রোনাল্ডোর ক্লাবের পথে ক্যাসেমিরো

কার্লোস এনরিকে ক্যাসেমিরো।

রোনাল্ডোর ক্লাবের পথে ক্যাসেমিরো

সৌর আলোক রাহা।

'আহ! ক্যাসেমিরো, ও আমার জীবন বাঁচিয়েছে। আমি হয়ত ৪৫ বছর পর্যন্ত খেলতে পারবো যদি ও আমার পাশে খেলে'- বলছিলেন মার্সেলো। পুরো দল যখন অপোনেন্ট থার্ডে চলে গিয়েছে তখন আপোষহীনভাবে নিজেদের হাফে দাঁড়িয়ে থেকেছে যদি বল হঠাৎ অপোনেন্ট থেকে ছুটে আসে আমাদের গোলপোস্টের দিকে। নিজের শরীরকে এগিয়ে দিয়েছে অপোনেন্ট এর রিয়াল মাদ্রিদ গোলপোস্টের দিকে ছোঁড়া শট আটকাতে।

অপোনেন্ট ছুটে আসছে, হয়ত এবার গোল হজম করতেই হবে। কিন্তু শেষ ভরসা হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে ক্যাসেমিরো। তাকে পার না করে তো আসলে রিয়াল মাদ্রিদ গোলপোস্ট দেখার সুযোগ নেই অপোনেন্টের। ম্যাচ চলাকালীন সময়ে করিম বেনজেমাকে খুবই বাজে ভাবে ট্যাকেল করে জেমস মিলনার।
বেনজেমাকে খোঁড়াতে দেখে ভালো লাগেনি ছেলেটার। পরক্ষণেই সুযোগ পেয়ে লিভারপুল ডাগ আউটের সামনেই একইরকম ভাবে ট্যাকেল করে মিলনারকে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দেন ক্যাসেমিরো। পিছনে দাঁড়িয়ে জিদান হাসছিলেন আর হয়ত ভাবছিলেন, 'যাক! আমাদের দলে একজন রক্ষক আছে এখনও। '

১৮-১৯ সিজনে চরম একটা বাজে সময় কাটায় রিয়াল মাদ্রিদ। জিদান ফিরে আসায় দলের ভেতরে প্রাণ ফেরে কিছুটা। পরের সিজনেই লিগের জন্য লড়াই করছে দল। এল ক্লাসিকো- ম্যাচ বার্নাব্যুতে ভিনিসিয়াস হঠাৎ করেই গোল করে ফেলেন একটা। পুরো টিম ছুটে যায় ভিনিসিয়াস এর দিকে। কিন্তু একজন মাঝ মাঠে বসেই গগনবিদারী চিৎকার করে মাটি চাপড়ে চাপড়ে, কান্না ভেজা চোখে সেলিব্রেশন করছিলো সেই গোল। ক্যাসেমিরোর ভালোবাসাটা ওই চিৎকার আর কান্না ভেজা চোখ বেয়ে তো বার্নাব্যুর ঘাসে গিয়ে পড়েছে; সেইজন্যই হয়ত পুরো বার্নাব্যুও ভালোবেসে ফেলেছে ওই ব্রাজিলিয়ানকে।

১-১ গোলে সমতা নিয়ে ড্রেসিং রুমে গিয়ে জিদান কার্ডিফে সেদিন বলেছিল, নিজেদের খেলাটা খেলতে থাকো, গোল আসবে। এরপর দ্বিতীয় হাফে খেলা শুরু হলে ডিফেন্সিভ মাইন্ডের জুভেন্টাস এর গেমপ্ল্যান যখন 'আগে ডিফেন্স পরে সব' তখনই প্রায় ২৫ গজ বাইরে থেকে ক্যাসেমিরোর একটা জোরালো শট। কিছুটা ডিফ্লেকশান নিয়ে বুফনকে ফাঁকি দিয়ে ডান গোলপোস্ট ছুঁয়ে জালে জড়ায় বল। জিদান ও হাত খুলে উদযাপন করেন, হয়ত বুঝেছিলেন যে দরকারি জিনিসটা হয়ে গেছে। এরপর তো ছেলেখেলা করে জিদানের দল জুভেন্টাস এর সাথে। ম্যানসিটির সাথে লাস্ট চ্যাম্পিয়ন্স লিগেও ইতিহাদে গিয়ে ৪ গোল হজম করে রিয়াল মাদ্রিদ। পরবর্তী লেগেই মাত্র ১ গোল হজম করে তারা। ওইদিনও ৩ গোল করেছিল রিয়াল। শুধু পার্থক্য সেদিন ৪টা হজম করে আর এদিন ১টা। পার্থক্যটা আরও এক জায়গায় ছিলাে। ক্যাসেমিরো! সেদিন অনুপস্থিত ছিলো, আর এদিন উপস্থিত ছিলো সে। রিয়াল মাদ্রিদ অ্যাট ডিফেন্স এর সামনে এক অদৃশ্য ঢাল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ওই সৈনিকের কাজই তাে ছিল এই পার্থক্য গড়া।

পুরো দল সুন্দর ফুটবল খেলছে, এরমাঝে একজন আছে যিনি হয়তো সুন্দর, চোখ ধাঁধানো পাস বা ডিফেন্স চেরা পাস করতে পারে না। কিন্তু সে যেটা পারে সেটা হচ্ছে অপোনেন্ট এর এই সমস্ত সুন্দর পাসগুলোকে রিয়াল মাদ্রিদ এর আঘাত করা থেকে রক্ষা করতে। কোন প্লেয়ার চোখ ধাঁধানো ছুটে চলেছে রিয়াল মাদ্রিদ এর গোলের দিকে, তাকে যেভাবেই হোক আটকে দিতে। ফুটবলের ভাষায় ডার্টি ওয়ার্ক যেটা বলে। আসলেই ডার্টি ওয়ার্ক। কিন্তু কাজটা করা হয় পরিষ্কার করার জন্য। প্রতিদিন আমাদের বাসার সামনে থেকে যেমন একজন ময়লাওয়ালা ময়লা নিয়ে যায়, আর পরিষ্কার করে দিয়ে বাড়ির আঙিনা। তেমনই নিজে হয়তো করেন ডার্টি ওয়ার্কে। কিন্তু পরিষ্কার করেন রিয়াল মাদ্রিদ এর সাফল্যের রাস্তা। এমন একটা পজিশনে খেলেন যারা সাধারণত কখনোই লাইম লাইটে থাকে না, খুব গোল অ্যাসিস্টে নাম থাকে না। কিন্তু তার উপর ভরসা করেই দল দাঁড়িয়ে থাকে। সেইজন্যই হয়তো ম্যাক্সিমিলিয়ানো এলেগ্রি (জুভেন্টাস ম্যানেজার) বলেছিলেন, 'ক্যাসেমিরোর ইনকুশান, আর পজিশনটা জিদান এর একটা মিরাকল'।

সাবেক বার্সেলোনা মিডফিল্ডার জাভি তো বলেছিল 'ক্যাসেমিরোর মতো মিডফিল্ডার আছে যারা হয়ত জানে না কিভাবে বার্সার হয়ে খেলতে হয়'। জবাবে বলেছিলেন, 'সে (জাভি) যা খুশি বলতে পারে, কিন্তু আমি রিয়াল মাদ্রিদ ক্যারিয়ারে ৪ বছরে ৪টা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল খেলেছি এবং জিতেছি'।

ক্যাসেমিরোকে সবাই 'ইনভিসিবল ম্যান' বলে ডাকে। অবশ্য এর পিছনে যথার্থ কারণও আছে। নিজের কাজটুকু করতে গিয়ে অনেক সময়ই ফাউল বা বাজে ট্যাকেল করতে হয়। এর জন্য ফাউল হয়তো রেফারি দেন কিন্তু অনেক সময়ই বুকিং থেকে বেঁচে যান ক্যাসেমিরো। অনেকের অভিযোগ যে কিভাবে লাল কার্ড ছাড়া ম্যাচ শেষ করলেন ক্যাসেমিরো। কিন্তু দেখা যায় ম্যাচে হলুদ কার্ড পর্যন্ত দেখতে হয়নি তাকে। ট্যাকেল করার পর স্বভাবসুলভ সেই হাসিটা হয়ত মন ভোলানো ছিল। সেই মায়ার কারণে হয়ত কখনো তাকে সেভাবে সাজা দেয়নি রেফারি। রিয়াল মাদ্রিদ ক্যারিয়ারে তাই মাত্র ১টা লাল কার্ড দেখতে হয়েছে তাকে।

এর আগেও ক্যাসেমিরোকে কেনার জন্য অফার করেছিল পিএসজি। তখন রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে সবচেয়ে কম আয় করা খেলোয়াড়দের একজন ছিলেন তিনি। তাকে অনেক বেশি টাকা অফার করা হলেও রিয়াল মাদ্রিদ ছাড়তে রাজি হননি ক্যাসেমিরো। এরপরে রচনা করেছেন ইতিহাস। রিয়াল মাদ্রিদ এর হয়ে জয় করেছেন সমস্ত কিছু৷ জিতেছেন পাঁচটা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। ক্লাব ফুটবলে একজন খেলোয়াড় এর যা চাওয়ার থাকে তার সমস্ত কিছুই তিনি জিতে ফেলেছেন। মধুর এক সম্পর্কই চলছিলো ভালোই।

ক্রুস আর মদ্রিচকে সাথে নিয়ে গড়েছেন বিশ্বের সেরা মিডফিল্ড ট্রায়ো যারা শুরু থেকে ৯টা ফাইনাল খেলে ৯টাই জয় করেছেন। একজন আরেকজনকে কিভাবে কমপ্লিমেন্ট করতে পারে তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন। এবার হয়তো বিদায়ের পালা। প্রিমিয়ার লিগে খেলার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন অনেক আগেই। তার সাথে যুক্ত হওয়া বিশাল অংকের একটা স্যালারি। তবে তিনি এটাও জানিয়েছেন, আমাকে কিনতে হলে আমাকে ভালো অফার করার সাথে সাথে রিয়াল মাদ্রিদকেও ভালো একটা অফার করতে হবে, না হলে ডিল সম্ভব না।

নিজের ক্যারিয়ারের যখন শুরু তখন টাকাকে পায়ে ঠেলে সাফল্যের জন্য রিয়াল মাদ্রিদে থেকে গিয়েছিল। এখন সাফল্য তার পায়ে এসে পড়েছে। এজন্যই হয়তো এখন বিদায় বলার সময়।

লম্বা জীবনের মাত্র ৩৫ বা তার আশেপাশের বয়স পর্যন্তই হয়ত ফুটবল খেলেন একজন প্রফেশনাল ফুটবলার, এরপর আর সুযোগে থাকে না নতুন করে সেরকম কিছু করার। তাই এই সময়ে টাকা উপার্জন করাটা অনেক বেশি জরুরি। রিয়াল মাদ্রিদ এর চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ বেতন এবং একটা লম্বা সময়ের জন্য চুক্তি তাই আর ফেরাননি এবার। নিজের ক্যারিয়ারকে সাজিয়ে নিয়েছেন। তাই এবার প্রফেশনাল হওয়ার চিন্তায় ছাড়তে চলেছেন নিজের আগলে রাখা সেই ঘর। নতুন এক চ্যালেঞ্জ, যেখানে বাঁচাতে হবে ডুবতে থাকা জাহাজ। সহযোদ্ধা হিসেবে পাবেন নিজের দুই পুরাতন বন্ধু, রোনালদো এবং ভারানেকে।

জানিনা রিয়াল মাদ্রিদ তার রেখে যাওয়া এই জায়গা কিভাবে পূরণ করবে, তবে এটা জানি সে যেখানে যাবে সেখানেও এইভাবেই তার জন্য একটা একটা জায়গা করে নিবে। আগলে রাখবে সেই জায়গা। নিজের নতুন জীবনের জন্য অনেক অনেক শুভকামনা থাকবে ক্যাসেমিরো। তোমার কান্নাভেজা চোখ আমাদের দিয়েছো, আমরাও কান্নাভেজা চোখে তোমাকে বিদায় দেবো। জেনে রেখো, এমন কোন মাদ্রিদ সমর্থক নেই যে তোমার বিদায়ে অন্তরে রক্তক্ষরণ অনুভব করবে না, চোখ দুটো ভিজিয়ে ফেলবে না। তোমাকে ভালোবাসেনি এমন একজন মাদ্রিদিস্তাও নেই। এমন একজন মাদ্রিদিস্তাও নেই যে বলেনি 'ক্যাসেমিরো আছে বলে বেঁচে গেলাম'। আমরা জানি, তুমিও মাদ্রিদকে ভালোবেসেছো, নিজের সবটুকু দিয়েছো।

লেখা: সৌর আলোক রাহা।

এই রকম আরও টপিক

সম্পর্কিত খবর