রাশিয়ার ওপর পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা কতটা কার্যকর?

সংগৃহীত ছবি

রাশিয়ার ওপর পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা কতটা কার্যকর?

অনলাইন ডেস্ক

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ২৪ তারিখে ইউক্রেনে সামরিক অভিযান চালায় রাশিয়া। এর পরেই দেশ দুটির মধ্যে শুরু হয় যুদ্ধ। রাশিয়ার এ আগ্রাসনের পর থেকেই মস্কোর ওপর একের পর এক অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিতে থাকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা।

যুদ্ধের জেরে ইউরোপের দেশগুলো নিয়ে গঠিত ‘কাউন্সিল অব ইউরোপ’ থেকে বাদ পড়ে রাশিয়া।

এমনকি বিভিন্ন পশ্চিমা দেশ তাদের সেখানে নিযুক্ত রুশ দূতকে বহিষ্কার করে।

রাশিয়ার বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ঊর্ধ্বতন ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে পশ্চিমারা। যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ ভূখণ্ডে তাদের ঢুকতে না দেওয়াসহ ট্রানজিট না দিতেই রুশদের ওপর এসব নিষেধাজ্ঞা দেয়।

অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাগুলোর মধ্যে ছিল পশ্চিমা ভূখণ্ডে রাশিয়ার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা।

রাশিয়ার সাতটি ব্যাংকে আর্থিক লেনদেনের বার্তা আদান-প্রদানকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান সুইফট পেমেন্ট নেটওয়ার্ক থেকে বাদ দেয়া হয়েছে।  

পশ্চিমারা তাদের দেশে থাকা রাশিয়ার প্রায় অর্ধেক বৈদেশিক মুদ্রা অর্থাৎ ৩১ হাজার ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার জব্দ করেছে। এমনকি রাশিয়াতে পণ্য আমদানি ও রপ্তানিতে কঠোর হয়েছে।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ রাশিয়া থেকে দ্বৈত ব্যবহার যোগ্য এবং প্রযুক্তিগত পণ্য রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে কাঠ জাতীয় পণ্য, লোহা ও ইস্পাতজাত পণ্য, কাচ, বৈদ্যুতিক সরঞ্জামসহ কারখানায় ব্যবহৃত বিভিন্ন পণ্য।

প্রায় আট মাস ছুঁই ছুঁই হলেও এখনও ইউক্রেন ভূখণ্ডে যুদ্ধ চলছে। ইতোমধ্যে ইউক্রেনীয় বাহিনী তাদের কিছু ভূখণ্ড রুশদের থেকে পুনরূদ্ধারে সক্ষম হয়েছে বলে দাবি দেশটির। তবে যুদ্ধের সময়সীমা দীর্ঘ হবে এমনটা বোঝা যাচ্ছে। তার মানে কি রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা কাজ করছে না?

নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতা মূল্যায়ন করা কঠিন

চলতি মাসের শুরুর দিকে রাশিয়ার ভ্লাদিভস্টোক শহরে এক অর্থনৈতিক ফোরামে বক্তৃতা দেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। সেখানে তিনি দাবি করেন, তার দেশ পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক ‘আগ্রাসন’ ভালোভাবে মোকাবেলা করেছে। তিনি সতর্ক করে বলেছিলেন, পশ্চিমাদের কাঙ্ক্ষিত প্রভাবের পরিবর্তে, নিষেধাজ্ঞাগুলো ইউরোপীয়দের জীবনযাত্রার মান নষ্ট করছে এবং দরিদ্র দেশগুলো খাদ্য আমদানির যোগ্যতা হারাচ্ছে।

রাশিয়ার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে পুতিনের কথার সঙ্গে সম্পূর্ণ ভিন্নমত ইইউর। পশ্চিমাদের এই জোটের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেইনের মতে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে দেয়া নিষেধাজ্ঞাগুলো অনেক কঠিন। গত সপ্তাহে ফ্রান্সের স্ট্রাসবার্গ শহরে তিনি দাবি করেছিলেন যে নিষেধাজ্ঞাগুলো কার্যকর হয়েছে এবং রাশিয়ার আর্থিক খাত ‘লাইফ সাপোর্টে’ রয়েছে।

এ দুই দলের ভিন্ন মতের সবকিছু সঠিক না হলেও কিছুটা সত্যতা পাওয়া যায়। কিন্তু এই পর্যায়ে নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতার একটি সঠিক অভিজ্ঞতামূলক মূল্যায়ন করা দুটি কারণে কঠিন। এর একটি সময়সীমা ও অন্যটি সঠিক তথ্যের অভাব।

অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার প্রভাব মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সাত মাস পর্যাপ্ত সময় নয়। অর্থনীতিবিদদের বিশ্বাস, ২০২২ শেষ হলেও নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে বিতর্ক থেকে যাবে। আর দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হল, নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে তথ্য পাওয়া।

নিষেধাজ্ঞার প্রভাব পরিমাপ করার জন্য সাধারণভাবে দেশটির জিডিপি দেখা হয়; রাশিয়ার ক্ষেত্রেও এমনটা করা হচ্ছে। গত এপ্রিলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ২০২২ সালে রাশিয়ান জিডিপি ৮ দশমিক ৫ শতাংশ হ্রাস পাবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছিল। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের ধারণা পাল্টাচ্ছে আইএমএফ। নতুন আউটলুকে তারা বলছে, চলতি বছরের শেষ পর্যন্ত দেশটির জিডিপির ৬ শতাংশের মতো হ্রাস পাবে। একই অবস্থা মুদ্রাস্ফীতিতেও।

রাশিয়া ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী আন্দ্রেই বেলোসভের মতে, ২০২২ সালে রাশিয়ায় মুদ্রাস্ফীতি ১২ থেকে ১৩ শতাংশতে থাকবে। তবে প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। রাশিয়ায় গাড়ি বিক্রির দিকে নজর দিলেই মুদ্রাস্ফীতির দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ পাওয়া যায়।

২০২২ সালের মার্চে রাশিয়ায় গাড়ি বিক্রির পরিমাণ গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এক তৃতীয়াংশ পর্যন্ত কমেছে। আর গত বছরের তুলনায় সেপ্টেম্বরে গাড়ির উৎপাদন কমেছে তিন-চতুর্থাংশ।

একই অবস্থা দেখা যাচ্ছে রাশিয়ার উড়োজাহাজ শিল্পে। যন্ত্রাংশের অভাবে অনেকগুলো উড়োজাহাজ গ্রাউন্ডে রেখেছে রাশিয়ান এয়ারলাইন অ্যারোফ্লট। এমনকি চিপের অভাবে কাজ করতে পারছে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী। বাধ্য হয়ে ডিশওয়াশার ও রেফ্রিজারেটর থেকে চিপ খুলে ব্যবহার করছে তারা।

এর মানে দাঁড়ায় পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাগুলো কাজ করছে। তথ্যানুসারে, আগের বছরের  তুলনায় ২০২২ সালের এপ্রিলে রাশিয়ায় আমদানি ৭০-৮০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। তবে এটি ভুলে গেলে চলবে নিষেধাজ্ঞা একটি দ্বি-ধারী তলোয়ার।

নিষেধাজ্ঞার বিপরীত প্রভাব

পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞার পর থেকেই পাল্টা ব্যবস্থা নিচ্ছে রাশিয়া। মস্কো যে পাল্টা ব্যবস্থা নিতে পারে এমনটা মাথায় নেয়নি পশ্চিমা নীতি নির্ধারকরা। এ বিষয়ে একটি প্রধান উদাহরণ হল দ্রুতগতিতে জ্বালানির দাম বাড়া।

রাশিয়ার গ্যাসের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল ইউরোপের দেশগুলো। এ অঞ্চলের মোট চাহিদার ৪০ শতাংশ আসে রাশিয়া থেকে। নিষেধাজ্ঞার জেরে গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দেয় মস্কো। দাম বাড়তে থাকে এই জ্বালানির। সামনের শীতে ব্ল্যাকআউটের শঙ্কায় রয়েছে ইইউর কয়েকটি দেশ।

গ্যাসের সংকটে ইউরোপের দেশগুলোতে পারিবারিক খরচ ব্যাপকভাবে বেড়েছে। জার্মানি, ফ্রান্স ও ইতালির মতো দেশগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার গ্যাসের জন্য চলতি বছরে জার্মানির জিডিপি ৩ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে বলে পূর্ভাবাস দিয়েছে বিশ্লেষকরা।

অর্থনৈতিকভাবে সমস্যা হলেও এখনও ইউরোপের ৭৮ শতাংশ জনগণ রাশিয়ার বিরুদ্ধে দেয়া নিষেধাজ্ঞাগুলোকে সমর্থন করছে। কিন্তু অনেকে আবার এর বিপক্ষে রয়েছে। ৫১ শতাংশ জার্মানির নাগরিক বিশ্বাস করে, নিষেধাজ্ঞাগুলো আসলে রাশিয়ার চেয়ে জার্মানিকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

নিষেধাজ্ঞাগুলো ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বন্ধ করতে পারেনি। আরও শক্তিশালী অবস্থানে যাচ্ছেন পুতিন। এর মানে দাঁড়ায়, নিষেধাজ্ঞাগুলো স্বল্পমেয়াদী ব্যাঘাত করবে পশ্চিমাদের এমন প্রত্যাশার চেয়ে কম। তবে রাশিয়ার অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য চাপের প্রাথমিক লক্ষণ রয়েছে। সম্ভবত এই চাপ ২০২৩ এবং তার পরেও তীব্র হবে।

সূত্র: এশিয়ান টাইমস

news24bd.tv/মামুন