জলবায়ু পরিবর্তন: ইয়াংজির ‘দেবী’কে হারিয়েছে চীন 
জলবায়ু পরিবর্তন: ইয়াংজির ‘দেবী’কে হারিয়েছে চীন 

চর জেগে উঠেছে ইয়াংজি নদীতে।(ছবি: সংগৃহীত)

জলবায়ু পরিবর্তন: ইয়াংজির ‘দেবী’কে হারিয়েছে চীন 

অনলাইন ডেস্ক

এশিয়ার দীর্ঘতম নদী চীনের ইয়াংজি। এ নদীর ডলফিনদের বলা হতো ‘ইয়াংজির দেবী’। বিরল প্রাণীটি স্থানীয় জেলেদের ভাগ্য পরিবর্তন ও সুরক্ষা দেয় বলে বিশ্বাস করেন স্থানীয়রা। তবে অতিরিক্ত মৎস্য আহরণ ও মানবসৃষ্ট কার্যকলাপে নদীটি হারিয়েছে স্থানীয়দের দেবীকে।

গত এক দশক ধরে নদীতে বিরল প্রজাতির এই ডলফিনকে দেখা যাচ্ছে না।   

পৃথিবীতে মাত্র চার থেকে পাঁচ প্রজাতির মিঠাপানির ডলফিন পাওয়া যায়। এর মধ্যে রয়েছে বাইজি ডলফিন, যা ইয়াংজি নদীতে পাওয়া যেত। তবে জলবায়ু পরিবর্তনে প্রায় বিলুপ্ত মিঠাপানির ডলফিনের এ প্রজাতিটি।

দুই দশকের বেশি সময় ধরে ইয়াংজি নদী নিয়ে কাজ করছেন ব্রিটিশ প্রাণী বিজ্ঞানী স্যামুয়েল টার্ভে। এ সময়ে নদীটি থেকে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী খুঁজেছেন তিনি। স্যামুয়েল বলেন, ‘বাইজি বা ইয়াংজি নদীর ডলফিন এক অনন্য এবং সুন্দর প্রাণী ছিল। এর মতো কিছুই ছিল না। ’

‘কয়েক লাখ বছর ধরে পৃথিবীতে বাস করছে প্রাণীটি। পৃথিবীর বিভিন্ন নদীতে ডলফিন আছে, কিন্তু ইয়াংজির দেবী খুবই আলাদা। তাই অন্যগুলোর সঙ্গে এটি মিলানো যাবে না,’ যোগ করেন স্যামুয়েল।

তিনি বলেন, ‘বাইজি ডলফিন হারিয়ে যাওয়া ট্র্যাজেডির থেকে বেশি। এতে করে নদীটির বাস্তুতন্ত্র ও বৈচিত্র্যের বিশাল ক্ষতি হয়েছে। ’

জলবায়ু পরিবর্তনে নদীটির অন্যান্য প্রাণী ও উদ্ভিদের ভবিষ্যৎ বাইজি ডলফিনের মতো হতে পারে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের। এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তারা।

তীব্র তাপদাহে পুড়ছে গোটা বিশ্ব; এর থেকে বাদ যায়নি চীনও। এতে করে শুকিয়ে যাচ্ছে বিশ্বের তৃতীয় দীর্ঘতম নদী ইয়াংজি।

গত জুলাইয়ে সবচেয়ে কম গড় বৃষ্টিপাত দেখেছে চীন। এতে করে নদীটির পানি প্রবাহ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। জেগে উঠেছে পানিতে ডুবে থাকা দ্বীপ।

তিব্বত মালভূমি থেকে উৎপন্ন হয়ে সাংহাই দিয়ে পূর্ব চীন সাগরে মিলেছে ইয়াংজি নদী। এর আগে চীনা ভূখণ্ডের ৬ হাজার ৩০০ কিলোমিটার দিয়ে বয়ে গেছে নদীটি। চীনের দীর্ঘতম এ নদীতে রয়েছে জলবিদ্যুৎকেন্দ্র; যার ওপর নির্ভর করে ৪০ কোটি মানুষ। তবে তাপদাহে সৃষ্ট খরা চীনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নদীটিতে তার বিধ্বংসী প্রভাব ফেলেছে।

নদীটির পানি শুকিয়ে যাওয়ায় এর তীরে গড়ে ওঠা শিল্প-কারখানাগুলো বন্ধ করা হচ্ছে। কারণ ওই সব কারখানায় পানি সরবরাহ হতো ইয়াংজি নদী থেকেই। এ ছাড়া খাদ্য উৎপাদনেও ব্যাপক প্রভাব ফেলছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত চরম আবহাওয়া নদীর আশেপাশে বসবাসকারী ও এর জীব বৈচিত্র্যকে চরম হুমকির মধ্যে ফেলেছে।

পেকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ও পরিবেশবিদ হুয়া ফাংগুয়ান বলেন, ‘জৈব বৈচিত্র্য ও মিঠাপানির বাস্তুতন্ত্রের জন্য ইয়াংজি পৃথিবীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নদী। আমরা এখনও নদীটি থেকে নতুন নতুন প্রজাতির প্রাণী আবিষ্কার করছি। ’

‘নদীটি থেকে অনেক ছোট মাছ ও জলজ প্রাণী বিলুপ্তির পথে। এ সম্পর্কে আমরা খুবই কম জানি,’ যোগ করেন তিনি।

বিলুপ্তির ঝুঁকিতে শত শত প্রজাতি

বছরের পর বছর ধরে ইয়াংজি নদীতে গবেষণা চালিয়ে আসছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা নদীতে থাকা শতশত প্রাণী ও উদ্ভিদের প্রজাতি শনাক্ত ও নথিভুক্ত করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে ডলফিনের আরেক প্রজাতি ফিনলেস পোরপোইস; যা দেখতে বাইজির মতোনই। তবে মানবসৃষ্ট কার্যকলাপে বিলুপ্তির মুখে রয়েছে এই প্রাণীটিও। এ ছাড়া মিঠাপানির চীনা কুমির ও সফট সেল কচ্ছপও বিলুপ্তির হুমকিতে রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা এখন চীনা প্যাডলফিশ এবং স্টার্জনের মতো অনেক দেশীয় স্বাদু পানির প্রজাতির মাছের তীব্র হ্রাস লক্ষ করছেন। বিলুপ্তির উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ উভচর প্রাণী চাইনিজ জায়ান্ট স্যালামান্ডার।

প্রাণীবিজ্ঞানী স্যামুয়েল টার্ভে বলেন, ‘স্যালামান্ডার এখন বিলুপ্তির পথে। সংরক্ষিত প্রজাতি হলেও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এটি বেশি হুমকির মধ্যে রয়েছে। ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক তাপমাত্রা এবং খরা অবশ্যই প্রজাতিটিকে ভালো রাখবে না। ’

‘দীর্ঘদিন ধরে শিকার, বাসস্থানের ক্ষতি এবং দূষণের মতো হুমকির মধ্যে রয়েছে প্রজাতিটি। তবে যখন এর সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন মিশ্রিত হয় তখন প্রজাতিটির বেঁচে থাকার সম্ভাবনা মারাত্মকভাবে কমে যায়,’ যোগ করেন এই প্রাণী বিজ্ঞানী।

বিশ্বের জন্য একটি সমস্যা

প্রাণ ও প্রকৃতি নিয়ে কাজ করে সংগঠন ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড (ডাব্লিউডাব্লিউএফ)। তারা বলছেন, ইয়াংজির দুর্দশা শুধু চীনা জনগণ এবং সরকারের জন্য নয়, বিস্তৃত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্যও একটি প্রধান উদ্বেগের বিষয়।

সংগঠনটির প্রধান বিজ্ঞানী জেফ অপেরম্যান বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে থাকা ঐতিহাসিক নদীগুলোর পানির প্রবাহ নিম্ন স্তরে নেমে এসেছে, যা বাস্তুতন্ত্রে নেতিবাচকভাবে প্রভাব ফেলছে। ’

‘ইয়াংজি নদীর পানি কমে যাওয়া ও উষ্ণ হওয়া মিঠাপানির প্রাণীদের জন্য হুমকিস্বরূপ। নিম্ন নদীর স্তর আশেপাশের হ্রদ ও জলাভূমিতেও প্রভাব ফেলবে,’ যোগ করেন ডাব্লিউডাব্লিউএফের প্রধান বিজ্ঞানী।

পরিবেশ নিয়ে কাজ করা ফাংগিয়ন হুয়া বলেন, ‘চীনের মহান নদীকে রক্ষা করতে আরও জনসচেতনতা ও বৃহত্তর প্রচেষ্টার প্রয়োজন। মানুষকে বেঁচে থাকতে প্রকৃতির ওপর নির্ভর করতে হয় এটা বুঝতে হবে। ’

সূত্র: সিএনএন

news24bd.tv/মামুন