কোন্দলে বিপর্যস্ত ছাত্রদল, কমিটি গঠন নিয়ে টানাপোড়েন

সংগৃহীত ছবি

কোন্দলে বিপর্যস্ত ছাত্রদল, কমিটি গঠন নিয়ে টানাপোড়েন

আলী আজম

ফের সংকটে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। সংগঠনে নেই শৃঙ্খলা। কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের ৩০২ সদস্যের কমিটির নেতাদের নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ। ইতোমধ্যে অছাত্র, বিবাহিত, ছিনতাইসহ নানা অভিযোগে পদ স্থগিত করা হয়ছে ৩২ নেতার।

দলীয় সূত্র জানায়, পদ স্থগিত  হওয়াদের তালিকায় আরও নতুন নতুন নাম যুক্ত হচ্ছে। যাদের সুপারিশে অভিযুক্তদের ছাত্রদলের কমিটিতে পদ দেওয়া হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে চিঠি দিয়েছেন ছাত্রদলের পদবঞ্চিত নেতাকর্মীরা।  

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কেন্দ্রীয় কমিটিতে সহ-সভাপতি পদ পাওয়া মারুফ এলাহী রনির আপন বড় ভাই ছাত্রলীগের তেজগাঁও থানার সাধারণ সম্পাদক রুবেল এলাহী। যার নেতৃত্বে ২০১৫ সালে কাওরান বাজারে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ওপর হামলার ঘটনা ঘটে।

বর্তমান কমিটিতে স্থান পেয়েছেন দুই সন্তানের জনক গার্মেন্টসে চাকরিরত এ আর খান লিটন। অন্যদিকে মারজুক আহমেদ আল আমিন, ঝলক মিয়া, শেখ আল ফয়সাল ও আনিসুর রহমান আনিচ নামের চার জনকে পদ দেওয়া হয়েছে, যাদের নেই কোনো শিক্ষাগত সনদ। অর্থাৎ তারা মাধ্যমিকই পাস করেননি। বর্তমানে ঘোষিত কমিটির অন্তত ৪০ জন বিবাহিত।  

এবারের কমিটির জন্য বিএনপির পক্ষ থেকে ছাত্রদলের পদ প্রত্যশীদের বয়সসীমা ২০০৩ সালের এসএসসি পরীক্ষা পর্যন্ত নির্ধারণ করা হলেও তা মানা হয়নি। ১৯৯৮, ১৯৯৯, ২০০০, ২০০১ ও ২০০২ সালে এসএসসি পাস করা ব্যক্তিদেরও কমিটিতে পদ দেওয়া হয়েছে। যার নেপথ্যে প্রভাব খাটিয়েছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনৈতিক কমকাণ্ডের জন্য বিতর্কিত ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি কাজী রওনাকুল ইসলাম শ্রাবণ।  

শুধু কেন্দ্রীয় ছাত্রদল নয়, সদ্য ঘোষিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটি নিয়ে ছাত্রদলের অভ্যন্তরে অসন্তোষ চরমে। অভিযোগ উঠেছে, নিজেদের বলয়ের শক্তি বাড়াতে ২০০৮-২০০৯ শিক্ষাবর্ষের খোরশেদ আলম সোহেলকে সভাপতি আর ২০০৯-২০১০ শিক্ষাবর্ষের আরিফুল ইসলামকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে। যারা ২০১৬ সালের পর থেকে ছাত্রদলের রাজনীতিতে নিষ্ক্রীয় ছিলেন।  

এর মধ্যে, আরিফুল ইসলামকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের অধিকাংশ নেতাকর্মী চেনেন না। এমনকি দায়িত্ব পাওয়া নেতাদের বেশিরভাগই যোগ দেননি বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির মিছিলে। এরই মধ্যে ছাত্রীবিষয়ক পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন ছাত্রদল নেত্রী কানেতা-ইয়া-লাম লাম। ঢাবি ছাত্রদলের সাবেক আহ্বায়ক আখতার হোসেন নতুন কমিটি কতটুকু দায়িত্ব পালন করতে পারবে, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন। নতুন দুই  কমিটিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানা হয়নি জেষ্ঠ্যতার শর্ত।  

কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের ছাত্রীবিষয়ক সম্পাদক মানসুরা আলম তার ফেসবুক পোস্টে লেখেন, কমিটির অর্ধেক মানুষকে চিনি না। প্রাইভেট, মহানগর আর দোকানের শাটার বন্ধ করে আসা লোকজনের প্রোটোকলে চলা নেতারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান নষ্ট করবে- এটা কি প্রত্যাশিত! সাংগঠনিক প্রোটোকল বলে কিছু তো আর রাখলো না। সব ধ্বংস করে দিলো টাউট বাটপারেরা! 

আরেক স্ট্যাটাসে তিনি লিখেন, ঘরে বাইরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে রাজনীতি করে আপনি পারবেন না। আর ঘরে আওয়ামী লীগ পুষে বাইরে কার সঙ্গে রাজনীতি করি আমরা? আওয়ামী লীগ আওয়ামী লীগই হয়! ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি কাজী রওনাকুল ইসলাম শ্রাবণের গোটা পরিবার যশোর আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। ছাত্রদলের অভ্যন্তরে এমন কোন্দল নতুন নয়। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পরপরই ছাত্রদলে ‘বলয়ের’ রাজনীতি শুরু হয়। যার শুরুটা করেন আমান উল্লাহ আমান ও ইলিয়াস আলী। দুই নেতার নেতৃত্বে আলাদা বলয়ের রাজনীতি শুরু হয় ছাত্রদলে।  

২০০১ সালে বিএনপি ফের ক্ষমতায় এলে শাহাবুদ্দিন লাল্টু সূচনা করেন নিজস্ব বলয়ের। যার অগ্রভাগে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ‘ক্যাডার’ সাঈদ ইকবাল টিটু। বর্তমানে আমান উল্লাহ আমান ছাত্রদলের রাজনীতিতে খুব একটা সক্রিয় না থাকলেও তার বলয় ধরে রেখেছেন যুবদল সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু। আর গুম হওয়া ইলিয়াস আলীর বলয় এখন পাঁচ ভাগে বিভক্ত। রুহুল কবীর রিজভীর নেতৃত্বে একটি অংশ, হাবিব উন নবী খান সোহেল/রকিবুল ইসলাম বকুলের একটি বলয়, প্রয়াত শফিউল বারী বাবুর অনুসারীদের আরেকটি অংশ, আবদুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েলের নেতৃত্বে আরেকটা অংশ ও আরেক ভাগের নেতৃত্ব দিচ্ছেন আকরামুল হাসান মিন্টু।  

আর বহিস্কৃত শাহাবুদ্দিন লাল্টু অনুসারীদের নেতা এখন নুরুল ইসলাম নয়ন। এসব বলয়ের বাইরে সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্রদলে কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছেন জনৈক কারাবন্দি বিতর্কিত ব্যবসায়ী। প্রকাশ্যে যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন ঢাকা উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হক।

এদিকে এসব বিষয়ে নেতাকর্মীরা বলছেন, সব বলয় নিজেদের লোককে কমিটিতে আনতে দীর্ঘদিন ধরে শীতল যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে ছাত্রদল। যার ফলে বিভিন্ন সময়ে পদবঞ্চিতদের ক্ষোভ দেখা যায় নয়াপল্টনে। কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের শীর্ষ দুই নেতা কাজী রওনাকুল ইসলাম শ্রাবণ বর্তমানে আমিনুল হকের হয়ে কাজ করছেন। আর সাঈফ মাহমুদ জুয়েল কাজ করেন নুরুল ইসলাম নয়নের হয়ে।  

সূত্র জানায়, যার কারণে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটি বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির শীর্ষ পদে বৃহত্তর ইলিয়াস আলী গ্রুপ বা টুকু গ্রুপের কাউকে রাখা হয়নি। যারা নানা পদ পেয়েছেন তাদের ক্ষেত্রে মানা হয়নি জেষ্ঠ্যতা। মূলত এসব অনিয়ম আর ক্ষোভের কারণে ছাত্রদলের বর্তমান কমিটি নিয়ে এত আলোচনা-সমালোচনা।  

তবে এসব বিষয়ে ছাত্রদল সভাপতি বলছেন,  সব অভিযোগের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে। বড় সংগঠনে এমন সমালোচনা নতুন নয়।             
news24bd.tv/আলী