অকটেন-পেট্রোলের মূল্য ও রপ্তানি নিয়ে বিতর্ক কেন ?

অকটেন-পেট্রোলের মূল্য ও রপ্তানি নিয়ে বিতর্ক কেন ?

অনলাইন ডেস্ক

সরকার ইচ্ছে করে জ্বালানির দাম বাড়িয়েছে- এ বিষয়ে হয়তো কেউই একমত হবেন না। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম চড়তে থাকার পর সরকার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বিপিসির ক্রমাগত লোকসানের মুখে আরও আগেই জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রয়োজন দেখা দিলেও প্রধানমন্ত্রীর দূরদৃষ্টি ও জনগণের প্রতি ভালোবাসা থেকে তাড়াহুড়ো করে দাম বাড়ানোর পথে হাটেনি সরকার।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে আন্তর্জাতিক জ্বালানির বাজারে যে অস্থিরতা তার ভিকটিম হয়েছে বাংলাদেশ।

সেই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য ছয় মাস অপেক্ষার পরও যুদ্ধ থামার কোনও ইঙ্গিতই যখন মিলছে না তখন দাম না বাড়িয়ে বাংলাদেশের সামনে কোনো বিকল্প ছিল না।

শুধু উন্নত বিশ্বই নয়, আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে প্রতিদিন জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় হয়। সেখানে ছয় মাস ধরেই দাম ঊর্ধ্বমুখী। আমাদেরও যদি অটোমেটিক সমন্বয় করার সিস্টেম চালু থাকতো তাহলে প্রতিদিন দাম বাড়তে বাড়তে এরই মধ্যে বর্তমানের চেয়েও বেশি দামে কিনতে হতো।

তেলের মূল্য সমন্বয়ের পর কোনো কোনো মহল থেকে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, পেট্রোল ও অকটেনের দাম বেশি বাড়ানো হলো কেন? পেট্রোলের শতভাগ ও অকটেনের ৪০ শতাংশ দেশে উৎপাদিত হয়। এখন যদি তাদের প্রশ্ন করা হয়, বাংলাদেশে দরিদ্র মানুষেরা পেট্রোল ও অকটেন ব্যবহার করে? এক কথায় উত্তর, না। কিন্তু বছরে প্রায় ৭ লাখ টন পেট্রোল ও অকটেন ব্যবহৃত হয়। তাহলে এই ব্যবহারকারী কারা? এবারও এক কথায় উত্তর হলো- মধ্য ও উচ্চবিত্তরা।

এতদিন তো ডিজেল ও কেরোসিনের থেকে পেট্রোল ও অকটেনের দাম বেশি ছিল, তাহলে প্রশ্ন ওঠেনি কেন? আর সরকার যদি পেট্রোল ও অকটেনের দাম বেশি না বাড়িয়ে ডিজেল ও কেরোসিনের সমান দাম করতো তাহলে নিশ্চিতভাবেই প্রশ্ন উঠতো, সরকার বড়লোকদের সুবিধা করে দিতেই এভাবে মূল্য নির্ধারণ করেছে। এখানে মূল্য সমন্বয় করাটা শাখের করাতের মতোই।  
জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির মধ্যে পেট্রোল ও অকটেনের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে পেট্রোলিয়াম পণ্য রপ্তানি করা হয়- প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য নিয়েও প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। বিষয়ের একটু গভীরে প্রবেশ করলেই দাম বৃদ্ধির তাৎপর্য এবং প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া যাবে।

সবার আগে দেখে আসা যাক বিশ্বের শীর্ষ ফসিল ফুয়েল উৎপাদনকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, সৌদি আরব, কানাডা ও চীনের বাজারে খুচরা পর্যায়ে জ্বালানির দাম কেমন?

বিশ্বের সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ মোট ফসিল ফুয়েলের প্রায় ২০ শতাংশ উৎপাদন করে যুক্তরাষ্ট্র। ২৫ এপ্রিল থেকে ১ আগস্টে প্রতি লিটার অকটেনের গড় দাম ছিল ১ ডলার ২৭ সেন্ট। ডলারের বিনিময় ১০০ টাকা ধরলে এই দাম দাঁড়াচ্ছে ১২৭ টাকা। এ সময়ে সর্বোচ্চ ছিল ১ ডলার ৩৭ সেন্ট মানে ১৩৭ টাকা। গত ১ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি লিটার ডিজেলের দাম ছিল ১ দশমিক ৩৫ সেন্ট বা ১৩৫ টাকা।

বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ফসিল ফুয়েল উৎপাদক দেশ রাশিয়াতে নিয়ন্ত্রণমূলক বাজার থাকায় সেখানেও দাম একদম কম না। পহেলা আগস্ট রাশিয়ার বাজারে প্রতি লিটার ডিজেল দশমিক ৮৪ সেন্ট বা ৮৪ টাকা এবং অকটেন দশমিক ৮২ সেন্ট বা ৮২ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

সৌদি আরবে ডিজেলের মূল্য কিছুটা কম থাকলেও অকটেনের দাম চারগুণ বেশি। পহেলা আগস্ট সেখানে প্রতি লিটার ডিজেলের খুচরা দাম ছিল দশমিক ১৬ সেন্ট বা ১৬ টাকা এবং অকটেনের দাম ছিল দশমিক ৬২ সেন্ট বা ৬২ টাকা। কানাডার বাজার আরও চড়া। একইদিন সেখানে ডিজেল ১ ডলার ৪৭ সেন্ট বা ১৪৭ টাকা এবং প্রতি লিটার অকটেন বিক্রি হয়েছে ১ ডলার ৫৫ সেন্ট বা ১৫৫ টাকায়।

একই সময়ে চীনে প্রতি লিটার ডিজেল ১ ডলার ২১ সেন্ট বা ১২১ টাকা এবং অকটেন ১ ডলার ৩৫ সেন্ট বা ১৩৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

তাহলে বিশ্বের শীর্ষ ফসিল ফুয়েল উৎপাদনকারী দেশেও অকটেনের দাম বাড়ছে কেন? চাইলেইতো তারা মানুষকে বিনামূল্য দিতে পারে। কিন্তু তা দিচ্ছে না কেন? সমালোচকরা কীভাবে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেবেন।

বাংলাদেশ যে শতভাগ পেট্রোল ও ৪০ ভাগ অকটেন উপাদন করে এ তথ্য আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এখন আসি বাংলাদেশের পেট্রোলিয়াম রপ্তানি করার বিষয়ে।

গত ১১ বছরে (২০১০-২০১১ অর্থবছর থেকে ২০২০-২০২১ অর্থবছর) বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) ন্যাপথা রপ্তানি হয়েছে ৭ লাখ ৭৯ হাজার ৬৫৩ টন। এর মধ্যে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে ১৮ হাজার ৭৯৫ টন।

ন্যাপথা থেকে বিভিন্ন পেট্রোলিয়ামজাত পণ্য উৎপাদিত হয়। বর্তমানে দেশে স্থাপিত বিভিন্ন বেসরকারি পেট্রোকেমিক্যাল প্ল্যাণ্টে জ্বালানি তেল ও অন্যান্য পেট্রোলিয়াম পণ্য উৎপাদন শুরু হওয়ায় কাঁচামাল হিসেবে ন্যাফথা সরবরাহ করা হচ্ছে। ২০১২-২০১৩ অর্থবছর থেকে গত ৮ বছরে রপ্তানির পাশাপাশি স্থানীয় জ্বালানি তেল ও অন্যান্য পেট্রোলিয়াম পণ্য উৎপাদকদের বিপিসি থেকে ন্যাপথা সরবরাহ করা হয়েছে ৬ লাখ ২৮ হাজার ৭৯৯ টন।

সমালোচকরা কি এই তথ্যের ভিত্তি উড়িয়ে দেবেন? এখনও কি তারা বলবেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য ভুল ছিল?

বিশ্ববাজারে জ্বালানি আমদানির মূল্য বৃদ্ধি পায়। এজন্য আমদানি ও দেশের বাজারে বিক্রয় মূল্যের কিছুটা ভারসাম্য আনার লক্ষে গত ৫ আগস্ট থেকে বাংলাদেশে বিভিন্ন জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়। আমদানি ব্যায় ও বিক্রয় মূল্যের মধ্যে ব্যাপক ফারাক থাকায় গত মাত্র ৬ মাসে বিপিসিকে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে।

এই মূল্যবৃদ্ধির পর থেকে অনেকেই বলছেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কথা মোতাবেক, আমরা যদি পেট্রোল আমদানি না করি, তাহলে পেট্রোলের দাম কেন বৃদ্ধি করা হলো?

প্রশ্নটি কেউ কেউ একান্তই সরল মনে আর কেউ কেউ গরল মনেই করছেন!

যারা সরল মনে প্রশ্নটি করেছেন তারা হয়তো ইতোমধ্যেই উত্তর পেয়ে গেছেন। আর গরল মনে যারা করছেন তাদের ভাবনার জন্য আরও কিছু তথ্য সংযোজন করা যেতে পারে।

নিচের ছবিটিতে দেখতে পারেন যে আমাদের আমদানিকৃত এক ব্যারেল ক্রুড অয়েল পরিশোধন করে আমরা কী কী পেট্রোলিয়ামজাত দ্রব্য পেয়ে থাকি।

এক ব্যারেল ক্রুড অয়েল পরিশোধিত করে আমরা মাত্র ২০ শতাংশ গ্যাসোলিন বা ডিজেল পেয়ে থাকি। বাকি অংশ থেকে আমরা পেট্রোল/নাফথা, অকটেন, মোবিল ইত্যাদি উৎপাদন করি। আমাদের রিফাইনারী বা পরিশোধনাগারে আমরা সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টন ক্রুড অয়েল পরিশোধন করতে পারি। আর তা থেকে মাত্র ৩ লাখ টন ডিজেল উৎপাদিত হয়। বাদ বাকি দ্রবন থেকে অন্যান্য পেট্রোলিয়ামজাত দ্রব্য উৎপাদিত হয়। আমাদের ডিজেলের চাহিদা বছরে প্রায় ৫০ লাখ টন। তাই আমাদের নিজস্ব উৎপাদিত তিন লাখ টনের বাইরে বাকি প্রায় ৪৫/৪৭ লাখ টন পরিশোধিত ডিজেল আমাদের বহির্বিশ্ব থেকে আমদাদি করতে হয়। কিন্তু মাঝে মাঝে আমাদের উৎপাদিত পেট্রোলিয়ামের (পেট্রোল/নাফথা ইত্যাদি) উৎপাদন বা মজুদ বেড়ে গেলেই তা আবার রপ্তানি করতে হয়। কারণ মজুদ কমিয়ে যথাসম্ভব উৎপাদন চালিয়ে যাওয়ার জন্য রিজার্ভার প্রয়োজন।

news24bd.tv তৌহিদ

এই রকম আরও টপিক