শতবর্ষ পর আমাদেরকে কেউ কি মনে রাখবে?

শতবর্ষ পর আমাদেরকে কেউ কি মনে রাখবে?

অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ

‘আজি হতে শতবর্ষ পরে’—কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই অমর কবিতাটি পড়তে পড়তে আমি হারিয়ে গেছি ভাবনার জগতে। শতবর্ষ পরে আমাকে, আপনাকে বা আমাদেরকে কেউ কি মনে রাখবে? কেন মনে রাখবে? শতবর্ষ আগে যারা ছিলেন, তাদেরকে কি আমরা মনে রেখেছি? জীবনে কেউ-ই অমর নয় সত্য, কিন্তু মানুষের স্মৃতিতে কারো কারো অমরত্বের রহস্য কী? 

জীবন তো ক্ষণস্থায়ী, পদ্মপাতার জল। কবির যেমন হাহাকার ‘দম ফুরাইলেই ঠুস’ বা ‘এক সেকেন্ডের নাই ভরসা, বন্ধ হইবো রং তামাশা’, বাউলের তেমনই উপলব্ধি ‘একদিন মাটির ভেতরে হবে ঘর রে মন আমার, কেন বান্ধো দালানঘর’। এটাই নির্মম সত্য।

কিন্তু এই ক্ষুদ্র জীবনের চলার পথে, আমরা কি তা মনে রাখি? কত ভালোবাসা! কত স্বপ্ন! জীবনকে ঘিরে কত আয়োজন! জীবন সাজাতে, জীবন রাঙাতে, মেধা-শ্রম-সময়ের কী অফুরান বিনিয়োগ! অথচ ভেবে দেখি না, পৃথিবী থাকার স্থান নয়, চিরদিন এখানে থাকা যায় না, কেউ থাকেনি। থাকা নয়, বরং চলে যাওয়াই সুনিশ্চিত। অথচ তার পরও আমরা সোনার হরিণ বা মরীচিকার পেছনে  আমৃত্যু দৌড়িয়েই চলছি।

এখন ২০২২ সাল।

 
আজ থেকে ১০০ বছর পরের কথা একটু কল্পনা করি। ক্যালেন্ডারের পাতায় তখন ২১২২। আজকে আমরা যারা এ পৃথিবীতে বেঁচে আছি, সে সময় আমাদের এক জনও হয়তো বেঁচে থাকব না। প্রত্যেকে আমরা পৃথিবী ছেড়ে চলে যাব। যখন ২১২২ সাল, আমাদের প্রায় প্রত্যেকের দেহ তখন মাটির নিচে, অস্তিত্ব তখন রুহের জগতে। ফেলে যাওয়া সুন্দর বাড়িটা, শখের গাড়িটা, জমিজমা, ধনসম্পদ, টাকা-পয়সা আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম তখন ভোগ করবে। একই নিয়মে দিন চলবে, কর্মযজ্ঞ চলবে। ‘তখন এমনি করেই বাজবে বাঁশি এই নাটে কাটবে গো দিন আজও যেমন দিন কাটে। ’ পৃথিবীর বুকে আজকের এই বেঁচে থাকা, এত হইচই, এত মায়াকান্না সব এভাবেই চলতে থাকবে। থাকব না শুধু আমি, ‘একই সে বাগানে আজ এসেছে নতুন কুঁড়ি, শুধু সেই সেদিনের মালি নেই। ’

আচ্ছা, তখন কি আমার কথা কেউ ভাববে? আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম কি আমাকে বা আমাদেরকে মনে রাখবে? নাকি যাদের জন্য সব করতে গিয়ে নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলাম, তাদের হাতে সময় হবে না আমাকে মনে রাখার। তারা হয়তো তখন নতুন স্বপ্নে বিভোর, নতুন উদ্যমে জীবন সাজাচ্ছে, সেই একই চক্রে বাঁধা পড়ছে, অজান্তে।  

যদি নিজেদের প্রশ্ন করি, আমরাই কি আমাদের ১০০ বছর আগের প্রজন্মকে মনে রেখেছি? আমাদের দাদার দাদা, নানার নানা, বা অন্য পূর্বপুরুষদের কথা কি আমরা জানি? তাদের নামটাই-বা আমরা কতজন বলতে পারব? মাত্র দুই কি তিন পুরুষের ব্যবধানে নামটা পর্যন্ত হারিয়ে যায়, পরিচয় তো পরে। নেহাত যুগশ্রেষ্ঠ পুরুষ বা নারী না হলে, সবাই হারিয়ে যায় কালের অন্তরালে।  

এই ভাবনা কষ্টকর বৈকি। তাহলে পৃথিবীতে এসে এত কিছু অর্জন করে আমাদের কী লাভ হলো? যে পিতামাতা সন্তানের জন্য জীবনের সব সময়, শ্রম, ধনদৌলত বিনিয়োগ করেছিলেন, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য নিজের সবটুকু নিংড়ে দিয়েছিলেন, নিজের জন্য রাখেননি কিছুই, চলে যাওয়ার পর তাদের কথা কেউ মনে রাখে না, ভাবে না, স্মরণ করে না, এর চেয়ে দুঃখের আর কী হতে পারে! আসলে এই পৃথিবীতে নিজের বলে কিছুই নেই।  

শৈশব থেকে যে প্রচণ্ড দৌড়, এর গন্তব্য কোথায়? আমরা স্কুলে ভালো রেজাল্টের জন্য, কর্মে সাফল্য আর পদোন্নতির জন্য, অর্থ-যশ-খ্যাতি-ক্ষমতার জন্য ছুটে চলি। অন্যকে টেনে নামাতে, ছিদ্রান্বেষণে, কালিমা লেপনে ছোটাছুটির অন্ত নাই। স্বাস্থ্যরক্ষার জন্যও কত প্রাণান্তকর চেষ্টা, তাতে কি শেষ রক্ষা হয়? এ ছুটে চলার মাঝে ‘বারবার কারো পানে ফিরে চাহিবার নাই যে সময়, নাই না’। অথচ ‘কালস্রোতে ভেসে যায় জীবন যৌবন ধন মান’। আর শেষকালে মনে হয় ‘তুমি কার, কে তোমার’, কী রেখে যাই, কী নিয়ে যাই, কার স্মৃতিতে ঠাঁই পাই। দৌড়ই যার একমাত্র কর্ম, গন্তব্যেই তার সমাপ্তি। অনাগত কাল কেন তবে আমাকে মনে রাখবে?
চলে যাওয়া অসংখ্য প্রজন্মের পথ বেয়ে আমরা এই জীবন লাভ করেছি, আবার আগামীর দিনে এমনি অসংখ্য প্রজন্মের ভিড়ে আমরা হারিয়ে যাব। এই অনন্ত মিছিলের মধ্যে নিজেকে কীভাবে তুলে ধরা যায়? ভালো কাজ। মানুষের জন্য কাজ করে, মানুষের তরে জীবন উৎসর্গ করে, মানুষের প্রয়োজনে নিজের সময়-সম্পদ-সামর্থ্য ঢেলে দিয়েই মানুষের স্মৃতিতে স্থান করে নেওয়া সম্ভব। আসলে বাস্তবতা হচ্ছে এই জীবনটা আমাদের কল্পনার চেয়েও ছোট। এই স্বল্প সময় বিলাসব্যসনে পার করে দেওয়া যায় বইকি, কিন্তু তার চেয়ে হাজার গুণে উত্তম হবে পরার্থে পরিচালিত করা।  

কিন্তু আমরা কি তা করছি? মানুষ তো সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব, আল্লাহ তাআলা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই কিন্তু মানুষকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, যেন তারা স্রষ্টার আরাধনা এবং অন্যের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করে। তেমন আচরণ কি আমরা করছি? আমরা কি নিজের সময়, শ্রম, জ্ঞান মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত করছি? বরং এর বিপরীত। আজ আমরা সামান্য কারণে মানুষের প্রতি বিরাগভাজন হই, মানুষকে ঠকাই, পরনিন্দা করি, অন্যের হক নষ্ট করি, অবিচার করি, মারামারি করি, এমনকি মানুষকে খুনও করে ফেলি। মানুষের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি, মারামারি, কাটাকাটি, হিংস্রতা, নিষ্ঠুরতা, যুদ্ধবিগ্রহ, লোভলালসা, অহংকার, সহনশীলতার অভাব, ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থপরতা এখন সারা পৃথিবীব্যাপী ভয়ংকর রূপ ধারণ করছে। মানবিক মূল্যবোধ, মায়া-মমতা, মানবতা, পরার্থপরতা আজ ভূলুণ্ঠিত।  
তাই আসুন, মানুষকে ভালোবাসি, অসহায়দের প্রতি সাহায্যের হাতটা বাড়িয়ে দিই। জীবন যে দুদিনের, সেই অল্প সময়টাকে মানুষের কাজে লাগাই। এতে ক্ষণকালের ভোগবিলাস হয়তো কম হবে, কিন্তু তার প্রতিদান পাওয়া যাবে পরবর্তী অনন্ত জীবনে, যেখান থেকে আর ফেরা যাবে না কখনো। অনন্ত পরকালে বিশ্বাসী যারা, তাদের এতে দ্বিমত হওয়ার কোনো উপায় নেই। যে উদ্দেশ্য নিয়ে আল্লাহতায়ালা আমাদের এ সুন্দর পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, আমরা কি তার মর্যাদা দিতে পারছি? যে ধর্মই মেনে চলেন না কেন, সব ধর্মই মানবসেবার কথাই বলে। মানুষকে কষ্ট দেওয়া, মানুষকে ঠকানো, মানুষের ক্ষতি করা কোনো ধর্মই প্রশ্রয় দেয় না।

আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের মৃত্যুশয্যার একটি গল্প প্রচলিত আছে। তিনি মাত্র ৩৩ বছর বেঁচেছিলেন। এই অল্প সময়েই তিনি হয়েছিলেন দিগ্বিজয়ী বীর। কিন্তু মৃত্যুর সময় তিনি আসলে কী নিয়ে গেলেন? বলা হয়, মৃত্যুশয্যায় আলেকজান্ডার তার জেনারেলদের ডেকে  বলেছিলেন, আমার মৃত্যুর পর তিনটা ইচ্ছা তোমরা পূরণ করবে। ‘আমার প্রথম অভিপ্রায়, শুধু ডাক্তারেরা আমার কফিন কবরস্থানে বহন করে নিয়ে যাবে। আমার দ্বিতীয় অভিপ্রায়, আমার কফিন যে পথ দিয়ে গোরস্থানে নিয়ে যাওয়া হবে, সেই পথের দুপাশে আমার কোষাগারে সংরক্ষিত টাকাপয়সা, মণিমুক্তা, সোনাদানা, রুপা ছড়িয়ে দেবে। শেষ অভিপ্রায়, কফিন বহনের সময় আমার দুই হাতের তালু ওপর দিকে রেখে কফিনের বাইরে রাখবে। ’

উপস্থিত সবাই আলেকজান্ডারের এই অদ্ভুত অভিপ্রায়ে বিস্মিত হন। কিন্তু এ ব্যাপারে তাকে কেউ কিছু জিগ্যেস করার সাহস পাচ্ছিলেন না। তখন তার একজন প্রিয় সেনাপতি তার হাতটা তুলে ধরে চুম্বন করে বলেন, ‘হে মহামান্য, অবশ্যই আপনার সব অভিপ্রায় পূর্ণ করা হবে। কিন্তু আপনি কেন এই বিচিত্র অভিপ্রায় ব্যক্ত করলেন?’ দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে আলেকজান্ডার বললেন, ‘আমি দুনিয়ার মানুষের সামনে তিনটি শিক্ষা রেখে যেতে চাই। আমি আমার ডাক্তারদের কফিন বহন করতে বলেছি, যাতে লোকে অনুধাবন করতে পারে ডাক্তাররা রোগের চিকিত্সা করে মাত্র, মৃত্যুর থাবা থেকে কাউকে রক্ষা করতে অক্ষম।

মৃত্যু যখন আসবে তখন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ডাক্তারেরা একসঙ্গে মিলেও বাঁচাতে পারবে না। গোরস্থানের পথে সোনাদানা ছড়িয়ে রাখতে বলেছি, মানুষকে এটা বোঝাতে যে, ঐ সোনাদানার একটা কণাও আমার সঙ্গে যাবে না। আমি এগুলো পাওয়ার জন্য সারাটা জীবন ব্যয় করেছি, কিন্তু নিজের সঙ্গে কিছুই নিয়ে যেতে পারছি না। মানুষ বুঝুক, ধনসম্পদের পেছনে ছোটা সময়ের অপচয় মাত্র। আর কফিনের বাইরে আমার হাত ছড়িয়ে রাখতে বলেছি, যাতে মানুষ শিক্ষাগ্রহণ করতে পারে যে, আমরা এই দুনিয়ায় খালি হাতে এসেছিলাম, যখন সময় ফুরিয়ে যাবে, তখন আবার খালি হাতেই চলে যাব। ’ 
বাউলের ভাষায়, ‘খ্রিষ্টান হইলে কফিনে, মুসলিম হইলে কাফনে, হিন্দু হইলে চিতায় পুড়ে ছাই। ও মানব, দুই দিনের এই দুনিয়াতে, গৌরব করার নাই রে কিছু নাই। ’

স্বামী বিবেকানন্দের একটা বাণী দিয়ে শেষ করছি। তিনি বলেন ‘হে মানুষ কোথায় চলে যাবি রে, পদচিহ্ন রেখে যা’। জীবন একটাই, চিহ্ন রেখে যাওয়ার সুযোগও একটাই। এই সুযোগ যে নেবে, সেই রয়ে যাবে শতবর্ষের স্মৃতিতে।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক