চোখের পলকে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয় বঙ্গবন্ধু এভিনিউ

সংগৃহীত ছবি

আজ ভয়াল ২১ আগস্ট

চোখের পলকে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয় বঙ্গবন্ধু এভিনিউ

নিউজ টোয়েন্টিফোর অনলাইন

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। এ জাতির জন্য একটি কলঙ্কিত ও ভয়াবহ দিন। এই দিনে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সভায় গ্রেনেড হামলা করেছিল জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী (হুজি)। এ ঘটনায় আওয়ামী লীগের ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত হন।

পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী আহত হন। শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও তার শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই দিনটি গ্রেনেড হামলা দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

১৪ বছর আগে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে আয়োজিত সন্ত্রাসবিরোধী সভার খোলা ট্রাকে নির্মিত উন্মুক্ত মঞ্চে ভাষণ দেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

ভাষণ শেষ করে তার ‘সন্ত্রাসবিরোধী শোভাযাত্রার’ উদ্বোধন ঘোষণার মুহূর্তে নৃশংস গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউ-এ রক্তের স্রোত বয়ে যায়।

সন্ত্রাসবিরোধী সভা ও শোভাযাত্রা উপলক্ষে বিকাল ৪টা থেকেই আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী এবং সাধারণ মানুষে কানায় কানায় ভরে ওঠে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ। স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে বঙ্গবন্ধু এভিনিউসহ আশপাশের এলাকা। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বিবা পরিবহনের খোলা ট্রাকে বানানো উন্মুক্ত মঞ্চে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা। বিকাল ৫টার দিকে বুলেটপ্রুফ গাড়িতে সমাবেশস্থলে পৌঁছান তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। প্রায় ২০ মিনিট বক্তৃতা দেন তিনি। বিকাল ৫টা ২২ মিনিটে বক্তৃতা শেষে সন্ত্রাসবিরোধী মিছিল শুরুর ঘোষণা দেওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে শুরু হয় একের পর এক পৈশাচিক গ্রেনেড হামলা। মুহূর্তে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয় গোটা বঙ্গবন্ধু এভিনিউ। সন্ত্রাসবিরোধী সভা কভার করতে যাওয়া ফটোসাংবাদিকদের ছবি তোলার অনুরোধ রক্ষা করতে গিয়ে প্রায় এক মিনিট অপেক্ষা করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। ওই এক মিনিট অপেক্ষা না করলে হয়তো রচিত হতো অন্য ইতিহাস। ভাগ্যক্রমে বঙ্গবন্ধুকন্যা বেঁচে গেলেও নিহত হন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী ও আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ ২৪ জন। আহত হন পাঁচ শতাধিক মানুষ। বিস্ফোরিত গ্রেনেডের ধোঁয়া ও পুলিশের ছোড়া কাঁদুনে গ্যাসে আচ্ছন্ন হয়ে যায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউসহ আশপাশ। শেখ হাসিনার গাড়ি লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ শুরু হয়। নিক্ষিপ্ত গ্রেনেডগুলোর মধ্যে তিনটি অবিস্ফোরিত থেকে যায়। শত শত মানুষের আর্তচিৎকার, ছড়িয়ে থাকা ছিন্নভিন্ন দেহ, রক্ত আর পোড়া গন্ধ—সব মিলিয়ে বীভৎস অবস্থার সৃষ্টি হয় পুরো এলাকায়। আহতদের সাহায্য করার বদলে বিক্ষুব্ধ ও আহত মানুষের ওপর বেপরোয়া লাঠিপেটা আর কাঁদুনে গ্যাস ছোড়ে তৎকালীন সরকারের পুলিশ। মুহূর্তের মধ্যে দোকানপাট ও যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আতঙ্কে এলাকা ছেড়ে পালাতে শুরু করে সবাই।

নৃশংস সেই হামলার ১৪তম বার্ষিকী আজ। দলীয় সভানেত্রীকে বাঁচানোর জন্য ট্রাকের ওপর মানববর্ম রচনা করেছিলেন আওয়ামী লীগের নেতারা। সেদিনের গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত আইভি রহমান ৫৮ ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে মারা যান ২৪ আগস্ট। তবে ওই দিনই নিহত হন মোস্তাক আহমেদ সেন্টু, ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুবুর রশীদ, রফিকুল ইসলাম আদা, সুফিয়া বেগম, হাসিনা মমতাজ রীনা, লিটন মুন্সী ওরফে লিটু, রতন সিকদার, মো. হানিফ ওরফে মুক্তিযোদ্ধা হানিফ, মামুন মৃধা, বেলাল হোসেন, আমিনুল ইসলাম, আবদুল কুদ্দুস পাটোয়ারী, আতিক সরকার, নাসিরউদ্দিন সর্দার, রেজিয়া বেগম, আবুল কাসেম, জাহেদ আলী, মমিন আলী, শামসুদ্দিন, আবুল কালাম আজাদ, ইছহাক মিয়া এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরও দুজন। হামলায় আহতের মধ্যে ছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত জিল্লুর রহমান, আমির হোসেন আমু, প্রয়াত আবদুর রাজ্জাক, আওয়ামী লীগের তদানীন্তন সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত আবদুল জলিল, প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, প্রয়াত মো. হানিফ, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, কাজী জাফর উল্লাহ, ওবায়দুল কাদের, ড. হাছান মাহমুদ, মাহমুদুর রহমান মান্না, আবদুর রহমান, আখতারুজ্জামান, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, অ্যাডভোকেট রহমত আলী, সাঈদ খোকনসহ পাঁচ শতাধিক আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষ। দীর্ঘদিন চিকিৎসায় অনেকে কিছুটা সুস্থ হলেও পঙ্গুত্বের অভিশাপ নিয়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে অনেককে। সেদিনের সেই দুঃসহ স্মৃতি প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাদের।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রাণনাশের উদ্দেশ্যেই গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল। ফটোসাংবাদিকদের অনুরোধে সায় না দিলে প্রয়াত আইভি রহমানের জায়গায় লাশ হতেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে সংঘটিত এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে সেদিন সংসদে কোনো শোক প্রস্তাব তুলতে পারেনি আওয়ামী লীগ। ওই হামলাকে ভিন্ন পথে নিতে সিআইডিকে দিয়ে সাজানো হয়েছিল জজ মিয়া নাটক। জজ মিয়া নামের এক ব্যক্তিকে দিয়ে গ্রেনেড হামলার বিষয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়া হয়। বিষয়টি ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল। ২০০৭ সালের সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ওই হামলার ঘটনায় পুনরায় তদন্ত হয়। সেই তদন্তে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আবদুল হান্নান এবং বিএনপি'র সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে পুনরায় এ মামলার তদন্ত হয়।

তৎকালীন রাষ্ট্রযন্ত্রের গভীর ষড়যন্ত্র আর পৃষ্ঠপোষকতায় বিভীষিকাময় এ হামলার সঙ্গে জড়িত ছিল দুর্ধর্ষ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ (হুজিবি)। হামলার ঘটনায় দায়ের হওয়া দুটি মামলায় সাক্ষীদের জবানবন্দিতে প্রকৃত অপরাধীদের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে একের পর এক। এখন মামলা দুটির বিচার একেবারে শেষ পর্যায়ে। মামলার অন্যতম আসামি বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবরের পক্ষে যুক্তিতর্ক শেষের মাধ্যমেই মূলত এই মামলার বিচারিক কার্যক্রম শেষ হচ্ছে। এই যুক্তিতর্ক শেষ হতে আর তিন থেকে চার কর্মদিবস সময় লাগতে পারে বলে ধারণা সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের। এরপর রাষ্ট্রপক্ষের সমাপনী বক্তব্যের পরই রায়ের জন্য দিন ঠিক করবেন ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন। রাজধানীর নাজিম উদ্দীন রোডে পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে স্থাপিত বিশেষ এজলাসে একসঙ্গেই বিচার চলছে দুটি মামলার।  

দিবসটি উপলক্ষে সোমবার দেয়া এক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ২১ আগস্টের হামলাকারী, পরিকল্পনাকারী, নির্দেশদাতা এবং মদদদাতাদের সুষ্ঠু বিচারের মাধ্যমে দেশ থেকে হত্যা, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের চির অবসান এবং দেশে আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হবে।

শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা এবং আহতদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি আশা করি, ২১ আগস্টের শোককে শক্তিতে পরিণত করে সন্ত্রাস ও জঙ্গিমুক্ত একটি শান্তিপূর্ণ, উদার, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে দেশের সব নাগরিক ঐক্যবদ্ধ হবেন।

সম্পর্কিত খবর