একতরফা নির্বাচনেও ৯ জেলা পরিষদে হেরেছে আ. লীগ

সংগৃহীত ছবি

একতরফা নির্বাচনেও ৯ জেলা পরিষদে হেরেছে আ. লীগ

জেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটে ছিল না বিএনপিসহ বেশির ভাগ বিরোধী দল। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ২৫ জন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। বাকি ৩৪ জেলায় একতরফা নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা ৯ জেলায় হেরেছেন।  

ওই সব জেলায় বিজয়ীদের মধ্যে ছয়জন বিদ্রোহী, একজন জাতীয় পার্টির (জাপা) ও তিনজন স্বতন্ত্র প্রার্থী।

বিদ্রোহীরা সবাই আওয়ামী লীগের নেতা। তাঁরা কোনো না কোনো মন্ত্রী-সংসদ সদস্যের সমর্থিত প্রার্থী ছিলেন।

সোমবার (১৭ অক্টোবর) দেশের ৫৭ জেলা পরিষদে নির্বাচন হয়। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া চেয়ারম্যানদের জেলাগুলোতে (২৫) সদস্য পদগুলোতে নির্বাচন হয়।

এবার সব মিলিয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থিত চেয়ারম্যান হয়েছেন ৪৯ জন। আওয়ামী লীগের বাইরে দিনাজপুরে জাতীয় পার্টির নেতা দেলওয়ার হোসেন নির্বাচিত হন। ঝিনাইদহে হারুন অর রশিদ এবং পঞ্চগড়ে আওয়ামী লীগ ঘরানার ব্যবসায়ী জেলা চেম্বারের সভাপতি আব্দুল হান্নান শেখ স্বতন্ত্র নির্বাচন করে বিজয়ী হয়েছেন।

বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় বেশির ভাগ জেলায় আওয়ামী লীগের দলীয় সমর্থিত প্রার্থীর বাইরেও দলের নেতারা বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন। ফলে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে।    

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে স্থানীয়ভাবে বেশ কিছু জেলায় দ্বন্দ্ব-কোন্দল প্রকাশ্যে দেখা দেয়। ভোটের ফলাফলেও তার প্রমাণ মিলেছে। স্থানীয় প্রভাব ধরে রাখতে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন অনেকে, জয়ী হয়েছেন বেশ কয়েকজন।

আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনেক জেলায় বিএনপি-জামায়াতের প্রতিনিধিরা আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীকে বিজয়ী করতে কাজ করেছেন। স্থানীয় নির্বাচনে বিএনপি দলীয়ভাবে অংশ না নিলেও তাদের অনেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে বিজয়ী হয়েছেন। আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীকে হারাতে তাঁরা ভূমিকা রেখেছেন।

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে টাকা লেনদেনের অভিযোগ ওঠে। মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের অনেকেই আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন। ভোটার সংখ্যা কম হওয়ায় প্রার্থীদের অনেকেই টাকা দিয়ে ভোট কেনার চেষ্টা করেন। ভোটের আগের দিনও হামলা, ভাঙচুর ও গুলির ঘটনা ঘটেছে।

ভোটকক্ষে মেয়রের ফেসবুক লাইভ, বাগবিতণ্ডা: বরিশাল সরকারি জিলা স্কুল কেন্দ্রে গিয়ে ফেসবুক লাইভ করেন সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ। তাঁর সঙ্গে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত বরিশাল জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়রসহ অন্তত চার-পাঁচজন কাউন্সিলর ছিলেন।

কেন্দ্রের ১ নম্বর ভোটকক্ষে প্রবেশের সময় বরিশাল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মনিরুজ্জামান মেয়রকে ‘দল বেঁধে’ ভোটকক্ষে প্রবেশ না করতে অনুরোধ করেন। এ সময় ইউএনওর সঙ্গে তাঁর বাগবিতণ্ডা হয়।

নাটোরে সংসদ সদস্য ও পৌর মেয়রের আচরণবিধি লঙ্ঘন: নির্বাচনে নাটোর-২ আসনের সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুল নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করে দিঘাপতিয়া এমকে কলেজ কেন্দ্রের ভেতরে প্রবেশ করেন বলে অভিযোগ ওঠে। তাঁর সঙ্গে দলীয় নেতাকর্মীরাও ছিলেন। অন্যদিকে সিংড়া গোলই আফরোজ ভোটকেন্দ্রে সিংড়া পৌর মেয়র এবং সিংড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জান্নাতুল ফেরদৌস চেয়ারম্যান-মেম্বারদেরসহ ভোটারদের একটি বড় অংশ নিয়ে ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করেন। নেতাকর্মীদের নিয়ে ভোট দিয়ে বের হয়ে যান তিনি।

সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুল ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, গণভবনে একটি নির্ধারিত কর্মসূচিতে যাওয়ার পথে অনেক লোকজন দেখে অল্প সময়ের জন্য শুভেচ্ছাবিনিময় করে চলে আসেন। কেন্দ্রের ভেতরে প্রবেশ করেননি।

বগুড়ায় দল বেঁধে ভোট দিয়েছেন বিএনপি প্রতিনিধিরা: দলীয়ভাবে নির্বাচন বর্জন করলেও বগুড়ায় বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের ভোটাররা ভোট দিয়েছেন। ভোট দেয় তাদের শরিক জামায়াতও। তবে দলের শাস্তির ভয়ে অনেকেই ভোট দিলেও বিষয়টি অস্বীকার করছেন। বগুড়া জেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে দুজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।

কুষ্টিয়ায় সড়ক অবরোধ : কুষ্টিয়া জেলা পরিষদ নির্বাচনে সদরের জিলা স্কুল কেন্দ্রের ফলাফলে পরাজিত সদস্য প্রার্থী মামুনুর রশিদের সমর্থকরা নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনে মহাসড়ক অবরোধ, গাড়ি ভাঙচুর ও বিক্ষোভ করে। গতকাল বিকেল পৌনে ৩টার দিকে এ ঘটনা ঘটে।

প্রার্থী নিজেই পোলিং এজেন্ট : নাটোরে দিঘাপতিয়া এমকে কলেজ ভোটকেন্দ্রে তালা প্রতীকের সাধারণ সদস্য প্রার্থী আনোয়ার পারভেজ নিজেই পোলিং এজেন্টের দায়িত্ব পালন করছিলেন। ভোট শুরুর ঘণ্টাখানেক পর ডিসি শামীম আহমেদ ও এসপি সাইফুর রহমান এসে আনোয়ার পারভেজকে কেন্দ্র থেকে বের করে দেন।

ভোট দেখতে গিয়ে কুমিল্লায় যুবকের মৃত্যু : কুমিল্লার জেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোট দেখতে গিয়ে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল সকালে জেলার বুড়িচং উপজেলা পরিষদের সামনে তাঁর মৃত্যু হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন উপজেলার ময়নামতী ইউপি চেয়ারম্যান লালন হায়দার। মৃত রাশেদুল ইসলাম (৩৫) উপজেলার সিন্ধুরিয়াপাড়া গ্রামের আবদুল জলিলের ছেলে।

এই নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। তাঁদের ভোটে জেলা পরিষদের একজন চেয়ারম্যান, ১৫ জন সাধারণ সদস্য ও পাঁচজন সংরক্ষিত নারী সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।

দেশে দ্বিতীয়বাবের মতো জেলা পরিষদের নির্বাচনে ভোট নেওয়া হয় ইভিএমে। নির্বাচন কমিশন ঢাকা থেকে সিসিটিভির মাধ্যমে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে।

ভোটে চেয়ারম্যান হলেন যাঁরা : শাহাদাত হোসেন (ফরিদপুর-বিদ্রোহী), শফিকুল মোরশেদ আরজু (রাজবাড়ী), মনির হোসেন ভূঁইয়া (নরসিংদী-বিদ্রোহী), শেখ হারুনুর রশীদ (খুলনা), গোলাম মহিউদ্দীন (মানিকগঞ্জ), আবু বকর সিদ্দিক (গাইবান্ধা), আব্দুল হান্নান শেখ (পঞ্চগড়-স্বতন্ত্র), সাইফুজ্জামান পিকুল (যশোর), ইউসুফ পাঠান (ময়মনসিংহ), অসিত কুমার সরকার (নেত্রকোনা), সুবাস চন্দ্র বোস (নড়াইল), মকবুল হোসেন (বগুড়া), হুমায়ুন কবির (শেরপুর-বিদ্রোহী), নজরুল ইসলাম (সাতক্ষীরা), সাজেদুর রহমান (নাটোর), মোতাহার হোসেন (গাজীপুর), খাজা সামছুল আলম (জয়পুরহাট), মাহফুজুর রহমান মনজু (চুয়াডাঙ্গা), জিল্লুর রহমান (কিশোরগঞ্জ), হাফিজুর রহমান (পটুয়াখালী-বিদ্রোহী), নুরুল হুদা মুকুট (সুনামগঞ্জ-বিদ্রোহী), আব্দুস সালাম (মেহেরপুর), আল মামুন সরকার (ব্রাহ্মণবাড়িয়া), মোছাদ্দেক হোসেন বাবলু (রংপুর-বিদ্রোহী), মমতাজুল হক (নীলফামারী), মুশফিক হোসেন চৌধুরী (হবিগঞ্জ), ওচমান গণি পাটওয়ারী (চাঁদপুর-উন্মুক্ত), হারুন অর রশীদ (ঝিনাইদহ-স্বতন্ত্র), শাহিনুল হক মার্শাল (কক্সবাজার-বিদ্রোহী), দেলওয়ার হোসেন (দিনাজপুর-জাতীয় পার্টি), পেয়ারুল ইমলাম (চট্টগ্রাম), পঙ্কজ কুমার কুণ্ডু (মাগুরা), সদর উদ্দিন (কুষ্টিয়া), মীর ইকবাল (রাজশাহী)।

ইসি সূত্রে জানা যায়, এবারে জেলা পরিষদ নির্বাচনে ২৫ জেলায় চেয়ারম্যান পদ ছাড়াও নারীদের জন্য সংরক্ষিত পদে ১৯ জন এবং সাধারণ সদস্য পদে ৬৯ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। তিন পার্বত্য জেলা বাদে দেশের ৬১টি জেলা পরিষদে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছিল। এর মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নোয়াখালী জেলা পরিষদ নির্বাচন আদালতের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে। ভোলা ও ফেনী জেলা পরিষদের সব পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় এই দুই জেলায় ভোটের প্রয়োজন হয়নি।

যেসব জেলায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান : কুমিল্লা, কুড়িগ্রাম, গোপালগঞ্জ, জামালপুর, ঝালকাঠি, টাঙ্গাইল, ঠাকুরগাঁও, ঢাকা, নওগাঁ, নারায়ণগঞ্জ, পাবনা, পিরোজপুর, ফেনী, বরগুনা, বরিশাল, বাগেরহাট, ভোলা, মাদারীপুর, মুন্সীগঞ্জ, মৌলভীবাজার, লক্ষ্মীপুর, লালমনিরহাট, শরীয়তপুর, সিরাজগঞ্জ ও সিলেট। news24bd.tv/ইস্রাফিল