বঙ্গবন্ধু বাংলার, বঙ্গবন্ধু মানুষের 

বঙ্গবন্ধু বাংলার, বঙ্গবন্ধু মানুষের 

শাব্বীর রহমান

“যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, তার তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখব, আমরা অ্যাসেম্বলিতে বসতে পারব কি পারব না। এর আগে আমি অ্যাসেম্বলিতে বসতে পারব না।

জনগণ আমাকে সে অধিকার দেয় নাই। “

এই কথা শেষ হতে না হতেই, তুমুল করতালি আর হর্ষধ্বনিতে ফেটে পড়ছিল বাঁশের লাঠি হাতে ধরে রাখা সংগ্রামী বাঙ্গালি জনতা। চিৎকারে বিদীর্ণ করে তুলছিল গোটা রেসকোর্স ময়দান (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)। ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ভাষণগুলোর মধ্যে একটি ভাষণ এর অংশ এটি।

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চ এর ভাষণ। এই অংশটুকুর মাঝে যে শক্তি, যে অর্থ আর যে গভীরতা, তা আসলে স্বাধীন বাংলার বিকাশে অপরিমেয় গুরুত্ব বহন করে। বঙ্গবন্ধুর মুখের কথাই ছিল একটি রাষ্ট্রের শুন্য থেকে বেড়ে ওঠার মন্ত্র।               

পাক শকুনের দলের হিংস্র আঁচরে যখন বাংলার নিরীহ জনপদ রক্তাক্ত, নিরীহ, শান্তিপ্রিয় বাঙালিকে তাঁতিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন, অপ্রতিরোধ্য হয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ''আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না। " বঙ্গবন্ধু বাংলার বাজারে বাজারে ঘুরে মুক্তির ঘ্রাণ বিক্রি করেছেন, বিনিময়ে নিয়েছিলেন বাংলার মানুষের ভালবাসা।  

মুক্তিকামী সংগ্রামী জনতাকে তাঁতিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। " মানুষের কাছে যাওয়ার সহজ মন্ত্রটা এই মানুষটির চেয়ে আর কার বেশি ভাল জানা ছিল?  

তিনি জানতেন, এক বঙ্গবন্ধুর জন্য লক্ষ বাঙ্গালি জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তত। তাইতো তিনি বলতেন,"মানুষকে ভালোবাসলে মানুষও ভালোবাসে। যদি সামান্য ত্যাগ স্বীকার করেন, তবে জনসাধারণ আপনার জন্য জীবন দিতেও পারে। " 

তার শক্তি আর দুর্বলতাকে একাকার করে ফেলেছিল এই বাংলার মানুষ, সেই ভালবাসার কথাই বলতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, "আমার সবচেয়ে বড় শক্তি আমার দেশের মানুষ আমাকে ভালবাসে, সবচেয়ে বড় দুর্বলতা আমি তাদেরকে খুব বেশি ভালবাসি। " 

ক্ষমতার লোভ, পদমর্যাদার মত ক্ষুদ্র বিষয় যাকে ছুঁয়ে যায় নি, যার একমাত্র সুখ ছিল মেহনতি জনগণের ভালোবাসার ঘাম গায়ে মাখা। তিনিই হলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন এভাবে,"প্রধানমন্ত্রী হবার কোন ইচ্ছা আমার নেই। প্রধানমন্ত্রী আসে এবং যায়। কিন্তু যে ভালোবাসা ও সম্মান দেশবাসী আমাকে দিয়েছে, তা আমি সারাজীবন মনে রাখবো। " 

তিনি বলেছিলেন," সাত কোটি বাঙ্গালির ভালোবাসার কাঙ্গাল আমি। আমি সব হারাতে পারি, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা হারাতে পারব না। " সমাজতন্ত্র আর সাম্যবাদ পূজারী বঙ্গবন্ধুর দেশে কেউ গায়ে খেটেও না খেয়ে থাকবে, তাদের পেটে লাথি পড়বে, এটা মেনে নেয়ার মত মানুষ ছিলেন না।  

তিনি আরও বলেছিলেন,"বিশ্ব দুই শিবিরে বিভক্ত-শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে। জীবন অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। এই কথা মনে রাখতে হবে। আমি বা আপনারা সবাই মৃত্যুর পর সামান্য কয়েক গজ কাপড় ছাড়া সাথে আর কিছুই নিয়ে যাব না। তবে কেন আপনারা মানুষকে শোষণ করবেন, মানুষের ওপর অত্যাচার করবেন? এই স্বাধীন দেশে মানুষ যখন পেট ভরে খেতে পাবে, পাবে মর্যাদাপূর্ণ জীবন; তখনই শুধু লাখো শহীদের আত্মা তৃপ্তি পাবে। " 

নিজের জীবনকে হাতের মুঠোয় করে ঘুরেছেন। দেশের মানুষের অন্যায়, অবিচার, আর কষ্ট দূর করে ক্লিষ্টমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বুনেছিলেন। তর্জনি উঁচিয়ে ঘোষণা করেছিলেন, “দেশ থেকে সর্বপ্রকার অন্যায়, অবিচার ও শোষণ উচ্ছেদ করার জন্য দরকার হলে আমি আমার জীবন উৎসর্গ করব। ”

বাংলার মানুষের মৌলিক অধিকার পাইয়ে দেয়া যার কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছিল তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু। যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ গড়তে মুক্তিযুদ্ধের পর পৃথিবীর নানা প্রান্তে নিজের দেশের অভুক্ত মানুষের পেটে দু মুঠো খাবার যোগাতে হাত পেতেছিলেন বিশ্ব নেতাদের কাছে।  

বাংলার মানুষের শান্তির জন্য নিজের পুরো জীবনটা উৎসর্গ করা বাংলার ইতিহাসের এই মহানায়ক বলেছিলেন,"আমি যদি বাংলার মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে না পারি, আমি যদি দেখি বাংলার মানুষ দুঃখী, আর যদি দেখি বাংলার মানুষ পেট ভরে খায় নাই, তাহলে আমি শান্তিতে মরতে পারব না। এ স্বাধীনতা আমার ব্যর্থ হয়ে যাবে, যদি আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না খায়। এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না ,যদি বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়। এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না, যারা আমার যুবক শ্রেণী আছে তারা চাকরি না পায় বা কাজ না পায়। "

ধরণীর বুক চিরে যে মেহনতি মানুষটি দেশবাসীর পেটে অন্ন যোগান, তাদের জীবনের দুর্দশা যাকে ভাবাত, তিনি হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।  

বঙ্গবন্ধু বলেন,“আমাদের চাষীরা হল সবচেয়ে দুঃখী ও নির্যাতিত শ্রেণী এবং তাদের অবস্থার উন্নতির জন্যে আমাদের উদ্যোগের বিরাট অংশ অবশ্যই তাদের পেছনে নিয়োজিত করতে হবে। " 

দেশটাকে একদম শুন্য থেকে গড়ে তোলা শুরু করেছিলেন। স্বপ্ন দেখতেন একটি সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশের। সোচ্চার ছিলেন শক্তিশালী বাংলাদেশ গড়তে। সেটিই ছিল তার মূলমন্ত। তিনি রাজাকে প্রজার সেবক বলে বিশ্বাস করতেই স্বস্তিবোধ করেছিলেন। বাংলার মানুষকে বলে দিয়েছিলেন,"যিনি যেখানে রয়েছেন, তিনি সেখানে আপন কর্তব্য পালন করলে দেশের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে না। ”
 
“সরকারি কর্মচারীদের জনগণের সাথে মিশে যেতে হবে। তারা জনগণের খাদেম, সেবক, ভাই। তারা জনগণের বাপ, জনগণের ছেলে, জনগণের সন্তান। তাদের এই মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে। সমস্ত সরকারি কর্মচারীকেই আমি অনুরোধ করি, যাদের অর্থে আমাদের সংসার চলে তাদের সেবা করুন। গরিবের ওপর অত্যাচার করলে আল্লাহর কাছে তার জবাব দিতে হবে। "

দেশ গড়তে শিল্প সংস্কৃতি গুরুত্ব পেয়েছিল রুচিশীল বঙ্গবন্ধু চিন্তায়। শিল্প সংস্কৃতির বিকাশ ছাড়া একটি দেশ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না সে বার্তা তিনি ঠিকই দিয়েছিলেন। শিল্পী সাহিত্যিকদের মনোযোগ দিতে বলেছিলেন অসহায় মানুষের দিকে, যেন ওই অসহায় মানুষগুলোর প্রয়োজন সমাজটাকে কাঁদায়।

জাতির পিতা আরও বলেছিলেন,"দেশের সাধারণ মানুষ, যারা আজও দুঃখী, যারা আজও নিরন্তর সংগ্রাম করে বেঁচে আছে, তাদের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখকে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির উপজীব্য করার জন্য শিল্পী, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবীদের প্রতি আহবান জানাচ্ছি। সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ছাড়া রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন। তাই মাটি ও মানুষকে কেন্দ্র করে গণমানুষের সুখ, শান্তি ও স্বপ্ন এবং আশা-আকাঙক্ষাকে অবলম্বন করে গড়ে উঠবে বাংলার নিজস্ব সাহিত্য-সংস্কৃতি।  

বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদের বীজ বপনকারী বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, "বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদ না থাকলে আমাদের স্বাধীনতার অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। "

বঙ্গবন্ধু ঝড়ের দমকা হাওয়ায় বঙ্গবন্ধু হয়ে জনতার সামনে দাঁড়াননি। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া একজন সাধারণ ছাত্র নিরীহ চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর অধিকার আদায়ে আন্দোলনের ঝড় তুলেছিলেন নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীবৃন্দের অধিকারের জন্য হাসতে হাসতে মাথা পেতে নিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সবচেয়ে বড় শাস্তি বহিষ্কারাদেশ। আন্দোলনে কিভাবে জনগণের শক্তিকে আন্দোলিত করে শোষকের কড়াল গ্রাস থেকে নিজের অধিকারটুকু আদায় করে নিতে হয় সে কথা বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু।  

বাংলার মানুষকে অধিকার আদায়ের মন্ত্রটা শিখিয়ে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি বলেছিলেন,“গণআন্দোলন ছাড়া, গণবিপ্লব ছাড়া বিপ্লব হয় না। জনগণকে ছাড়া, জনগণকে সংঘবদ্ধ না করে, জনগণকে আন্দোলনমুখী না করে এবং পরিস্কার আদর্শ সামনে না রেখে কোন রকম গণআন্দোলন হতে পারে না। আন্দোলন মুখ দিয়ে বললেই করা যায় না। আন্দোলনের জন্য জনমত সৃষ্টি করতে হয়। আন্দোলনের জন্য আদর্শ থাকতে হয়। আন্দোলনের জন্য নিঃস্বার্থ কর্মী হতে হয়। ত্যাগী মানুষ থাকা দরকার। আর সর্বোপরি জনগণের সংঘবদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ সমর্থন থাকা দরকার। "

স্বাধীন দেশের সুবিধাজনক পদে বসে দেশের ভাল-মন্দে নিজের দলের, নিজের সরকারের নেতাদের গা বাঁচিয়ে- পিঠ বাঁচিয়ে চলার কোন সুযোগ বঙ্গবন্ধু দেননি। জনগণের সামনে আদর্শ নেতা আর বর্জনীয় নেতার পার্থক্য সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছিলেন। জনগণকে রাজনীতির ‘অ আ ক খ’ পাঠ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন," অযোগ্য নেতৃত্ব, নীতিহীন নেতা ও কাপুরুষ রাজনীতিবিদদের সাথে কোন দিন একসাথে হয়ে দেশের কাজে নামতে নেই। তাতে দেশসেবার চেয়ে দেশের ও জনগণের সর্বনাশই বেশি হয়। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের চারটি জিনিসের প্রয়োজন। তা হচ্ছে: নেতৃত্ব, আদর্শ, নিঃস্বার্থ কর্মী এবং সংগঠন। "

স্বাধীন বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা জাতিকে একটি দেশ, একটি মানচিত্র উপহার দিয়েই ক্ষান্ত হন নি। খেটে খাওয়া মানুষকে, বাংলার আবেগী মানুষদের স্বনির্ভর হওয়ার পথ দেখিয়েছিলেন। একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ, স্বনির্ভর বাংলাদেশকে নিজ হাতে তৈরি করার মন্ত্র জপতেন নিয়মিত। তিনি বলেছিলেন, “ভিক্ষুক জাতির ইজ্জত থাকে না। বিদেশ থেকে ভিক্ষা করে এনে দেশকে গড়া যাবে না। দেশের মধ্যেই পয়সা করতে হবে। ”

বাংলার উর্বর মাটিতে যেমন সোনা ফলে, ঠিক তেমনি পরগাছাও জন্মায়! একইভাবে, বাংলাদেশে কতকগুলো রাজনৈতিক পরগাছা রয়েছে, যারা বাংলার মানুষের বর্তমান দুঃখ-দুর্দশার জন্য দায়ী। "

সকল ধর্মের মানুষ এই ভূখণ্ডে একটি পরিচয় নিয়েই মিলেমিশে থাকবে, এমনতাই ভাবতেন মানুষটা। ধর্ম যে রাজনীতি আর শোষণের হাতিয়ার এবং অপশক্তি হয়ে উঠতে পারে, এই ভবিষ্যৎ তিনি ঠাওর করেছিলেন অনেক আগেই। তাই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের এই স্বপ্নদ্রষ্টা বলেছিলেন,“যদি আমরা বিভক্ত হয়ে যাই এবং স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও মতাদর্শের অনৈক্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আত্বঘাতী সংঘাতে মেতে উঠি, তাহলে যারা এদেশের মানুষের ভালো চান না ও এখানাকার সম্পদের ওপর ভাগ বসাতে চান তাদেরই সুবিধা হবে এবং বাংলাদেশের নির্যাতিত, নিপীড়িত, ভাগ্যাহত ও দুঃখী মানুষের মুক্তির দিনটি পিছিয়ে যাবে। ”

“আর সাম্প্রদায়িকতা যেন মাথাচারা দিয়ে উঠতে না পারে। ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র বাংলাদেশ। মুসলমান তার ধর্মকর্ম করবে। হিন্দু তার ধর্মকর্ম করবে। বৌদ্ধ তার ধর্মকর্ম করবে। কেউ কাউকে বাধা দিতে পারবে না। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। "

শহীদের রক্তের দোহাই দিয়ে বাংলাদেশি পরিচয় বুকে ধারণ করে নির্ভীক পদক্ষেপে যেনি এগিয়ে যেতে বলেছিলেন, তিনিই বঙ্গবন্ধু। তিনি বলেছিলেন, “শহীদদের রক্ত যেন বৃথা না যায়। ”

বাংলাদেশের সাফল্যের একেকটা পালক পাথর হয়ে যেন অমঙ্গলকামী অপশক্তি, বাঙ্গালি জাতির শত্রু বুকে চেপে বসতে পারে- সে বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। হুমকিপত্রে লিখেছিলেন,“বাংলার মাটি, দুর্জয় ঘাঁটি। জেনে নিক দুর্বৃত্তরা। ”

জয় বাংলা 
জয় বঙ্গবন্ধু।  


লেখক: শাব্বীর রহমান 
গবেষক ও আলোকচিত্রী 

 

সম্পর্কিত খবর