জি২০’র নেতৃত্বে বিশ্বে মডেল হতে পারে ভারত

সংগৃহীত ছবি

জি২০’র নেতৃত্বে বিশ্বে মডেল হতে পারে ভারত

হর্ষবর্ধন শ্রীংলা

১ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সংগঠন-জি-২০ এর রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেছে ভারত। বিশ্ব সম্প্রদায়ের এই চ্যালেঞ্জিং সময়ে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হবে ভারতের জন্য। ভারতের প্রেসিডেন্সি হবে এখন পর্যন্ত জাতীরভাবে আয়োজন করা সবচেয়ে ঐতিহাসিক এবং গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক ইভেন্ট। আজকের এই শক্তিশালী ভূ-রাজনৈতিক মেরুকরণের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের প্রেসিডেন্সি পদের চ্যালেঞ্জ এবং প্রত্যাশাগুলো খুবই কঠিন হবে।

আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপে অনুষ্ঠিত জি-২০’র রাষ্ট্রদূতদের প্রাক-প্রেসিডেন্সি ব্রিফিংয়ে একটি উপলব্ধি ছিল যে, যদি কোনো দেশ এই সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারে, তবে তা একমাত্র ভারত।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বিশ্বব্যাপী সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়। তা সেটি জাতিসংঘ, জি-৭, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, কোয়াড, সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা বা ব্রিকস যেখানেই হোক না কেন।

বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খাদ্য ও জ্বালানি আমদানি ব্যয় বাড়ার প্রভাব যেসব উন্নয়নশীল দেশের ওপর বেশি পড়েছে তারা ভারতের প্রেসিডেন্সিতে ভরসা রাখুন যাতে তাদের প্রয়োজন ও সমস্যার কথা বলা যায় এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এনে সমস্যার সমাধান করা যায়।

ভারত তার নাগরিকদের অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং দ্রুত উন্নয়নের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জগুলোর সমাধান প্রদান করতে পারে।

ভারতের সর্বস্তরের নাগরিকই প্রযুক্তি ব্যবহার করে সরকারি পরিষেবা পেতে, অর্থ প্রদান করতে এবং এমনকি তাদের সম্মিলিত অভিযোগের সমাধান করতে পারছে। বিশ্বের মেরুকরণ এবং প্রযুক্তিগত বিভক্তির এই সময়ে ভারত বিশ্বকে একটি ন্যায়সঙ্গত ও ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে যেতে চেষ্টা করবে।

করোনা মহামারি ভারতকে একটি কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করেছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ও নাগরিকদের কল্যাণ নিশ্চিতে একটি কর্মপন্থা গ্রহণ করে সরকার।

একইসঙ্গে ভ্যাকসিন কূটনীতির মিশনে অংশ নেয় ভারত, যার মাধ্যমে ভ্যাক্সিনের কাঁচামাল প্রাপ্তি ও অর্থ মওকুফসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে উৎপাদন সুবিধা ভাগাভাগি করার মাধ্যমে মহামারি মোকাবেলায় বিশ্বব্যাপী প্রচেষ্টার অগ্রভাগে ছিল।

এই অভূতপূর্ব সহযোগিতার সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো, আলাদা আলাদা দেশ থেকে বিশ্বব্যাপী জাতিসত্তা হিসেবে আমরা বেশি বড়। আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ফলাফল কখনোই শূন্য নয়। ২০১৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেছিলেন, ‍‌‘আমাদের ভাগ্য একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত। ’  আমাদের অবশ্যই এমন একটি যুগের সূচনা করতে হবে, যা সমস্যা সমাধানের জন্য বিশ্বব্যাপী একত্রে কাজ করবে।  প্রধানমন্ত্রী জোর দিয়ে বলেছেন, ভারতের জি-২০ প্রেসিডেন্সির লক্ষ্য হবে বিশ্বের ভালো এবং কল্যাণ করা। ’

ভারতের রয়েছে একটি দ্রুত বর্ধমান বৃহৎ অর্থনীতি, যার মূল ভিত্তি একটি সামষ্টিক অর্থনীতি, শক্তিশালী পাবলিক ফাইন্যান্স ও উৎপাদন এবং ক্রমবর্ধমান রপ্তানি। ভারত সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের শীর্ষ গন্তব্য। এটি বিশ্বের বৃহত্তম ইন্টারনেট ব্যবহারকারী এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণকারী দেশ, যারা প্রযুক্তি ব্যবহারে ও উদ্ভাবনে এর শক্তি প্রদর্শন করেছে। ’

জনধন, আন্ধার, মোবাইল ফোন ট্রিনিটি, কোউইন, আয়ুষ্মান ভারতের মতো বিশ্বের অন্যতম সেরা ডিজিটাল পাবলিক অবকাঠামো মডেল রয়েছে ভারতের।

বালিতে অনুষ্ঠিত জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন, গত বছর বিশ্বের ৪০ শতাংশের বেশি রিয়েল-টাইম পেমেন্ট লেনদেন ইউপিআই (UPI) এর মাধ্যমে হয়েছিল। তিনি বলেন, ভারতের এই ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার ডিজিটাল পাবলিক পণ্য তৈরি করেছে যার মূল ভিত্তিতে রয়েছে আমাদের গণতান্ত্রিক নীতি 

দুঃখের বিষয়, অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশের নাগরিকদের কোনো ধরনের ডিজিটাল পরিচয়পত্র নেই। ভারতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, ডিজিটাল অবকাঠামো ব্যাপকভাবে ব্যবহারযোগ্য করে তোলা হলে তা আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম। ডিজিটাল প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একটি শক্তিশালী অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে।

ভারতের স্বাস্থ্য অবকাঠামো উদ্ভাবনী, খরচে  সাশ্রয়ী এবং বিশ্বব্যাপী মাপযোগ্য। এই অবকাঠামোর মধ্যে রয়েছে আয়ুষ্মান ভারত, ভ্যাকসিন উৎপাদন ইকোসিস্টেম-কোউইন (CoWin), ভ্যাকসিন মৈত্রী এবং জাতীয় ডিজিটাল স্বাস্থ্য মিশন।  

এছাড়া আয়ুর্বেদ এবং যোগব্যায়ামের মাধ্যমে স্বাস্থ্য চর্চার ক্ষেত্রেও ভারত  বিশ্বে অগ্রগামী। এই শক্তিশালী, বৈচিত্র্যময় এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক স্বাস্থ্য মডেলের মাধ্যমে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ শক্তিতে পরিণত হয়েছে ভারত।

বর্তমান সময়ের জটিল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বিশ্বের একটি নতুন এবং উদ্ভাবনী পদ্ধতির প্রয়োজন। আজকের জটিল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের কিছু নতুন এবং উদ্ভাবনী পদ্ধতির প্রয়োজন। সমসাময়িক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য আমাদের কিছু সরঞ্জাম দিয়েছে আধুনিক প্রযুক্তি।  

বিশ্বের উন্নয়ন এবং কল্যাণের জন্য একটি প্রযুক্তি মডেল প্রদান করতে পারে আধুনিক ভারত। করোনা বিস্তার ট্রাক করতে ভারতের প্রচেষ্টা আরোগ্য সেতু ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়া মহামারির বিস্তার ট্র্যাক করার জন্য ভারতের প্রচেষ্টা- আরোগ্য সেতু ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের সাফল্যের ওপর নির্ভর করে। ভারতের সফল টিকাদান কর্মসূচি পরিচালনা করা হয়েছিল কোউইন (CoWin) ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে।

এর থেকে এটা আশা করা যেতে পারে যে, ভারতের জি-২০ প্রেসিডেন্সি বিশ্বজুড়ে মানুষের সুবিধার জন্য প্রযুক্তির ব্যবহারে মনোনিবেশ করবে। ‌‘উন্নয়নের জন্য তথ্য’ নীতিটি ভারতের কার্যকালের সামগ্রিক নীতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হবে।  

আমাদের প্রেসিডেন্সির অধীনে আমরা করোনা মহামারির মতো স্বাস্থ্য সংকট মোকাবেলা করার জন্য জি-২০ অংশীদারী উন্নয়নশীল দেশগুলোর সক্ষমতাকে আরও শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা করব। একটি সামগ্রিক, বৈশ্বিক স্বাস্থ্য অবকাঠামো গড়ে তুলতে প্রচেষ্টা থাকবে ভারতের।

স্বাস্থ্য খাতের উদ্ভাবনের সুফল সবার কাছে পৌঁছাতে মেধাস্বত্ব সংরক্ষণ, উদ্ভাবন এবং স্বাস্থ্য প্রযুক্তির সহ-উন্নয়নের জন্য নতুন পদ্ধতির প্রয়োজন। স্বাস্থ্যের  সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং প্রমাণ-ভিত্তিক নীতি আমাদের যে সুবিধাগুলো প্রদান করতে পারে সেগুলির ওপরও আমাদের নজর দিতে হবে। জি-২০'র এই মডেলটির আন্তর্জাতিকীকরণ করা যেতে পারে। আধুনিক ভারতের বৈশ্বিকিকরণ করতে হবে।  

জি-২০ এমন একটি সংগঠন যার সদস্য দেশগুলো বিশ্বের মোট দেশজ উৎপাদনের প্রায় ৮৫ শতাংশ উৎপাদন করে এবং জনসংখ্যা বিশ্বের দুই তৃতীয়াংশ। জি-২০ তে যে সিদ্ধান্তগুলো কার্যকর করা হয়েছে তার প্রভাব থাকবে পরবর্তী প্রজন্ম পর্যন্ত।  

লেখক: হর্ষবর্ধন শ্রীংলা, বাংলাদেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত সাবেক ভারতীয় হাই কমিশনার এবং ভারতীয় সাবেক পররাষ্ট্র সচিব।