পিষে মারার আগে বাসেই পেটানো হয় রনিকে

বাসের নিচে ফেলে পেষে মারা হয় রনিকে

বৈধ কাগজপত্র নেই

পিষে মারার আগে বাসেই পেটানো হয় রনিকে

নিউজ টোয়েন্টিফোর ডেস্ক

বুকের ওপর বাস চালিয়ে দিয়ে হত্যা করা হয় বাসযাত্রী রেজাউল করিম রনিকে। তাও সকল যাত্রীর সামনেই। হত্যার আগে বাসের ভেতরেই কাঠের ব্রাশ দিয়ে পেটানো হয় তাকে। এরপর তাকে ছুড়ে ফেলে দেয় বাসের নিচে।

টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয় অন্তত ৫০ ফুট। ঝরে যায় তাজা প্রাণটি। যাত্রীরা উঠে চালক-হেলপারকে ধরতে যাবে, এমন সময়ই লাফ দিয়ে জনতার ভিড়ে হারিয়ে যায় তারা।

এ সময় বাসযাত্রীরা ‘লোকটা মরে গেল বুঝি’ বলে চিৎকার দিয়ে নেমে দেখেন রাস্তায় পড়ে আছে রনির নিথর দেহ।

বাসযাত্রীরা জানান, বাসের মধ্যে ওই চালক-হেলপারের আরও কয়েকজন সহযোগী ছিলেন। তারা সবাই মিলে মারধর করে রনিকে। যাত্রীরা যার যার জায়গায় থেকে প্রতিবাদ করলে ওই সহযোগিতারা যাত্রীদের চুপ থাকতে বলে শাসান।

সর্বত্র বলাবলি হচ্ছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সিটি গেটের অদূরে কালিরহাট এলাকায় সোমবারের এ ঘটনা আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল পরিবহন শ্রমিকরা এতটুকু বদলায়নি। ছাত্রদের আন্দোলন, সরকারের নতুন আইন চালকদের মধ্যে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন আনতে পারেনি। তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।

কিছুদিন আগেই ঢাকার দুই শিক্ষার্থী রাজিব-দিয়ার মৃত্যু ও চট্টগ্রামে পায়েলসহ তিন ছাত্রকে চাপা দিয়ে হত্যার পর দেশে প্রতিবাদ-বিক্ষোভের আগুন জ্বলে ওঠে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সাময়িক জনভোগান্তি তৈরি করলেও একইসঙ্গে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় ট্রাফিক বিভাগের নানা ত্রুটি। অনেক রাজনীতিবিদ, আমলা, জনপ্রতিনিধি, পুলিশ কর্মকর্তারাই আইন না মেনে, লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালান- এমন নানা ঘটনা সামনে আসে। আন্দোলনের মুখে দ্রুততার সঙ্গে অনুমোদন হয় নতুন সড়ক আইন। কিন্তু, বদলায়নি চালকদের মানসিকতা। এর সর্বশেষ প্রমাণ- ভাড়া নিয়ে বাকবিতণ্ডার জেরে রনিকে বাসের চাকার নিচে ফেলে হত্যা। ঘাতক বাসের চালক ও হেলপারের পরিচয় মিললেও পুলিশ খুঁজে পাচ্ছে না তাদের। লুসাই পরিবহনের যে বাসটিতে এ ঘটনা ঘটে তার বৈধ কাগজপত্রও পাওয়া যায়নি বলে জানা গেছে।

কী ঘটেছিল সেদিন?
সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারি থেকে কালিরহাটে যাওয়ার উদ্দেশে বাসে উঠেছিলেন রনি। সেদিন বাসে চালক-হেলপারের সঙ্গে কথা কাটাকাটি, মারধর ও সামনে গেলে দেখে নেওয়ার হুমকির এক পর্যায়ে জিল্লুর রহমান নামের এক প্রতিবেশীকে ফোন করেছিলেন রনি। তখন দুপুর দেড়টা। ফোন করে জিল্লুর রহমানকে দ্রুত কালিরহাট এলাকায় যেতে বলেন। হয়ত কোন বিপদের গন্ধ আঁচ করতে পেরেছিলেন। জিল্লুর বলেন, রনি ফোন দিয়ে জানায়, ভাড়া নিয়ে কথা কাটাকাটির জেরে তাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করছে বাসের হেলপার এবং চালক। মারধরও করছে। রনি আমাকে কালিরহাট এলাকায় আসতে বলেন। আমি দ্রুত বাসা থেকে বের হয়ে কালিরহাটের দিকে যাই। এ সময় দেখি চট্টগ্রামের নিউমার্কেটগামী ৪ নম্বর রুটের সিটি সার্ভিস বাস দ্রুত চলে যাচ্ছে। বাসের চাকার নিচে থেঁতলানো কাউকে দেখতে পাই। ভাবতে পারিনি ওই থেঁতলানো লোকটিই রনি। ওই সময় যাত্রীরা চিৎকার করছিল। বাসটি থামার পর কাছে যেতেই দেখি জানালা দিয়ে একজন লাফ দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়। আরও কয়েকজন পেছনে। তখনও বুঝতে পারিনি ওই বাসের চাকার নিচে পিষ্ট হয়েছে ছোট ভাই রনি। একটু আগে যার সঙ্গে কথা বললাম সেই ভাইটির ছিন্নভিন্ন দেহ দেখে নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না।

বাসযাত্রীদের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, বাসের ভেতরেই কয়েকজন মিলে রনিকে বাস ঝাড়ু দেয়ার কাঠের ব্রাশ দিয়ে পেটায়। বাসচালক দিদার ও তার সহযোগী মানিকসহ কয়েকজন মিলে কালুশাহ মাজার এলাকার স্টপেজ এলাকায় রনিকে মারধর করে। পরে তাকে বাসের দরজা দিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে বুকের ওপর দিয়ে বাস চালিয়ে দেয়। অন্তত ৫০ ফুট দূরে গিয়ে থামে রনির রক্তাক্ত মরদেহ। এরপর বাস থামিয়ে জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে পালিয়ে যায় চালক, হেলপার ও সহযোগীরা। কয়েকজন যাত্রী তাদের পেছনে ধাওয়া করলেও ধরতে পারেননি।

জানা গেছে, লুসাই পরিবহনের ঘাতক বাসের মালিকের নাম শাহাবুদ্দিন। পরিচয় মিলেছে বাসের চালক দিদারুল আলম (৩৫) ও তার হেলপার মানিকের (৩২)। তাদের বাড়ি চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে। নগরীর কালুশাহ মাজার এলাকায় থাকেন। তবে ঘটনার পর থেকে তারা পলাতক।

আকবর শাহ থানার ওসি জসিম উদ্দিন বলেন, বাসটির রুট পারমিট, ফিটনেস ছিল কিনা সে বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। তদন্তের স্বার্থে এখনই বিস্তারিত বলতে পারছি না। চালক ও হেলাপরকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। শিগগিরই তারা ধরা পড়বে।

চট্টগ্রামের এমন ঘটনায় ক্ষুব্ধ দেশের মানুষ। মানুষ বলছে, গাড়ির ফিটনেস, রুট পার্মিট তো আইনের বিষয়, চট্টগ্রামে রনিকে যেভাবে মারা গেল সেটা তো কোন দুর্ঘটনা নয়, সরাসরি খুন। সাম্প্রতিক সময়ে অনেক চালক-হেলপারের মধ্যে হিংস্র মনোভাব দেখা যায়। কথায় কথায় যাত্রীদের প্রতি ক্ষিপ্র হয়ে ওঠে। অনেক হেলপারের হাতে, মুখে অনেক কাটাছেড়া দাগ দেখা যায় যা দুর্ঘটনার দাগ নয়, ধারালো অস্ত্রের আঘাত। এসব চালক-হেলপারের অনেকেই ছিনতাই-ডাকাতির মতো ঘটনার সঙ্গে জড়িত বা জড়িত ছিল বলে ধারণা অনেকের। এ বিষয়টাও নজরে আনতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও বাসমালিকদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন সচেতন সমাজ।

সম্পর্কিত খবর