স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে সারা ইসলামের নাম

চির ভাস্কর হয়ে থাকবে সারা ইসলামের নাম

স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে সারা ইসলামের নাম

অনলাইন প্রতিবেদক

২০ বছর বয়সী সারা ইসলাম। স্কুল শিক্ষিকা মাতা শবনম সুলতানা ও পিতা শহীদুল ইসলামের জ্যেষ্ঠ সন্তান তিনি। সারার একটি ছোট ভাইও আছে। দু:খের বিষয়, জন্মের ১০ মাস বয়সেই দুরারোগ্য টিউবেরাস স্ক্লেরোসিস রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন ছোট মেয়েটি।

মস্তিষ্ক, ফুসফুস, কিডনি, ত্বক-সহ শরীরে বিভিন্ন অঙ্গে টিউমারের বৃদ্ধিই টিউবেরাস স্ক্লেরোসিস একটি অস্বাভাবিক জেনেটিক বিরল রোগ। এখনও পর্যন্ত এই রোগের নিরাময় খুঁজে পাওয়া যায়নি। গবেষণা বলছে,  প্রতি লাখে ৭ থেকে ১২ জনের এই রোগ হতে পারে। এটি একটি  যা শরীরের অনেক অংশে টিউমার তৈরি করে।
 

আগেই বলে গিয়েছিলেন অঙ্গদানের কথা
এই জটিল রোগ নিয়েই সারার কেটে যায় ১৯ বছর। এই অবস্থায় ঢাকার অগ্রণী গার্লস স্কুল থেকে এসএসসি এবং হলিক্রস কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়। এরপর ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভে (ইউডা) ফাইন আর্টস বিভাগে ভর্তি হন। সারা ইসলাম সেখানে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। চিত্রশিল্পী হিসেবেও সে বেশ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে।

অনেক চিকিৎসার পরও ক্রমান্বয়ে শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে সারার। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি অপারেশন হয়। এক পর্যায়ে অবস্থার আরো অবনতি হলে তাকে আইসিইউতে নেয়া হয়। ব্রেন ডেথের দিকে যেতে থাকে। আইসিইউতে থাকা অবস্থায় সারা ইসলামের চিকিৎসার দায়িত্বে ছিলেন অধ্যাপক ডা. কামরুল হুদা। চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে সারার মাকে কাউন্সেলিং করা হয়-যদি পরিবার রাজী থাকে, তাহলে সারার দেহ থেকে কিডনি নিয়ে অন্য দুজন বিকল কিডনি রোগীর দেহে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব।

জীবিতাবস্থায় নিজের অঙ্গ দান করতে রাজী হয়ে পরিবারকে বলে গিয়েছিলেন সারা। হয়তো সে জানতো, সে আর বাঁচবে না। কিন্তু তার অঙ্গ নিয়ে অন্য কোন মানুষ বেঁচে থাকুক। ফলে বিষয়টি আরো সহজ হয়ে যায়। কাউন্সেলিংয়ের পর সারার মা শবনম সুলতানাও রাজী হয়ে যান। আইসিইউ’র সহকারী অধ্যাপক ডা. আশরাফুজ্জামান সজীব বিষয়টি ট্রান্সপ্ল্যান্ট মেডিক্যাল টিমকে অবহিত করেন। এরপর আদরের একমাত্র কন্যার দেহ থেকে কিডনি এবং একই সঙ্গে কর্ণিয়া দান করার সম্মতি পত্রে সাক্ষর করেন সারার মা শবনব সুলতানা।  

ব্রেন ডেথ কি?
মূলত আইসিইউতে থাকা জটিল রোগীর ‘ব্রেন ডেথ’ ঘোষণার পরই এই প্রক্রিয়ায় অঙ্গ বিযুক্ত করা হয়। উন্নত বিশ্বেও এটাই নিয়ম। ব্রেন ডেথ ঘোষিত ব্যক্তিদের হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুস ফ্লুইডের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে কিছুদিন চালু রাখা যায়; তবে তাদের বেঁচে যাবার সম্ভাবনা থাকে না। সারার ক্ষেত্রে এভাবেই কিডনি নেয়া হয়।

এলো সেই ঐতিহাসিক দিন 
বুধবার (১৮ জানুয়ারি) দিনটিকে বলা যায় ঐতিহাসিক।  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) প্রক্টর, ইউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. হাবিবুর রহমান দুলালের নেতৃত্বে ইউরোলজি, নেফ্রোলজি এবং এ্যানেসথেসিয়া, এনালজেসিয়া এবং ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিন বিভাগের সার্বিক সহযোগীতায় বাংলাদেশে প্রথম সফল ক্যাডাভারিক বা ব্রেন ডেথ রোগীর অঙ্গ প্রতিস্থাপন হয়। ২০ বছর বয়সী ব্রেন  ডেথ ঘোষিত সারা ইসলামের তার দেহ থেকে নেয়া দুটি কিডনির একটি প্রতিস্থাপিত হয় মিরপুরের বাসিন্দা কিডনি বিকল ৩৪ বছর বয়সী শামীমা আক্তারের দেহে।

বিএসএমএমইউর ট্রান্সপ্ল্যান্ট টিমে ছিলেন ইউরোলজি বিভাগের ডা. মো. সাইফুল হোসেন দিপু, সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফারুক হোসেন, সহযোগী অধ্যাপক ডা. কার্তিক চন্দ্র ঘোষ, এ্যানেসথেসিয়া এ্যানালজেসিয়া এন্ড ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. দেবাশিষ বনিক, অধ্যাপক ডা. দেবব্রত বনিক, সহযোগী অধ্যাপক ডা. দিলীপ ভৌমিক, সহকারী অধ্যাপক ডা. মো: আশরাফুজ্জামান সজিব, সহকারী অধ্যাপক ডা. মো: আব্দুল হান্নান, কনসালট্যান্ট ডা. মোমিনুল হক, সিনিয়র রেসিডেন্টবৃন্দ, মেডিক্যাল অফিসারবৃন্দ। এসময় নেফ্রোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম এবং সহকারী অধ্যাপক ডা. মানিক মন্ডল উপস্থিত ছিলেন। জটিল এই অপারেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় ভোর সাড়ে চারটার দিকে। পুরো বিষয়টির তদারক করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেল অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ।

সারার দেহ থেকে নেয়া অন্যটি কিডনিটি মিরপুরস্থ কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল এন্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটে অন্য এক নারীর দেহে প্রতিস্থাপন করা হয়। সেই প্রতিস্থাপন দলের প্রধান ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. একেএম খুরশিদ আলম। সেখানে পুরো বিষয়টির সমন্বয় করেন কিডনি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুন আর রশিদ।

এ ছবি এখন কেবলই স্মৃতি! মাতা শবনম সুলতানার সঙ্গে সারা ইসলাম (দাড়ানো)

সারার চোখে অন্ধজনে দেখছে আলো 
সর্বশেষ জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সারা ইসলামের চোখ থেকে বিযুক্ত করা হয় দুটি কর্ণিয়া। বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের চক্ষু বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রাজশ্রী দাশ ২৩/২৫ বয়সী সুজন নামক এক যুবকের চোখে একটি কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করেন। অপর কর্নিয়াটি কমিউনিটি অপথালমোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শীষ রহমান ৫৬ বছর বয়সী ফেরদৌস আক্তার নামের এক নারীর চোখে প্রতিস্থাপন করেন।

বাংলাদেশে কিডনি সংযোজনের ইতিহাস 
বিংশ শতাব্দীর বিস্ময়কর চিকিৎসাপদ্ধতি মানবদেহে অঙ্গ সংযোজন। এর মাধ্যমে লাখ লাখ মরণাপন্ন মানুষের জীবন দীর্ঘায়িত করা ছাড়াও জীবনযাত্রার মান উন্নত করা সম্ভব হয়েছে। ১৯৫৪ সালে সর্বপ্রথম এক যমজ মানবসন্তানের কিডনি অপরজনের শরীরে সফল সংযোজনের মাধ্যমে পৃথিবীতে শুরু হয় কিডনি সংযোজনের পদযাত্রা। কিডনি সংযোজন সাধারণত দু’ভাবে করা যায়: মৃত ব্যক্তির কিডনি নিয়ে সংযোজন এবং নিকটাত্মীয়ের যে কোনো একটি কিডনি নিয়ে সংযোজন।  

বাংলাদেশে প্রথম কিডনি সংযোজন হয় ১৯৮২ সালের অক্টোবরে। ওই রোগী বেঁচেছিল ছয় সপ্তাহ। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ছয়জন কিডনি অকেজো রোগীর দেহে অঙ্গ সংযোজন করা হয়, যারা ছয় মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত বেঁচেছিল। তবে ১৯৮৮ সাল থেকে দেশে ধারাবাহিকভাবে অঙ্গ সংযোজন হচ্ছে। বাংলাদেশের কয়েকটি হাসপাতালে এ পর্যন্ত প্রায় কয়েক হাজার কিডনি অকেজো রোগীর দেহে সাফল্যজনকভাবে কিডনি সংযোজন করো হয়েছে। কিন্তু এর সবগুলোই হয়েছে জীবিত নিকটাত্মীয়ের কাছ থেকে কিডনি নিয়ে সংযোজন। এখন বিএসএমএমইউ, সিকেডি হাসপাতাল, কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল, নিকডু, এভারকেয়ারসহ সাত থেকে আটটি হাসপাতালে কিডনি প্রতিস্থাপন হচ্ছে।  

ক্যাডাভারিক অর্গান ট্রান্সপ্ল্যান্ট 
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, জীবিত আত্মীয়ের কিডনি সংযোজিত ব্যক্তিদের এবং ক্যাডাভারিক (মরণোত্তর) অরগান সংযোজক ব্যক্তিদের এক বছর বেঁচে থাকার হার যথাক্রমে ৯৫ এবং ৮৮ ভাগ। কিন্তু পাঁচ বছর বেঁচে থাকার হার প্রায় ৮৭ ভাগ। উন্নত বিশ্বে ক্যাডাভারিক প্রক্রিয়ায় অর্গান ট্রান্সপ্ল্যান্ট হয় বেশি। মরণোত্তর অঙ্গ সংযোজনের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি একসঙ্গে পাঁচজন মানুষকে বাঁচাতে পারে। এ ব্যবস্থায় দুটি কিডনি দুজনের দেহে, লিভারের কিছু অংশ একজনের দেহে, ফুসফুস ও হার্ট প্রতিস্থাপন করে ভিন্ন ভিন্ন পাঁচজন অঙ্গ বিকল রোগীকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব। দৃষ্টিহীণ দুজন মানুষও দৃষ্টি ফিরে পেতে পারে।

চির ভাস্কর হয়ে থাকবে সারার নাম
বৃহস্পতিবার সকাল ৮টায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে সারা ইসলামের নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। এখন সে কবরে।  সারার বাকী দেহ আস্তে আস্তে মাটির সঙ্গে মিশে যাবে হয়তো। একজন সারা ইসলাম তার অঙ্গ দান করে যে সাড়া ফেলে গেছেন, দেশে প্রথমবারের মতো মরনোত্তর ট্রান্সপ্ল্যান্ট প্রক্রিয়ায় প্রথম অঙ্গদাতা এই সারা ইসলামের নাম বাংলাদেশের চিকিৎসাক্ষেত্রে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তার মহৎ আত্মত্যাগের এই মহিমা  চিকিৎসা বিজ্ঞানে চির ভাস্মর হয়ে থাকবে।  

এখন মহতী সারার পথ ধরে আরো মানুষ যদি এই প্রক্রিয়ায় অঙ্গদানে উদ্বুদ্ধ হয়, তাহলে জীবিত মানুষের দেহ থেকে অঙ্গ নিয়ে অঙ্গ বিকল কোন মানুষের দেহে প্রতিস্থাপনের হার কমে আসবে। কেননা, পৃথিবীর উন্নত রাষ্ট্রে মরনোত্তর প্রক্রিয়ায় অঙ্গদানের মাধ্যমেই কিডনি, লিভার, হার্ট, ফুসফুস, কর্নিয়া ইত্যাদি ট্রান্সপ্ল্যান্ট হয়।

আতাউর রহমান কাবুল, স্বাস্থ্যবিষয়ক সাংবাদিক, ডেপুটি ইনচার্জ, নিউজ টোয়েন্টিফোর টেলিভিশন অনলাইন।