বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আসার এক বছর পূর্ণ হচ্ছে। মিয়ানমার সেবাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে গত বছরের ২৫ আগস্ট বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের ঢল নামে। সবশেষ হিসেব অনুযায়ী এখন পর্যন্ত ১২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছে।
এখনও মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা আসার প্রবণতা রয়েছে।
কিছু দিন আগে স্বামী, দুই বছরের একটি ছেলে ও তিন মাস বয়সী একটি বাচ্চচাকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন হামিদা বেগম। পালিয়ে আসার আগের সময়টাতে তার স্বামী ঠিকমতো কখনো ঘুমাতে পারেননি। কারণ, সারাক্ষণই তার মধ্যে গ্রেপ্তার হওয়ার ভয় কাজ করতো।১৮ বছর বয়সী হামিদা বলেন, রাত হলে তার স্বামী কোনো গাছের মগডালে উঠে যেতেন।
মিয়ানমার বার বার বলছে, তারা রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করতে প্রস্তুত। কিন্তু এখনও হামিদা ও তার পরিবারের মতো অনেক মানুষ পালিয়ে আসায় মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের সমস্যা সমাধানে অগ্রগতিতে ঘাটতির বিষয়টিকেই ফুটিয়ে তোলে। রোহিঙ্গাদের এই দলে দলে দেশ ত্যাগ সেখানকার গণতান্ত্রিক পালাবদলে একটি উত্তেজনাকর অবস্থার সৃষ্টি করে এবং বিশ্বের কাছে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অং সান সুচির ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়।
মিয়ানমারে নিয়োজিত জাতিসংঘের সাবেক কূটনীতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক রিচার্ড হরসি বলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কট বিশ্বের কাছে মিয়ানমারের ভাবমূর্তি ভয়াবহভাবে ক্ষতি করেছে। সেনাবাহিনী বা নিরাপত্তারক্ষাকারীদের বিরুদ্ধে নৃশংসতার যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা প্রত্যাখ্যান করেছে অং সান সুচির সরকার। তারা ফেরত যাওয়া রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করতে রাখাইনে নির্মাণ করেছে ট্রানজিট ক্যাম্প। এ বছরের শুরু থেকে আগষ্ট পর্যন্ত প্রায় ১৩ হাজার রোহিঙ্গা এসেছেন বাংলাদেশে। এতে পরিষ্কার বোঝা যায়, এক বছর আগে যে সঙ্কট শুরু হয়েছিল তা দ্বিতীয় বছরে প্রবেশ করেছে এবং এ সঙ্কট সমাধান বহু দূরের বিষয়।
নতুন আসা প্রায় অর্ধ ডজন শরণার্থী বার্তা সংস্থা রয়টার্সের সঙ্গে কথা বলেছেন। তারা বলেছেন, পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া বাড়িঘর ও ফাঁকা গ্রামগুলোতে টিকে থাকার লড়াই করছিলেন তারা। কিন্তু নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা তাদেরকে গ্রেপ্তার করে হয়রান করতে পারে এমন আতঙ্গে সব ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন তারা। আরো বলেছেন, তাদেরকে এক রকম গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছিল। অনাহারে মারা যাওয়ার অবস্থায় তাদেরকে ঠেলে দেয়া হয়েছিল তাদেরকে কোনো কাজে, মার্কেটে, পুকুরে মাছ ধরতে যেতে দেয়া হতো না। মসজিদে যেতে পারতেন না নামাজ আদায় করতে।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীদের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়ে স্রোতের মতো বাংলাদেশে প্রবেশ করতে থাকে রোহিঙ্গারা। এক বছর হতে চলেছে তারা এভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। কিন্তু তাদের দুর্ভোগের শেষ হয়নি। এমন কি মিয়ানমারও তাদেরকে গ্রহণ করতে এখন পর্যন্ত আন্তরিকতা দেখায় নি। উল্টো রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন বিলম্ব হওয়ার জন্য সেদেশের নেত্রী অং সান সুচি দায় চাপিয়েছেন বাংলাদেশের ওপর।
মিয়ানমার থেকে দলে দলে পালিয়ে আসার পর বাংলাদেশে গাদাগাদি করে অবস্থান করছেন এসব রোহিঙ্গা। সেখানে দেখা দিয়েছে নানা সামাজিক সমস্যা।
এরপর সেইসব গ্রামের ওপর তারা নির্মাণ করে সেনাবাহিনীর অবকাঠামো। এসব বিষয় প্রামাণ্য আকারে উপস্থাপন করেছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা। রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমারের ওপর আছে আন্তর্জাতিক চাপ। তবে জাাতিসংঘে এ বিষয়ে উত্থাপিত একটি প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে চীন ও রাশিয়া। ফলে মিয়ানমারের ওপর জাতিসংঘের চাপ প্রয়োগের বিষয়টি ঠুনকো বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মিয়ানমার বলছে, তারা সংকটেট উস্কানি দেয় নি। উল্টো সেনাবাহিনী সন্ত্রাসবিরোধী একটি অপারেশন চালিয়েছে।
উল্লেখ্য, গত বছরের ২৪ আগস্ট রাতে মিয়ানমারের রাখাইনে সহিংস ঘটনার পর থেকে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয়ের জন্য পালিয়ে আসে প্রায় আট লাখ রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংস নির্যাতন শুরু করে দেশটির সেনাবাহিনী ও তার দোসররা। তারা নির্বিচারে গণধর্ষণ করে বালিকা, যুবতী ও নারীদের। গুলি করে হত্যা করে অসংখ্য মানুষকে। আগুন ধরিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেয় গ্রামের পর গ্রাম। প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে বানের পানির মতো ঢুকতে শুরু করে রোহিঙ্গারা। এর আগে বাংলাদেশে অবস্থান করছিল আরও প্রায় সোয়া তিন লাখ রোহিঙ্গা। এখন ১২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা আশ্রিত রয়েছে বাংলাদেশে। যুগের পর যুগ বংশ পরম্পরায় তারা রাখাইনে বাস করলেও মিয়ানমার তাদের নাগরিক বলে স্বীকার করে না।
বৌদ্ধদের ব্যবহার করে সেখানকার সেনাবাহিনী ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে সাম্প্রদায়িক অবিশ্বাসের বীজ বপন করেছে, ছড়িয়েছে বিদ্বেষ। ১৯৮২ সালে প্রণীত নাগরিকত্ব আইনে পরিচয়হীনতায় ভোগে রোহিঙ্গারা। এরপর কখনও মলিন হয়ে যাওয়া কোনো নিবন্ধনপত্র, কখনও নীলচে রঙের রশিদ, কখনও ভোটার স্বীকৃতির হোয়াইট কার্ড, কখনও আবার ‘ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড’ কিংবা এনভিসি নামের রং-বেরংয়ের পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে। ধাপে ধাপে মিয়ে গেছে তাদের পরিচয়। এভাবে তারা রূপান্তরিত হয়েছে রাষ্ট্রহীন নাগরিকে।
এখন তারা মর্যাদার সঙ্গে ফিরে যেতে চান নিজ জন্মভূমিতে। এজন্য নিরাপদ প্রত্যাবাসনের আশায় রয়েছে এসব নিপীড়িত মানুষ।
(নিউজ টোয়েন্টিফোর/কামরুল/তৌহিদ)