আউলিয়াঘাট বদেশ্বরি মন্দিরে যাওয়ার পথে ঘটে দুর্ঘটনা

সংগৃহীত ছবি

করতোয়ায় নৌকাডুবি 

আউলিয়াঘাট বদেশ্বরি মন্দিরে যাওয়ার পথে ঘটে দুর্ঘটনা

সরকার হায়দার

পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার মাড়েয়া বামন পাড়া ইউনিয়নের ঐতিহাসিক আউলিয়া ঘাট ও বদেশ্বরী মন্দিরের ইতিহাসের সাথে যোগ হলো আরেকটি মর্মান্তিক ইতিহাস। সেইসাথে স্থাপিত হলো হাজার বছর ধরে বহমান বাঙ্গালী সংস্কৃতির ঐতিহ্য সম্প্রীতির অনন্য এক দৃষ্টান্ত।

দীর্ঘকালের মতো গত ২৫ সেপ্টেম্বর মহালয়ার দিনে বদেশ্বরী মন্দিরে পূজা অর্চনা করতে যাচ্ছিলেন সনাতন ধর্মীয় হাজারো মানুষ। করতোয়ার ওপারেই বদেশ্বরী মন্দির।

আউলিয়ার ঘাটে নৌকায় পার হয়ে যেতে হয় মন্দিরে। পূজার আনন্দ আর আবেগে ৫০ জনের নৌকায় চড়েছিলেন শতাধিক মানুষ। পুরনো নৌকাটি সে ভার সইতে পারেনি। মাঝ নদীতেই উল্টে যায়।
পানিতে ডুবে যায় সকল পুর্ণার্থী। মৃত্যু বরণ করেন ৬৯ জন । তিন জন এখনো নিখোঁজ। ১ জন বাদে সবাই ছিলেন সনাতন ধর্মীয়। ভাগ্যক্রমে বাকিরা বেঁচে যান।  পানিতে ডুবতে থাকা এসব মানুষকে উদ্ধার করতে নদীতে নেমে পড়ে স্থানীয় শত মানুষ। তারা সবাই মুসলমান। কাওকে জীবিত উদ্ধার করে তারা। মৃত্যুবরণ করা মানুষের মরদেহ উদ্ধার করে।
 
বিখ্যাত আউলিয়ার ঘাট এবং বদেশ্বরী মন্দিরের রয়েছে সুপ্রাচীন ইতিহাস। হিন্দু মুসলিমের এই দুই তীর্থ স্থানে প্রতিবছর শত শত পর্যটক বেড়াতে আসেন। বদেশ্বরী মন্দিরে বছরের নানা সময় চলে পূজা-পার্বণ। আউলিয়ার ঘাটে হয় ইসালে সওয়াব। আউলিয়ার ঘাট থেকে বদেশ্বরী মন্দিরের দূরত্ব এক কিলোমিটার।

কথিত আছে বারো আউলিয়ার মধ্যে একজন আউলিয়া এসেছিলেন আউলিয়ার ঘাটে। একজন দরবেশের মাজারও ছিলো। করতোয়া ঘোড়ামাড়া নদীর মিলন স্থলে আছে ত্রীবহতা স্রোত। তার পরেই দ্বীপের মতো একটি ডাঙ্গায় ছিলো ওই দরবেশের মাজার। বয়স্করা বলছেন, সেই সময় নদী ভাঙ্গন শুরু হলে ওই আউলিয়া এখানে আসেন। তিনি জাফরান কালি দিয়ে পানির নবী খোয়াজ খেজুরকে চিঠি লিখেন। চিঠিটা নদীতে ভাসবার কথা থাকলেও তা চলে যায় নদীর গভীরে। স্থানীয় বয়স্করা কেউই আউলিয়া এবং দরবেশের নাম জানাতে পারেননি। বর্তমানে সেই মাজারও নেই । নদী ভাঙ্গনে বিলীন হয়ে গেলেও মাজার নিয়ে রয়েছে নানা ধরনের মিথ।

জানা যায়, পাল বংশের আমলে বদেশ্বরী মন্দিরের কারুকার্যময় ভবন নির্মিত হয়। এই ভবন এখনো বিদ্যমান। হিন্দুধর্মের স্কন্দ পুরাণ মতে, একটি যজ্ঞানুষ্ঠান করেছিলেন রাজা দশরথ। তার জামাই ছিলে ভোলানাথ শিব। শিবকে জামাই হিসেবে মানতে পারেননি রাজা দশরথ। কারণ, শিব সর্বদাই ছিলেন উদাসীন এবং নেশাগ্রস্থ ও ধ্যানগ্রস্থ। ভোলানাথ শিব দেবী দুর্গা (পার্বতী/মহামায়া)-র স্বামী । তাকে নিমন্ত্রিত করা হয়নি এমন কথা শুনে ক্ষোভে যজ্ঞেই আত্মাহুতি দেন দেবী দুর্গা বা পার্বতী। সহধর্মিণীর মৃত্যুযন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে উন্মাদ হয়ে যায় শিব। সহধর্মিণীর শবদেহ কাঁধে নিয়ে পৃথিবীর সবখানে উন্মাদের মত ঘুরতে থাকেন তিনি। একসময় প্রলয়ের সৃষ্টি করেন। স্বর্গের রাজা বিষ্ণুদেব এটা সহ্য করতে পারেননি। তিনি স্বর্গ থেকে একটি দুদর্শনচক্র নিক্ষেপ করেন। চক্রের স্পর্শে শবদেহটি ৫১টি খণ্ডে বিভক্ত হয়। এই খণ্ডগুলি নানা স্থানে পড়ে।  বাংলাদেশে পড়ে এর ২টি খণ্ড। একটি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড এবং অপরটি পঞ্চগড় জেলার বদেশ্বরীতে। মহামায়ার খণ্ডিত অংশ যেখানে পড়েছে তাকে পীঠ বলা হয়। বদেশ্বরী মহাপীঠ এরই একটি। তাই বদেশ্বরী মন্দির হিন্দু ধর্মালম্বিদের কাছে তীর্থ স্থান। ৫’শ বছর আগে নির্মিত এই মন্দিরের নামে বোদা উপজেলার নামকরণ হয়েছে বলে ইতিহাসবিদদের ধারনা।  

বৌদ্ধ ও হিন্দু অধ্যুষিত ছিল এই জনপদ। বগুড়ার মহাস্থান গড়ে প্রাপ্ত ওই সময়কার শিলালিপি এবং ইতিহাস থেকে জানা যায়, তিব্বত অভিযানে ব্যর্থ ইখতিয়ারউদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজি অহমীয়া দস্যুদের আক্রমণের ভয়ে পালিয়ে আসছিলেন। পথিমধ্যে ঘোড়ামাড়া নদী পাড়ি দেবার সময় খিলজির সঙ্গী তুর্কি ঘোড়সওয়ার বাহিনী পানিতে ডুবে যায়। অনেক সৈন্য ঘোড়া সহ পানিতে ডুবে মারা যায়। বেঁচে যাওয়া অবশিষ্ট সৈন্য নিয়ে খিলজি করতোয়া তীরের জঙ্গলে একটি ভাঙা মন্দিরে আশ্রয় নেন । পাল রাজারা মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বদেশ্বরীতে নির্মাণ করেন দুর্গ।  

বদেশ্বরী মন্দির দেখতে প্রতিবছর অসংখ্য পর্যটক আসেন। কিন্তু মন্দিরের সংরক্ষণে উদ্যোগ স্বল্পতা রয়েছে। আউলিয়ার ঘাটের ঐতিহ্য আছে। আছে দৃষ্টি নন্দন প্রাকৃতিক পরিবেশ। এই ঘাটে গড়ে উঠতে পারে পর্যটন স্পট।  
বদেশ্বরী মন্দির আর আউলিয়ার ঘাট এখন শোকে স্তব্ধ। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ আসছেন নৌকাডুবির ঘটনাস্থল দেখতে। তারপর করুণ মুখে ফিরে যাচ্ছেন ঘরে।

news24bd.tv/আজিজ