যেখানে টাকা দিয়ে বউ কেনা যায়

প্রতীকী ছবি (সংগৃহীত)

যেখানে টাকা দিয়ে বউ কেনা যায়

নিউজ টোয়েন্টিফোর অনলাইন

ঘটা করে লোকজন দাওয়াত দিয়ে বিয়ে করা লাগে না! কনেকে আহামরি সাজানোও লাগে না। দরকার হয় না দেনমোহর জাতীয় কিছু। শুধু নগদ টাকা খরচ করলেই মিলে যায় মনের মতো রেডিমেড বউ! পরে ভালো না লাগলে চাইলেই বিদায় করে দেওয়া যায়! শুনতে অবাক লাগলেও এমনই রীতি প্রচলিত আছে নাইজেরিয়ায়। আর এই বউকে বলা হয় 'মানি ওয়াইফ' বা 'মানি ওম্যান'।

 

নাইজেরিয়ার সর্বদক্ষিণের ক্রস রিভার রাজ্যের বেশেরে সম্প্রদায়ে দারিদ্র্যপীড়িত পরিবারের শিশুদের অর্থের বিনিময়ে বিয়ের নামে বিক্রি করে দেওয়া হয়। আর তাদের কিনে নেন প্রভাবশালীরা। যাদের বিক্রি করা হয় তাদের বেশিরভাগের বয়স ৮ থেকে ১৩ বছর। ওই বয়সেই তাদেরকে বয়সে তিন-চার গুণ বড় পুরুষ মানুষের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করতে হয়।

সন্তান ধারণ করতে হয়। এতে অনেক শিশুর মৃত্যুও ঘটে।  এমনকি চার বছরের মেয়েকেও বিয়ে দেওয়া হয় ৭০ বছরের বৃদ্ধের সঙ্গে।

অল্প বয়সী মেয়েদের টাকার বিনিময়ে কেনা-বেঁচার মতো ভয়াবহ ঘটনা নাইজেরিয়ার বেশেরে সম্প্রদায়ের জন্য নিত্যদিনের ব্যাপার।

দেশটির আরও কয়েকটি সম্প্রদায়ের মধ্যে এখনও এ ধরণের বিতর্কিত প্রথার চল রয়েছে। যেখানে বিক্রি হওয়া মেয়েটির না থাকে কোন স্বাধীনতা, না থাকে শিক্ষা বা চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ। স্থানীয় ধর্মীয় নেতারা এই প্রথার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালালেও কোন লাভ হচ্ছে না।

সেই সম্প্রদায়েরই এক হতভাগী তরুণীর নাম ডরফি। বয়স এখন বিশের কোটায় হলেও ১০ কি ১১ বছর বয়সেই মানি ম্যারেজের বলি হয়ে তাকে কথিত স্বামীর বাড়িতে পা রাখতে হয়। যে তাকে কিনে নেয় তার বয়স ডরফির দাদা-নানার চেয়েও বেশি। ডরফির আপন মা ও চাচা টাকার জন্য তাকে ওই বৃদ্ধের কাছে বিক্রি করে দেয়। এরপর ডরফির জীবনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার।

এখনও সেই দিনগুলোর কথা মনে করে ভয়ে শিউরে ওঠেন ডরফি। তিনি জানান, "আমার লোকটি আমার সঙ্গে শুতে চাইলে আমি বলতাম, না, আমি এমনটা হতে দেব না, কারণ আপনি আমার বয়সের না। আপনার ছেলেমেয়েরাও আমার অনেক বড়। যখন আমি মানা করতাম, তখন সে আরও দুইজন লোক ডেকে আমার ওপর জবরদস্তি করতো। "

এভাবেই অমানুষিক নির্যাতনের এক পর্যায়ে অন্ত:সত্ত্বা হয়ে পড়েন ডরফি। অথচ সন্তান ধারণ করার মতো বয়সও তখন তার হয়নি।

মানি ওয়াইফ বা অর্থের বিনিময়ে বিক্রি হওয়া বউ হওয়ায় ডরফির যেন সাহায্য চাওয়ারও কোন জায়গা ছিল না।

বেশেরে সম্প্রদায়ে মূলত দুই ধরণের বিয়ে রয়েছে। একটি হল লাভ ম্যারেজ বা ভালবাসার বিয়ে এবং অপরটি এই মানি ম্যারেজ।

লাভ ম্যারেজে স্ত্রীর জন্য কোন পণ দিতে হয় না। নববধূ স্বাধীনভাবে বাবার বাড়ি আসতে যেতে পারে এবং তার ঘরে যে সন্তান জন্ম নেবে সেটা মায়ের পরিবারের উত্তরসূরি হিসেবে বিবেচিত হয়।

দুর্ভাগ্যবশত বেশেরের বেশিরভাগ গ্রাম প্রধানকেই মানি ওয়াইফ রাখতে দেখা যায়। কারণ এভাবে বিয়ে করলে স্ত্রীর ওপর পুরো কর্তৃত্ব বজায় রাখা যায়। দাসীর মতো তাকে খাটানো এবং যখন যেভাবে ইচ্ছা 'ব্যবহার' করা যায়। বয়সের পার্থক্য যাই হোক না কেন স্বামী চাইলে তাকে তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করতে হয়। ওই মেয়েরা তাদের স্বামীর পরিবারের সম্পত্তিতে পরিণত হয়। এমনকি মানি ওয়াইফকে হত্যা করলেও স্বামীর কোন বিচার হবে না বলেও কথা প্রচলিত আছে।

স্থানীয় মিশনারি ও শিশু অধিকার আন্দোলনকারী পস্তোর রিচার্ড বলেন, "একজন মানি ওম্যানের কোন সম্মান থাকে না। তাদের স্কুলে যাওয়ার অনুমতি নেই, তাদেরকে ঠিকঠাক খেতেও দেওয়া হয় না। সে সবার উচ্ছিষ্ট খায়। তারা শিশুশ্রম থেকে শুরু করে অমানবিক যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। অনেকে অন্ত:সত্ত্বা হলেও মায়ের বাড়ি যাওয়ার সুযোগ পায় না। "
 
এই সম্প্রদায়েরই আরেকজন সদস্য মনিকা। তিনি তার দুই নাতনিকে খুব ছোট থাকতেই মানি ম্যারেজের জন্য বিক্রি করে দিয়েছেন।

এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, পরিবারকে জুজু নামের অভিশাপ থেকে রক্ষা করতে মোটা অংকের অর্থ দরকার ছিল। আর এজন্যই তিনি নাতনিদের বিক্রি করে দিয়েছিলেন।

তবে এক বছর পর সেই সিদ্ধান্তের জন্য ভীষণ অপরাধবোধে ভুগছেন মনিকা।

তার নাতনি হ্যাপিনেসের বয়স এখন ১৫ বছর। গত বছর সে তার মানি ম্যারেজ থেকে পালিয়ে এসেছে।

হ্যাপিনেস জানান, "ওই লোকটার এতোই বয়স যে তার নাতি-নাতনির ঘরেও সন্তান রয়েছে। লোকটা প্রায়ই আমাকে মারত আর বলতো, আমাকে যদি সে পিটিয়ে মেরেও ফেলে তাকে কেউ কিছু বলতে পারবে না। কারণ আমি তার মানি ওয়াইফ। "

হ্যাপিনেস বলেন, "আমি আমার দাদিকে একটা মেসেজ পাঠিয়েছি। সেখানে আমি লিখেছি- যদি আমি মারা যাই এবং সে যদি আমার শেষকৃত্যে আসে, বাইকে করে। তাহলে একটা দুর্ঘটনায় তার হাত-পা ভেঙে যাবে। "

জানা গেছে, মানি ওয়াইফ রাখা সেখানে সামাজিক মর্যাদার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া স্ত্রীকে যেসব অধিকার দিতে হয় মানি ওয়াইফকে তা দিতে হয় না। তাই অনেকেই টাকা নিয়ে বউ কেনাতেই আগ্রহ দেখায়। এজন্য এই প্রথা বিলুপ্তির কোন আভাস দেখা যাচ্ছে না।

তবে এই সম্প্রদায়ের প্রধান চিভসামদে চিলে জানান, এখন আর মানি ওয়াইফ প্রথার কোন অস্তিত্ব এখানে নেই। এটা নব্বইয়ের দশকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যাদের বয়স ১৮ বছরের নীচে তাদের কাউকে মানি ওয়াইফ হিসেবে বিয়ে করা যায় না।

অবশ্য সম্প্রদায়ের প্রধানের বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবের কোন মিল নেই। কারণ, বেশেরের বেশিরভাগ গ্রাম প্রধানকেই মানি ওয়াইফ রাখতে দেখা যায়।

পাস্তোর রিচার্ড বলেন, "এই মানি ম্যারেজের ঘটনা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেও গ্রাম প্রধানরা বলবে, এই বিয়ে সবশেষ হয়েছিলো সেই ১৯৯৯ সালে। অথচ কয়েকদিন আগেই আমরা ১৭ বছর বয়সী একটি মেয়েকে উদ্ধার করেছি। "

যদিও ২০০৯ সালে নাইজেরিয়া থেকে মানি ম্যারেজ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়। তবে তা আইনেই সীমাবদ্ধ বলে মনে করেন সমাজকর্মীরা। সূত্র: বিবিসি

সম্পর্কিত খবর