ্গমাতা তাঁকে বলেছিলেন, ‘তোমার যা মনে আসে তাই তুমি বলবে। তুমি রাজনীতি করেছো। কষ্ট সহ্য করেছো, কি বলতে হবে তা তুমি জানো। কারও কথা শোনার দরকার নাই। ’ এই অনুপ্রেরণার ফসল ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ- ইতিহাসের অন্যতম সেরা রাজনৈতিক মহাকাব্য।

তিনি আমৃত্যু ছিলেন জাতির পিতার পাশে। যখন ঘাতকেরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলো তখন তিনি একবারও বাঁচার জন্য দয়া ভিক্ষে করেননি। বরং দৃঢ় কণ্ঠে বলেছেন, ‘উনাকে যখন মেরে ফেলেছো, আমাকেও মেরে ফেল। ’ এরপর ডেডস্টপ। দশ বছরের শিশু সন্তান, জৈষ্ঠ্য দুই পুত্র-পুত্রবধু এবং অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন সহ পুরো একটা পরিবারকে গুলি করে হত্যাযজ্ঞ চালালো ঘাতকের দল। সন্তান সন্ততি, আত্মীয়-স্বজনের সাথে হল তাঁর মহাপ্রয়াণ।  

২০২১ সালের ৮ আগস্ট থেকে বাংলাদেশে সরকার এই দিনে রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ক্রীড়া, সমাজসেবা, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ, গবেষণা, কৃষি ও পল্লী উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ৫ জন বাংলাদেশী নারীকে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব পদক প্রবর্তন করেছে এবং দিবসটিকে ‘ক’ শ্রেণির দিবস হিসেবে পালন করছে। এটি একটি মহান উদ্যোগ। মাতৃঋণ কখনো শোধ করা যায় না। তবে এ উদ্যোগের ফলে সুযোগ হয়েছে এই মহীয়সী নারীর ভূমিকা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেবার।  

লেখক : উপসচিব, খাদ্য মন্ত্রণালয়।