রাঙামাটি কাপ্তাই হ্রদে মৎস্য উৎপাদনে সংকট

রাঙামাটি কাপ্তাই হ্রদে মৎস্য উৎপাদনে সংকট

ফাতেমা জান্নাত মুমু, রাঙামাটি

ভরা মৌসুমেও মিলছে পর্যাপ্ত মাছ। সময়ের আগেই মৎস্য উৎপাদানে পড়েছে ভাটা। এতে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়েছে ব্যবসায়ীদের মধ্যে। নানা শঙ্কায় জেলেরাও।

বলছি, রাঙামাটির দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্ববৃহৎ কৃত্রিম জলধারা ও বাংলাদেশের প্রধান মিঠা পানির মৎস্য উৎপাদন ক্ষেত্র রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদের কথা।

একটা সময় এ হ্রদকে মৎস্য প্রজাতির বৈচিত্র্যময় ও সমৃদ্ধশালী জলভাণ্ডার বলা হতো। কিন্ত সম্প্রতি বছরগুলোতে রাঙামাটি কাপ্তাই হ্রদ নিয়ে দেখা দিয়েছে নানামুখী সমস্যা। ড্রেজিংয়ের অভাব, গভীরতা হ্রাস, পানি ও পরিবেশ দূষণের কারণে বিলুপ্ত হয়ে গেছে এ হ্রদের বহু প্রজাতির মাছ।

তাই মারাত্মক হুমকির মুখে পরেছে কাপ্তাই হ্রদের মৎস্য সম্পদ।

রাঙামাটি বিএফডিসি বলছে, ভরা মৌসুম চলছে রাঙামাটি কাপ্তাই হ্রদের মৎস্য উৎপাদনে। কিন্তু তবুও জেলেদের জালে মিলছে না মাছ। একটা সময় ঠিক এ মোৗসুমে রাঙামাটি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে মাছের পাহাড় জমে যেত। দমফেলার ফুরসোত পেত না মৎস্য কর্মচারী ও ব্যবসায়ীরা। কিন্তু এখন এ মৌসুমে মাছ আসছে প্রতিদিন গড়ে ৭থেকে ৮টন। ঘাটতি রয়েছে আরও ৫০থেকে ৬০ টন। তাই গেলো বছরের তুলনায় রাজস্ব আয়ও হচ্ছে না তেমন। বেকার সময় পাড় করছে কর্মচারীরাও।

রাঙামাটি মৎস্য ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করে বলেন, ২০২২ সালে শেষের দিকে রাঙামাটি কাপ্তাই হ্রদের মাছ বাণিজ্যিকভাবে রপ্তানি হতো ২২ট্রাকে। কিন্তু মাত্র তিন মাসে ব্যবধানে মাছ আহরণ কমে যায় উল্লেখযোগ্য হারে। তাই ঢাকায় মাছ পরিবহণের গাড়ি যায় মাত্র একটি। এ ধারা অব্যাহত থাকলে মাছ রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ীরা।

এ ব্যাপারে ফিসারিঘাটের মৎস্য ব্যবসায়ী মো. ইলিয়াস বলেন, রাঙামাটি কাপ্তাই হ্রদ ঘিরে মাছের উপর জীবন ও জীবিকা চলে প্রায় অর্ধলাখ মানুষের। কিন্তু এভাবে মাছ উৎপাদন সংকট হলে না খেয়ে মরতে হবে মৎস্যজীবীদের। অদৃশ্য কারণে জেলেদের জালে মিলছে না মাছ। তাই বাণিজ্যিকভাবে রপ্তানিও হচ্ছে না। বেকার শ্রমিক, কর্মচারী কর্মকর্তারা। আয়ের চেয়ে বেড়েছে ব্যয়।

মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে, ১৯৬৪ সালে রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদে ২ প্রজাতির চিংড়ী, ১ প্রজাতির ডলফিন, ২ প্রজাতির কচ্ছপসহ ৭৬ প্রজাতির মিঠা পানির মাছ ছিল। তার মধ্যে ৬৮ প্রজাতির দেশীয় ও ৮ প্রজাতির বিদেশি মাছ ছিল। ক্রমাগতভাবে তা হ্রস পেয়ে নেমে আসে ৪২টি প্রজাতির মাছ কোটাই। এরপর নেমে আসে ৩২ প্রজাতিতে। আর বর্তমানে ২৩ প্রজাতির মাছ রাঙামাটি হ্রদ থেকে বাণিজ্যিকভাবে আহরিত হলেও তা থেকে বিলুপ্তের পথে আরও ৬ প্রজাতির মাছ।

তাছাড়া ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হয়েছে- সীল, দেশি সরপুঁটি, ঘাউরা, বাঘাইড়, মোহিনী বাটা, দেশি পাঙ্গাস, দেশীয় মহাশোল, মধু পাবদা, পোয়া, ফাইস্যা, তেলে গুলশা, সাদা ঘনিয়া। আর ক্রমে হ্রাস পাচ্ছে - রুই, কাতলা, মৃগেল, বাঁচা, পাতি গাবদা, বড় চিতল। আরও কয়েক প্রজাতির দেশীয় মাছ বিলুপ্তির পথে। কার্প মাছের তালিকাভূক্ত রুই, কাতলা, মৃগেল মাছের আহরণের পরিমানও আশঙ্কাজনক হারে কমে এসেছে। তবে কাপ্তাই হ্রদে মাছের এই পরিবর্তনকে গুরুত্ব সহকারেই দেখছেন মৎস্য বিশেষজ্ঞরা।

রাঙামাটি মৎস্য উন্নয়ন অধিদপ্তর ও বিপনি কেন্দ্র (বিএফডিসি) ব্যবস্থাপক কমান্ডার এম তৌহিদুল ইসলাম ট্যাজ বলেন, রাঙামাটি কাপ্তাই হ্রদের যেসব মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র ছিল সেগুলো প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। তাই মাছে প্রাকৃতি প্রজনন ক্ষমতাও কমে গেছে। দীর্ঘ বছরেও রাঙামাটি কাপ্তাই হ্রদের ড্রেজিং না হওয়ার কারণে পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে হ্রদের মাছের সুষ্ঠু ও প্রাকৃতিক প্রজনন স্থান। এছাড়া সময়ের আগে রাঙামাটি কাপ্তাই হ্রদে আশঙ্কাজনক হারে কমছে হ্রদের পানিও। এভাবে হ্রদের পানি হ্রাস পেলে মাছ শিকার বন্ধ করে দিতে হবে। না হয় মাছের বংশ ধ্বংস হয়ে যাবে।

এছাড়া হ্রদ জুড়ে দখল করেছে কচুরি পানা। শীত আর কচুরিপানার জন্য জেলেদেরও মাছ শিকারে সমস্যায় পরতে হচ্ছে। এজন্য উৎপাদনে সংকট দেখা দিয়েছে। সব মিলে কাপ্তাই হ্রদে নানামুখী সংকট তৈরি হচ্ছে। তাই কাপ্তাই হ্রদকে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে আগের রূপে ফিরিয়ে আনতে হবে।

উল্লেখ্য, ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধের কারণে সৃষ্ট দেশের এই বৃহত্তম কৃত্রিম হ্রদটিকে মৎস্য সম্পদের ভান্ডারে পরিণত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনকে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তারপর ১৯৬৪ সাল থেকে হ্রদ থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মৎস্য আহরণ শুরু হয়। কালের পরিবর্তণে অযত্ন অবহেলা আর ড্রেজিংয়েরে অভাবে হুমকির মুখে রাঙামাটির এ কাপ্তাই হ্রদ।

এই রকম আরও টপিক