‘দাওয়াত’ এর অর্থ হলো আল্লাহর দিকে মানুষকে আহ্বান করা। আর ‘তাবলীগ’ হচ্ছে আল্লাহর আহকাম এর দিকে মানুষকে আহ্বান করা। ‘তাবলীগ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ প্রচার করা, প্রসার করা, ইসলামের দাওয়াত দেওয়া, বয়ান করা, প্রচেষ্টা করা বা পৌঁছানো প্রভৃতি। একজনের অর্জিত জ্ঞান বা শিক্ষা নিজ ইচ্ছা ও চেষ্টার মাধ্যমে অন্যের কাছে পৌঁছানো বা অপরকে শেখানোকে তাবলীগ বলা হয়।
দাওয়াত ও তাবলীগ সম্পর্কে কিছু প্রামাণ্য দলিল
অনেকে দাওয়াতে তাবলীগকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ভাবেন। অনেকে নানা সমালোচনা করেন। কিন্তু এটা ঠিক যে, নবী-রাসূলদের মূল দায়িত্ব ছিল দাওয়াত এবং তাবলীগ।
- দশম হিজরিতে আরাফাতের ময়দানে বিদায় হজের ভাষণে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছিলেন, ‘আমিই সর্বশেষ নবী, বিধায় নবুওয়াত ও রিসালাতের অব্যাহত ধারার এখানেই পরিসমাপ্তি। অনাগত কালের মানুষের জন্য দ্বীনের পরিচয় বিধৃত আল কোরআন ও সুন্নাহ রেখে গেলাম। এগুলো মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব তোমাদের। ’
সাহাবিরা এ বক্তব্য শোনার পরপরই তাবলীগ করার জন্য তথা দ্বীনের দাওয়াত দেওয়ার জন্য সারা পৃথিবীতে সফর করেন। এভাবে অনেক সাহাবায়ে কিরাম, তাবেঈন, তাবে-তাবেঈন, ওলি-আউলিয়া, সুফি-দরবেশ ও হাক্কানি আলেম সমাজের কঠোর ত্যাগ-তিতিক্ষা ও বিসর্জনের জন্য তাবলীগের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ইসলাম প্রচার ও প্রসার লাভ করেছে।
- প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) নির্দেশ দিয়েছেন, তাঁর একটি বাক্য যদি আমাদের কারো জানা থাকে, তা অন্যদের পৌছে দিতে। রাসুল (সা.)-এর এই নির্দেশ পালন করা সব মুসলমানের জন্য জরুরি। দাওয়াত ও তাবলীগ এর জন্য মুসলমানদের এক জামাত বিশ্বব্যপী এ কাজটিই করছে।
- আল্লাহ তাআ’লা ঘোষণা করেছেন, ‘তোমরাই সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি; মানবজাতির কল্যাণের জন্য তোমাদের নির্বাচন করা হয়েছে। তোমরা মানুষকে সৎ কাজের আদেশ করবে ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করবে, আর তোমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে। ’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত-১১০)
- আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন, ‘আমি চাই তোমাদের মধ্যে এমন একদল লোক হোক যারা মানুষকে সত্যের পথে আহ্বান করবে, ভালো কাজের আহ্বান করবে আর মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখবে। ওই দলটাই হলো সাফল্য লাভকারী। ’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত-১০৪)
- ‘আল্লাহর রাস্তায় এক সকাল বা এক বিকাল ব্যয় করা সারা দুনিয়ার মধ্যে যা কিছু আছে তার চেয়ে উত্তম। ’ ‘হে মুমিনগণ, তোমাদিগকে কি এমন একটি ব্যবসার সন্ধান দান করব যা তোমাদেরকে কঠোর আজাব থেকে রক্ষা করবে? তা হলো- তোমরা আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের ওপর ঈমান আনবে, মেহনত করবে আল্লাহর রাস্তায় মাল ও জান দিয়ে। ’ (সূরা আস-সাফ, আয়াত-১০)।
- ‘তার কথার চেয়ে উত্তম কথা আর কার হতে পারে, যে মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকে, নেক আমল করে এবং সে বলে, আমি মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত। ’ (সূরা হা-মীম আস-সাজদা, আয়াত-৩৩)।
হযরত ইবরাহিম (আ.) এই উম্মতের জন্য এমন একজন নবী/রাসুল চেয়েছেন, যিনি যে রাস্তা ও নিয়ম এই উম্মতকে দেবেন- এই উম্মত ঠিক সেইভাবে চলবেন। আল্লাহ পাক হযরত ইবরাহিম (আ.) এর দোয়া কবুল করেছিলেন। তাঁর দোয়ার কারনে আখেরি নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) কে প্রেরণ করেন।
দাওয়াত ও তাবলীগ কাদের জন্য?
দাওয়াতের মেহনত নতুন কিছু নয়। এর মাধ্যমে নিজেকে তৈরি করা ও অন্যকে দাওয়াত দেয়া। এই আমলের দ্বারাই দীলে একিন দুরস্ত হয়ে আমলও ঠিক হয়ে যায়। কোনো দেশ, কোনো অঞ্চল বা কোনো গোষ্ঠীবিশেষের জন্য ইসলাম ধর্ম প্রেরিত হয়নি। ইসলাম সমগ্র বিশ্বের সব যুগের সব মানুষের ধর্ম। তাই দুনিয়াবাসীর জন্য ইসলামই হলো একমাত্র অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় আদর্শ। পথভ্রষ্ট মানবজাতিকে পথের দিশা দিতে যুগে যুগে আল্লাহর মনোনীত ১ লাখ মতান্তরে ২ লাখ ২৪ হাজার নবী ও রাসূল দাওয়াত ও তাবলীগের দায়িত্ব পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পালন করে গেছেন। হজরত আদম আ. থেকে শুরু করে সর্বশেষ নবী ও রাসূল হজরত মুহাম্মদ সা.-এর আগমন ও ওফাতের মাধ্যমে এ ধারার সমাপ্তি ঘটে।
আজকের টঙ্গীর তুরাগ তীর
হুজুরে পাক (সা.) এর পর থেকে এ দায়িত্ব খোলাফায়ে রাশেদিন, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেইন, তাবে-তাবেইন, সলফে সালেহিন এবং আলেমরা পালন করছেন। ১৯৪১ সালে দিল্লির মেওয়াতে মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ শুরু করেন। এর সম্প্রসারিত রূপ আজকের টঙ্গীর তুরাগ তীরের বিশ্ব ইজতেমা। মানুষের মুক্তি ও কামিয়াবি হাসিলের উদ্দেশে এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা এবং আমলে সালেহ (সৎ কাজ বা ভালো কাজ) করাই এ দাওয়াতের মুখ্য বিষয়।
দ্বীনি দাওয়াতের অর্থ হলো দ্বীনের পথে মানুষকে আহ্বান করা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এর কোনো বিকল্প নেই। আল্লাহতায়ালা এ দাওয়াতি কাজটি ব্যক্তিগতভাবে, সমষ্টিগতভাবে সবার ওপর সমানভাবে দিয়ে দিয়েছেন। তাই প্রত্যেক মানুষের ওপরই তার স্বীয় ক্ষমতা অনুযায়ী সত্যের প্রচার করা জরুরি।
পথভোলা মানুষকে পথের সন্ধান দেয়া, বিপথগামী মানুষকে সঠিক পথে আনা, মানুষকে সুপরামর্শ দেয়া, চরিত্রবান ও সৎ সাহসী করা, অভাবগ্রস্ত, বিপদগ্রস্ত, দুস্থ, এতিম, অসহায়ের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া, মহৎ কর্মের উপমা সৃষ্টি করা, ভালো কাজে উৎসাহী করা, মন্দ থেকে বিরত রাখা, কর্মচঞ্চল করা, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়া- এক কথায় ইহকাল ও পরকালের শান্তির জন্য মানুষকে সত্য ও সরল পথে চলার আহ্বানই হচ্ছে দাওয়াত বা তাবলীগ।
ঘর ছাড়তে হবে কেন?
দাওয়াত ও তাবলীগে সময়, জান ও মাল উৎসর্গ করে আল্লাহর প্রকৃত প্রেমিক হতে হবে। তবেই মানুষ আহ্বানে সাড়া দেবে। নিজের আত্মিক উন্নতি ও দ্বীন শিক্ষার জন্য বাইরে না গেলে কোন ব্যক্তির রুহানী পরিবর্তন সম্ভব নয়। তাই দ্বীন শিখতে হলে ঘর ছাড়তে হবে। সকল নবী রাসূলেরা এই কাজ করে গেছেন। আমাদের প্রিয় নবী (সা.) নবুওয়াতের পূর্বে দীর্ঘদিন যাবত হিরা গুহায় মেহনত করেছিলেন কিভাবে জাতিকে তাওহিদমুখী করা যায়। তার পর আল্লাহ তাকে নব্যুওয়াতের মত মর্যাদাকর সার্টিফিকেট প্রদান করেন। তিনি মক্কা থেকে মদীনায় হিযরত করেছিলেন আল্লাহর হুকুমে তাবলীগ করার জন্যই। সুতরাং মেহনত ছাড়া এই পৃথিবীতে কোনো কিছুই সম্ভব নয়।
তাই আসুন, আমরা আমিত্ব ও স্বার্থের বন্ধন ছিন্ন করে ঈমানদার ও ভালো মানুষ হই। নিজে আমলে সালেহ (সৎ কাজে আদেশ, অসৎ কাজে নিষেধ) করি এবং কথা, কাজ, বক্তৃতা ও লিখনীর মাধ্যমে আল্লাহর দীনের সুস্পষ্ট চিত্র মানুষের সামনে তুলে ধরি। বাস্তব জীবনে এর উজ্জ্বল নমুনা পেশ করি। দাওয়াত ও তাবলীগের মাধ্যমে মানুষকে প্রেম ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে ‘আল্লাহর রজ্জু’কে মজবুত করে ধরতে শিখি। কেননা, আধুনিক যুগে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের দারুণ সঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্য, বিশ্বময় শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য দাওয়াত ও তাবলীগের কোনো বিকল্প নেই। মূলত সেই দ্বীনি মেহনতের মাধ্যমেই আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যায়।
লেখক : সাংবাদিক