নিম্ন রক্তচাপ যখন সমস্যা

প্রতীকী ছবি

নিম্ন রক্তচাপ যখন সমস্যা

অধ্যাপক ডা. আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী

হাইপোটেনশন বা নিম্ন রক্তচাপ তেমন শারীরিক সমস্যা তৈরি করে না বলে একে রোগ বলা যায় না। তবে কারো রক্তচাপ খুব বেশি কমে গেলে মস্তিষ্ক, কিডনি ও হৃৎপণ্ডে সঠিকভাবে রক্ত প্রবাহিত না হয়ে রোগী শকেও চলে যেতে পারে। অন্য রোগের প্রকাশ হিসেবেও নিম্ন রক্তচাপ হতে পারে। সে ক্ষেত্রে সঠিক কারণ নির্ণয় করে রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখলে ঝুঁকি এড়ানো যায়।

দেহে রক্তের সিসটোলিক চাপ (ওপরেরটা) ১০০ থেকে ১৩০ আর ডায়াসটোলিক (নিচেরটা) ৬০ থেকে ৮০ মিমি পারদ থাকে। এটা রক্তের স্বাভাবিক চাপ। তবে কারো রক্তের সিস্টোলিক চাপ যদি ৯০ মিমি পারদের নিচে এবং ডায়াস্টলিক চাপ ৬০ মিমির নিচে থাকে, সেটি হাইপোটেনশন বা নিম্ন রক্তচাপ।

লক্ষণ
♦  মাথা ঘোরা, দুর্বল লাগা, চোখে ঘোলা দেখা, কাজে অমনোযোগী হওয়া।


♦   ঘন ঘন বা দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া বা হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া।
♦   খুব বেশি তৃষ্ণা অনুভূত হওয়া।
♦   নাড়ি বা পালসের গতি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়া।
♦   বুকে ব্যথা, মাথা ব্যথা ইত্যাদি।

কারণ
♦   দেহে রক্তের পরিমাণ কমে যাওয়া বা রক্তস্বল্পতা।
♦   ঠিকমতো না খাওয়া বা খুব বেশি উপোস থাকা।
♦   অপর্যাপ্ত তরল গ্রহণ, বমি, ডায়রিয়াসহ যেকোনো কারণে পানিশূন্যতা।
♦   অতিরিক্ত পরিশ্রম, দুশ্চিন্তা, ভয় বা স্নায়ুর দুর্বলতা।
♦   হরমোনের তারতম্য (এডিসন্স ডিজিস)।
♦   অ্যালার্জির কারণে রক্ত বহনকারী শিরার প্রশস্ততা বেড়ে যাওয়া (এনাফাইলেকটিক শক)।
♦   হার্ট অ্যাটাক হওয়া বা হার্ট পাম্প করতে না পারা।
♦   ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। অর্থাৎ কেউ হয়তো উচ্চ রক্তচাপের বা হার্ট অ্যাটাকের রোগী। সে ওষুধ খাচ্ছে; কিন্তু সেই ওষুধ পরিমাণে হয়তো বেশি হয়ে যাচ্ছে। তখন তার এটা হতে পারে। এসব কারণে হাইপোটেনশন হলে ওষুধের পরিমাণ কমাতে হবে। সেটি হলে পরে রক্তচাপ স্বাভাবিক হয়ে আসে।
♦   হার্ট ফেইলিওর, মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন, হূিপণ্ডের ভাল্ভ সমস্যা কিংবা খুব কম হার্ট রেট (ব্রাডিকার্ডিয়া)।

চিকিৎসা নিতে হবে আসল কারণের
কারো কারো ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবে প্রেসার কম থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে তিনি যদি কোনো অসুবিধা অনুভব না করেন, তবে এটা তাঁর জন্য স্বাভাবিক। নিম্ন রক্তচাপ নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। যেহেতু এটা কোনো রোগ নয়, তাই এদের ক্ষেত্রে একে রোগ বানানো কিংবা চিকিৎসারও দরকার নেই। হাইপোটেনশন হলো অন্য রোগের প্রকাশ।  

কারো রক্তচাপ নিচের দিকে থাকলে তার বরং কার্ডিয়াক সমস্যা কম হয়। তবে রক্তচাপ খুব বেশি কমে গিয়ে কারো সমস্যা তৈরি হলে সমস্যার কারণগুলো চিহ্নিত করে চিকিৎসা নিতে হবে। অর্থাৎ কারো হয়তো ডায়রিয়া হয়ে শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দিল, সে ক্ষেত্রে ডায়রিয়ার চিকিৎসা দিতে হবে। কারো হয়তো অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়েছে, সে ক্ষেত্রে রক্ত দিয়ে তা পূরণ করতে হবে। কারো হয়তো হরমোনের তারতম্য ঘটেছে, সে ক্ষেত্রে হরমোনের চিকিৎসা দিতে হবে। কেউ হয়তো বেশি অপুষ্টিতে ভুগছে, সে ক্ষেত্রে পুষ্টিহীনতার চিকিৎসা দিতে হবে। মোটকথা, যেসব কারণে নিম্ন রক্তচাপ হয়ে সমস্যা তৈরি হচ্ছে, সর্বাগ্রে তার কারণ নির্ণয় করে চিকিৎসা নিতে হবে।

হঠাৎ নিম্ন রক্তচাপ হলে করণীয়
কারো হয়তো হঠাৎ নিম্ন রক্তচাপ ধরা পড়ল বা প্রেসার কমে গেল। সে ক্ষেত্রে যত দ্রুত সম্ভব তার শরীরে পর্যাপ্ত ফ্লুইড প্রবেশ করাতে হবে। এটি ডাব, স্যালাইন, চা, পানি, দুধ বা অন্য যা কিছুই হোক না কেন। তাত্ক্ষণিকভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তাকে পানীয় জাতীয় কিছু খেতে দেওয়া বা যেকোনোভাবেই হোক, শরীরে জলীয় অংশের পরিমাণ বাড়ানো। এতে কিছুক্ষণ পর দেখা যাবে, রক্তচাপ স্বাভাবিক হয়ে আসছে।

প্রতিরোধে করণীয়
♦   মাঝেমধ্যে হালকা খাবার খাওয়া। বেশি সময় উপোস বা খালি পেটে না থাকা।
♦   অনেকক্ষণ একই স্থানে বসা বা শুয়ে থাকার পর সাবধানে ও ধীরে ওঠা।
♦   পুষ্টিকর খাবার, বিশেষ করে খাবারে আলু, ডিম, মাছ, মাংস, ছানা, বাদাম, সবুজ শাক নিয়মিত রাখা।
♦   খাদ্যতালিকায় লবণ স্বাভাবিক রাখা।
♦   পর্যাপ্ত পানি পান, পর্যাপ্ত বিশ্রাম, হালকা ব্যায়াম করা।
♦   ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখা।
♦   বমি বা ডায়রিয়া হলে শরীরে পানির ভারসাম্য যাতে বহাল থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

ভুল রক্তচাপ নির্ণয় থেকে সাবধান!
আমাদের দেশের ব্লাড প্রেসার বা রক্তচাপ মাপার মেশিনগুলোর বেশির ভাগই (৯০ শতাংশ) সঠিক মিটার রিডিং দেয় না। সিসটোলিক প্রেসার ২০ থেকে ৩০ মিমি মার্কারি কম আসতে পারে। ডায়াস্টোলিক প্রেসার ১০ থেকে ১৫ মিমি মার্কারি পর্যন্ত কম রেকর্ড হয়। এ ক্ষেত্রে সন্দেহ হলে যথাসম্ভব সঠিক মেশিনে মাঝেমধ্যে রক্তচাপ মেপে দেখা জরুরি। সরকারেরও উচিত দেশে প্রাপ্ত মেশিনগুলোর কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্সের বিষয়টি নিশ্চিত করা। রক্তচাপ অতিরিক্ত কম বা বেশি হলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

লেখক : হৃদরোগ বিভাগের প্রধান 
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ