কোরবানির ফাজায়েল ও মাসায়েল

প্রতীকী ছবি

কোরবানির ফাজায়েল ও মাসায়েল

ধর্ম ডেস্ক

কোরবানি আরবী শব্দ। এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে নৈকট্য, সান্নিধ্য, আত্মত্যাগ, জবেহ, রক্তপাত ইত্যাদি। শরীয়তের পরিভাষায় কোরবানি বলা হয়, মহান রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য ও সন্তোষ লাভের আশায় নির্ধারিত তারিখের মধ্যে হালাল কোন পশু আল্লাহর নামে জবেহ করা। কোরবানির সূচনা হয় মানবজাতির আদি পিতা হযরত আদম (আ.)-এর যুগ থেকে।

দুনিয়ার প্রথম মানব হযরত আদম (আ.)-এর সন্তান হাবিল-কাবিলের মধ্যে বিয়ে নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দিলে হযরত আদম (আ.) তাদের দ্বন্দ্ব নিরসনের মানসে উভয়কে ইখলাসের সঙ্গে কোরবানি করার নির্দেশ প্রদান করেন। অতঃপর মহান রাব্বুল আলামিন তাকওয়ার ভিত্তিতে হাবিলের কোরবানি কবুল করলেন এবং কাবিলের কোরবানি প্রত্যাখ্যান করলেন। আর এভাবেই মানব ইতিহাসে কোরবানির প্রচলন শুরু হয়। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, হে আমার হাবিব! আপনি তাদের আদম-এর পুত্রদ্বয়ের ঘটনা যথার্থভাবে পাঠ করে শুনিয়ে দিন; যখন তারা উভয়েই কোরবানি দিয়েছিল।
অতঃপর তাদের একজনের কোরবানি কবুল করা হয়েছিল এবং অপরজনের কোরবানি গৃহীত হয়নি।

যার কোরবানি কবুল হলো না সে বলল, আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করব। তখন অপরজন বলল, আল্লাহতায়ালা মুত্তাকিনদের আমল কবুল করে থাকেন। (সূরা মায়েদা, আয়াত ২৭)

পরবর্তীতে মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম (আ.) খোদাপ্রেমের নিদর্শন ও পরীক্ষা স্বরূপ মিনার প্রান্তরে তার কলিজার টুকরা সন্তান ইসমাইল (আ.)-এর গলায় ছুরি চালিয়ে ত্যাগ ও ভালোবাসার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। বিশ্বময় রচিত হলো কোরবানির নতুন ইতিহাস।

এ ব্যাপারে দয়াময় আল্লাহ মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে ইরশাদ করেন, অতঃপর সে যখন পিতার সঙ্গে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হলো, তখন পিতা ইব্রাহিম (আ.) তাকে বললেন, হে আমার প্রিয় সন্তান! আমি স্বপ্নে দেখলাম, তোমাকে জবাই করছি; এ বিষয়ে তোমার অভিমত কী? ছেলে উত্তরে বলল, হে আমার পিতা! আপনাকে যা নির্দেশ করা হয়েছে আপনি তা বাস্তবায়ন করুন। ইনশাআল্লাহ! আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন। যখন পিতা-পুত্র উভয়েই আনুগত্য প্রকাশ করল এবং জবাই করার জন্য তাকে শায়িত করল, তখন আমি (সৃষ্টিকর্তা) তাকে ডেকে বললাম, হে ইব্রাহিম! তুমি স্বপ্নে যা দেখেছ তা সত্যে পরিণত করেছ। এভাবেই আমি সত্কর্মশীলদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। নিশ্চয় এটা এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তার পরিবর্তে জবাই করার জন্য এক মহান জন্তু দান করলাম। (সূরা সাফফাত, আয়াত ১০২)।

কোরবানি অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত, ইব্রাহিম (আ.)-এর সুন্নত ও মহান স্রষ্টার নৈকট্য অর্জনের এক বিশেষ মাধ্যম। কোরবানির মূল উদ্দেশ্য শুধু পশু জবাই নয়, জীবনের সর্ব ক্ষেত্রে খোদাভীতি ও প্রীতি অর্জনই এর মূল লক্ষ্য। কোরবানির বিনিময়ে মহান রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে মুমিনের জন্য রয়েছে অসংখ্য পুরস্কার ও অফুরন্ত প্রতিদান। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে সূরা হজের ৩৭ নম্বর আয়াতে ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহতায়ালার কাছে কোরবানির পশুর গোশত ও রক্ত পৌঁছায় না, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া তথা খোদাভীতি। ’

মহান আল্লাহতায়ালা কোরআনের অন্যত্র ইরশাদ করেন, ‘আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশে নামাজ পড়ুন এবং কোরবানি করুন। ’ (সূরা কাওসার, আয়াত ০২)

হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা রসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করলাম, ইয়া রসুলুল্লাহ! এই কোরবানি কী? রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করলেন, এটা তোমাদের পিতা হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সুন্নত। অতঃপর আবার জিজ্ঞাসা করা হলো, এই কোরবানির মধ্যে আমাদের জন্য কী প্রতিদান রয়েছে? রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করলেন, প্রতিটি পশমের বিনিময়ে নেকি দেওয়া হবে। (ইবনে মাজাহ)।

হযরত আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ঈদুল আজহার দিন মানুষের সমস্ত নেক আমলের মধ্যে আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয় ও পছন্দনীয় আমল হলো কোরবানি। কিয়ামতের দিন কোরবানির পশু তার শিং, পশম ও ক্ষুরসহ সম্পূর্ণ সুস্থ-সবল অবস্থায় হাজির হবে। নিশ্চয় কোরবানির রক্ত জমিনে পড়ার আগেই আল্লাহর কাছে তা কবুল হয়ে যায়। অতএব, তোমরা কোরবানির মাধ্যমে নিজেদের পবিত্রতা অর্জন কর এবং খুশি মনে আনন্দচিত্তে কোরবানি কর। (তিরমিজি)। প্রিয়নবী (সা.) আরও ইরশাদ করেন, তোমরা মোটা-তাজা পশু কোরবানি কর, কারণ তা পুলসিরাতে তোমাদের সাওয়ারি হবে। (কানযুল উম্মাল)। তবে যারা সামর্থ্যবান হওয়া সত্ত্বেও কোরবানি করে না, তাদের ব্যাপারে প্রিয়নবী (সা.) কঠোর বাণী উচ্চারণ  করেছেন। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি সামর্থ্যবান হওয়া সত্ত্বেও কোরবানি করে না, সে যেন আমার ঈদগাহে না আসে। (ইবনে মাজাহ)।

তাই ত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত হয়ে মহান স্রষ্টার নৈকট্য ও সান্নিধ্য লাভের আশায় কোরবানি করা প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুমিন মুসলমানের ইমানি দায়িত্ব।

যাদের উপর কোরবানি ওয়াজিব:
১০ জিলহজ ফজর থেকে ১২ জিলহজ সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রয়োজনীয় খরচ ব্যতিত সাড়ে সাত তোলা সোনা বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা কিংবা সমপরিমাণ সম্পদ যার কাছে থাকবে তার উপর কোরবানি ওয়াজিব। কোরবানি ওয়াজিব হওয়ার জন্য নেসাব পরিমাণ মাল পূর্ণ এক বছর থাকা জরুরি নয়, কোরবানির শেষ দিন সূর্যাস্তের পূর্বেও যদি কেউ নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয় তাহলে তার উপরও কোরবানি ওয়াজিব। ২. জীবিকা নির্বাহের জন্য যে পরিমাণ জমি ও ফসলের দরকার তা থেকে অতিরিক্ত জমি ও ফসলের মূল্য অথবা যে কোন একটির মূল্য নেসাব পরিমাণ হলেও কোরবানি ওয়াজিব। ৩.একই পরিবারের সকল সদস্য পৃথক পৃথকভাবে নেসাবের মালিক হলে সকলের উপর আলাদাভাবে কোরবানি ওয়াজিব। ৪. কোন উদ্দেশ্যে কোরবানির মান্নত করলে সে উদ্দেশ্য পূর্ণ হলেও কোরবানি করা ওয়াজিব। ১০ জিলহজ থেকে ১২ জিলহজ সন্ধ্যা পর্যন্ত কোরবানি করার নির্ধারিত সময়। তবে প্রথম দিন কোরবানি করা সর্বাপেক্ষা উত্তম, এরপর যথাক্রমে দ্বিতীয় দিন ও তৃতীয় দিন। -সংকলিত

সম্পর্কিত খবর