একতার সর্বজনীন ভাবনার প্রসারে ভারতের জি২০ সভাপতিত্ব

সংগৃহীত ছবি

একতার সর্বজনীন ভাবনার প্রসারে ভারতের জি২০ সভাপতিত্ব

নরেন্দ্র মোদি

বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ছয় ভাগের এক ভাগের বাসস্থান এবং ভাষা, ধর্ম, প্রথা ও বিশ্বাসের বিপুল বৈচিত্র্যসহ ভারত বিশ্বের একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ। পূর্ববর্তী ১৭টি জি২০-এর সভাপতিত্ব অন্যান্য অনেক ফলাফলের মধ্যে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, যুক্তিগ্রাহ্য আন্তর্জাতিক কর ব্যবস্থাপনা, দেশগুলোর ওপর থেকে করের বোঝা কমানোকে সুনিশ্চিত করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য এনেছিল। আমরা এই অর্জনগুলি থেকে উপকৃত হব এবং এর ওপর দাঁড়িয়ে নিজেদেরকে আরও গড়ে তুলব।

যাইহোক, ভারত যেহেতু এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটি পেয়েছে, আমি নিজেকে প্রশ্ন করেছি- এখনো কি জি২০-এর আরও অগ্রগতি হতে পারে? সামগ্রিকভাবে মানব সভ্যতার কল্যাণের জন্য একটি মৌলিক মানসিকতা পরিবর্তনকে অনুঘটক করতে পারি?

আমি বিশ্বাস করি, আমরা পারি।

পরিস্থিতি দ্বারা আমাদের মানসিকতা তৈরি হয়। সমগ্র ইতিহাসজুড়ে মানব সভ্যতা অভাবে ছিল। আমরা সীমিত সংস্থানের জন্য লড়াই করেছিলাম, কারণ আমাদের বেঁচে থাকা নির্ভর করত অন্যদের সেই সংস্থানের অধিকারকে অস্বীকারের মাধ্যমে। ধারণা, মতাদর্শ এবং পরিচয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাই নিয়ম হয়ে উঠেছিল।

দুর্ভাগ্যবশত আজও আমরা ওই একই শূন্য মানসিকতার ফাঁদে আটকে রয়েছি। ভূখণ্ড এবং সম্পদ নিয়ে যখন দেশগুলো লড়াই করে তখন আমরা বিষয়টি দেখতে পাই। যখন প্রয়োজনীয় জিনিসের সরবরাহ অস্ত্রে পরিণত হয় তখন আমরা এটি লক্ষ্য করি। আমরা এটা দেখি যখন কোটি কোটি মানুষ আক্রান্ত থাকা সত্ত্বেও মুষ্টিমেয় কয়েকজনের দ্বারা প্রতিষেধকের মজুতদারি হয়।

কেউ কেউ এর বিরোধিতা করতে পারেন এই বলে যে, সংঘাত ও লোভ মানুষের প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য। আমি এর সাথে একমত নই। মানুষ যদি সহজাতভাবেই স্বার্থপর হতো, তাহলে আমাদের মৌলিক একত্বের প্রচারে এই বিপুল পারলৌকিক ঐতিহ্যের যে দীর্ঘস্থায়ী আবেদন, তার ব্যাখ্যা কী? 

পঞ্চতত্ত্ব- ভারতে জনপ্রিয় এমনই একটি মতবাদ যা বিশ্বাস করে, সমস্ত জীবিত সত্তা এমনকি সকল নির্জীব পদার্থও মৃত্তিকা (পৃথিবী), জল, আগুন, বায়ু ও স্থান (স্পেইস)– এই পাঁচটি মৌলিক উপাদানে নির্মিত।

আমাদের শারীরিক, সামাজিক ও পরিবেশগত কল্যাণের জন্য সকলের মাঝে এই উপাদানগুলোর মধ্যে সমন্বয় অপরিহার্য। ভারতের জি২০ সভাপতিত্ব এই বিশ্ব একতার ভাবনার প্রচারে কাজ করবে। এই কারণে আমাদের মূলভাব হলো- ‘এক পৃথিবী, এক পরিবার, এক ভবিষ্যৎ’।

এটি শুধু একটি বুলি বা স্লোগান নয়। মানব পরিস্থিতির সাম্প্রতিক পরিবর্তন এর মধ্যে বিবেচনাধীন, যা উপলব্ধি করতে আমরা সামগ্রিকভাবে ব্যর্থ হয়েছি।

আজ পৃথিবীর সকল মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত উৎপাদন করার সংস্থান আমাদের রয়েছে। আমাদের টিকে থাকার জন্য লড়াই করার দরকার নেই– অবশ্যই কোনো যুদ্ধের প্রয়োজন নেই।

আজ, আমরা সবচেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছি তা হলো– জলবায়ুর পরিবর্তন, সন্ত্রাসবাদ, এবং মহামারী– যা একে অপরের সাথে যুদ্ধ করে সমাধান করা সম্ভব নয় বরং পারস্পরিক সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমেই সম্ভব।

সৌভাগ্যবশত, বর্তমান প্রযুক্তি আরও বিস্তৃত পরিসরে মানবজাতির সমস্যাসমূহ মোকাবেলা করার পথ প্রদর্শন করে। আমরা আজ যে সুবিশাল ভার্চুয়াল দুনিয়ায় বসবাস করি তা ডিজিটাল প্রযুক্তির উন্নতি নির্দেশ করে।

বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ছয় ভাগের এক ভাগের বাসস্থান এবং ভাষা, ধর্ম, প্রথা ও বিশ্বাসের বিপুল বৈচিত্র্যসহ ভারত বিশ্বের একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ।

সমষ্টিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রাচীনতম প্রথাসহ গণতন্ত্রের ভিত্তিগত ডিএনএ প্রদানে ভারতের অবদান রয়েছে। গণতন্ত্রের জননী হিসেবে, ভারতের জাতীয় ঐকমত্য নির্দেশ দিয়ে নয় বরং লক্ষ লক্ষ স্বাধীন কণ্ঠকে একটি ছন্দে মিশ্রিত করে তৈরি করা হয়েছে।

আজ ভারত একটি দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনৈতিক অগ্রগতির দেশ। আমাদের জনগণ-কেন্দ্রিক শাসনের রূপকল্প বুদ্ধিদীপ্ত তারুণ্যের সৃজনশীল প্রতিভাকে লালন করার পাশাপাশি সর্বাধিক প্রান্তিক জনগোষ্ঠীরও খেয়াল রাখে।

আমরা চেষ্টা করেছি, আমাদের জাতীয় উন্নয়নকে একটি আপাদমস্তক শাসনের অনুশীলন নয় বরং নাগরিক নেতৃত্বাধীন ‘গণ আন্দোলন’ রূপে গড়ে তুলতে।

আমরা ডিজিটাল পাবলিক পণ্য তৈরিতে প্রযুক্তির ব্যবহার করেছি যা উন্মুক্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং আন্তঃচালিত। এগুলি সামাজিক সুরক্ষা, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি এবং ইলেকট্রনিক অর্থ প্রদানের মতো বৈচিত্র্যময় ক্ষেত্রগুলিতে বৈপ্লবিক অগ্রগতি এনেছে। এ সকল কারণে, ভারতের অভিজ্ঞতা সম্ভাব্য বৈশ্বিক সমাধানে অন্তর্দৃষ্টি দিতে পারে।

আমাদের জি২০ সভাপতিত্ব চলাকালে, ভারতের অভিজ্ঞতা, শিক্ষা ও মডেলসমূহকে অন্যদের বিশেষ করে উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য সম্ভাব্য টেমপ্লেট হিসাবে উপস্থাপন করব। আমরা কেবল আমাদের জি২০ শরীকদের সাথেই নয়, বিশ্বব্যাপী দক্ষিণে আমাদের সহযাত্রীদের সাথেও পরামর্শ করব, যাদের কণ্ঠস্বর প্রায়শই উপেক্ষা করা হয়।

আমাদের শীর্ষ অগ্রাধিকার হবে আমাদের ‘এক পরিবার’ এর সাথে সম্প্রীতি পুনরুদ্ধার করা, আমাদের ‘এক পৃথিবী’ নিরাময় করা এবং আমাদের ‘এক ভবিষ্যতের’ জন্য আশা জাগানো। আমাদের গ্রহের নিরাময়ের জন্য, আমরা প্রকৃতির প্রতি ভারতের আস্থাশীলতার ঐতিহ্যের ভিত্তিতে টেকসই এবং পরিবেশ-বান্ধব জীবনধারাকে উত্সাহিত করব।

আমাদের মানব পরিবারের মধ্যে সমন্বয়ের প্রচারের জন্য আমরা খাদ্য, সার এবং ওষুধ পণ্যের বৈশ্বিক সরবরাহকে রাজনীতি মুক্ত করতে চাইব, যাতে ভূ-রাজনৈতিক উদ্বেগ মানবিক সংকটে পরিণত না হয়। আমাদের নিজেদের পরিবারের মতোই যাদের সবথেকে প্রয়োজন বেশি তারা অবশ্যই সবসময় আমাদের চিন্তায় প্রাধান্য পাবে।

আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে আশা জাগানোর জন্য আমরা ক্ষমতাধর দেশগুলোর মধ্যে সৎ আলোচনাকে উৎসাহিত করব– গণবিধ্বংসী অস্ত্রের হুমকিকে প্রশমিত এবং বৈশ্বিক শান্তিকে দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য।

ভারতের জি২০ এজেন্ডা হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক, উচ্চাকাঙ্ক্ষী, কর্মমুখী এবং সিদ্ধান্তমূলক। আসুন, একসাথে আমরা ভারতের জি২০ সভাপতিত্বকে নিরাময়, সম্প্রীতি এবং আশায় পরিণত করি।

আসুন, বিশ্বায়নের একটি নতুন দৃষ্টান্ত সৃষ্টিতে আমরা একযোগে কাজ করি।

লেখক: ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।