এবিজি বসুন্ধরার পৃষ্ঠপোষকতায় নারী ফুটবল দলের নতুন অধ্যায়

ইকরামউজ্জমান

এবিজি বসুন্ধরার পৃষ্ঠপোষকতায় নারী ফুটবল দলের নতুন অধ্যায়

ইকরামউজ্জমান

স্বাধীনতার আগের দিনগুলোতে কখনো ভাবতে পারিনি বাঙালি মেয়েরা মাঠে ছেলেদের পাশাপাশি ফুটবল খেলবেন। শুধু তা-ই নয়, তাঁরা শুধু খেলবেন না—তাঁরা দেশকে প্রতিনিধিত্ব করবেন আন্তর্জাতিক ফুটবল চত্বরে এবং সেখান থেকে অসাধারণ নৈপুণ্যের মাধ্যমে জাতির জন্য সম্মান বহন করে আনবেন। দেশের পতাকা ওপরে তুলে ধরতে সক্ষম হবেন। বাংলাদেশ অর্জিত হয়েছে বলেই মেয়েরা তাঁদের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পেয়েছেন—শুধু ফুটবল খেলা নয়, অন্যান্য খেলায়ও মেয়েরা এগিয়ে চলেছেন।

ক্রীড়াঙ্গনের দিকে যখন তাকাই লক্ষ করি, নতুন প্রজন্মের মেয়ে ও ছেলেরা কী প্রচণ্ড আগ্রহ ও উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে আসছেন। তাঁরাই আমাদের ভরসা। বিশ্বাস করি, ক্রীড়াঙ্গনে তাঁরা বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা রুখতে দেবেন না। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বড় ক্রীড়াঙ্গনে এই মেয়েরা যথাযথ সহযোগিতা এবং প্রটেকশন পাচ্ছেন না।

এটা যখন বাস্তবতা, ঠিক এ সময়েই এগিয়ে এসেছে বসুন্ধরা গ্রুপ। গত বৃহস্পতিবার বাফুফে ও এবিজি বসুন্ধরার মধ্যে নারী ফুটবলের জন্য স্পন্সরশিপ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের নারী ফুটবলে আগামী তিন বছর পৃষ্ঠপোষণা দেবে এবিজি বসুন্ধরা। এবিজি বসুন্ধরার পক্ষে বসুন্ধরা গ্রুপ ও এবিজি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীর ও বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের পক্ষে নারী ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরণ চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন। বসুন্ধরা গ্রুপের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং বসুন্ধরা কিংসের সভাপতি ইমরুল হাসান চুক্তির বিষয়ে বলেছেন, ‘নারী লিগ, মেয়েদের আন্তর্জাতিক ম্যাচসহ বাফুফের ক্যাম্পে যারা থাকে তাদের সব খরচ বহন করব। আমরা প্রচারের জন্য স্পন্সরশিপ দিচ্ছি না। ’ তিনি আরো বলেছেন, ‘আমরা দেশের ফুটবলের উন্নয়নের জন্য এই স্পন্সরশিপ দিচ্ছি। ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের সাফল্য বেশি। তাই এই মেয়েদের সহযোগিতা করা যায়, তবে আমার মনে হয় তারা আরো সফলতা এনে দিতে পারবে। ’ শুধু নারী ফুটবল নয়, এই মুহূর্তে বসুন্ধরা গ্রুপ পৃষ্ঠপোষকতা করছে বাফুফে আয়োজিত প্রতিটি প্রতিযোগিতায়।

দেশের ক্রীড়াঙ্গনের ইতিবাচক দিক হলো, তারুণ্যে-যৌবনে শ্রেণি চরিত্র ও শ্রেণি স্বার্থকে অতিক্রম করেছে। সমাজের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত সবাই ক্রীড়াঙ্গনে আসছেন। ক্রীড়াঙ্গনে ভূমিকা রাখছেন, কিছু করতে চাচ্ছেন—এই ইচ্ছাটাই ক্রীড়াঙ্গনকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। ক্রীড়াঙ্গন পাবে নতুন স্বপ্নের রং।

বাংলাদেশে বাঙালি নারীদের মাঠে ফুটবল খেলার চর্চার বয়স তিন যুগেরও কম। অন্যদিকে পাশের দেশ ভারতে এই ফুটবলচর্চার বয়স আট যুগেরও বেশি। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি মেয়েরা বাংলাদেশের মেয়েদের মতো ১১ জন বাঙালি খেলোয়াড়ের দল হয়ে কখনো প্রতিনিধিত্ব করেছেন—এমন তথ্য ফুটবল নিয়ে কাজ করতে গিয়ে খুঁজে পাইনি। এদিক থেকে বাংলাদেশের মেয়েরা ভাগ্যবতী, তাঁরা একটি জাতিকে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পাচ্ছেন। তাঁরা মাঠে জাতি চরিত্রের প্রতিফলন ঘটাতে সক্ষম হচ্ছেন। মানুষ নারী দলের লড়াইয়ে দেশকে খুঁজে পাচ্ছে।

বাংলাদেশের সিনিয়র নারী দল সাউথ এশিয়ান ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে গত বছর। এটি নারী ফুটবলের ইতিহাসে ‘মাইলফলক’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। নারী দলের এই বিজয় শুধু একটি আন্তর্জাতিক চ্যাম্পিয়নশিপে বিজয়ের স্বাদ পাওয়া নয়, এই বিজয় নিশ্চিত করেছে আগামী দিনের জন্য আত্মবিশ্বাস, সাহস, অনুপ্রেরণা এবং নির্দিষ্ট বার্তা।

নারী ফুটবলে মৌলিক পরিবর্তন বড্ড প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। পরিমাণগত কাজ হয়েছে কমবেশি গত কয়েক বছরে, কিন্তু গুণগত কাজে একটা ঘাটতি রয়েছে। নারীদের ফুটবল নিয়ে সব চিন্তা-ভাবনা ফুটবল ফেডারেশনের। এ ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু কেন? দেশে দেশে তো ক্লাবগুলো ফুটবলকে লালন-পালন করে। প্রিমিয়ার ফুটবল যারা খেলে, তাদের জন্য তো পুরুষ দলের পাশাপাশি নারী দল রাখা বাধ্যতামূলক। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার ফুটবল খেলে অথচ নারী দল রেখে তাদের ফুটবলকে পৃষ্ঠপোষকতা করার ক্ষেত্রে ক্লাবগুলোর উৎসাহ নেই বললেই চলে। তারা নারী দল গঠন করাকে বাড়তি বোঝা মনে করে। ব্যতিক্রম শুধু প্রিমিয়ার ফুটবলে গত তিন বছরের চ্যাম্পিয়ন ক্লাব বসুন্ধরা কিংস। এরা গত তিন বছর শুধু লীগে খেলার জন্য নারী দল গঠন করেনি, নারী খেলোয়াড়দের ক্যাম্পে রেখে পূর্ণাঙ্গ প্রশিক্ষক টিমের অধীনে নিয়মিতভাবে প্রশিক্ষণ করিয়ে প্রত্যক্ষভাবে দেশের নারী ফুটবলের অগ্রযাত্রায় অবদান রেখেছে। বাস্তবতায় নারী ফুটবলারদের যেটি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, আর্থিক সাপোর্ট। বসুন্ধরা গ্রুপের ক্লাব বসন্ধুরা কিংস সেটি দিচ্ছে নিয়মিতভাবে। আর এই সাপোর্ট বড় বেশি প্রয়োজন বেশির ভাগ নারী খেলোয়াড়ের পরিবারের জন্য।

প্রিমিয়ার লীগের আরো কয়েকটি বড় ক্লাব যদি দায়বদ্ধতা থেকে নারী দল গঠন করে নিয়মিত লীগে অংশ নিত, তাদের নিয়ে কাজ করত—এতে উপকৃত হতো নারী ফুটবলের ক্রীড়াঙ্গন। উপকৃত হতেন নারী ফুটবলাররা। তাঁদের সুযোগ বৃদ্ধি পেত। নারীরা ফুটবলকে ঘিরে আরো অনেক বেশি উৎসাহ ও উদ্দীপনা দেখতেন। ফুটবল খেলার সুবাদে আর্থিকভাবে উপকৃত হতেন অনেক বেশি খেলোয়াড়।

আমরা সবাই লক্ষ করছি, বয়সভিত্তিক ফুটবলে সাফল্যের দিক থেকে নারীরা এরই মধ্যে পুরুষদের পেছনে ফেলে দিয়েছেন। নারীরা যদি নিয়মিতভাবে বিভিন্ন বড় ক্লাবের অধীনে লীগ এবং অন্যান্য টুর্নামেন্টে খেলার সুযোগ পেতেন—এতে তাঁদের সামর্থ্য ও সম্ভাবনা কাজে লাগানো সম্ভব হতো আরো বেশি কার্যকরভাবে। দেশে যদি নারীবান্ধব ফুটবল চত্বর সর্বমহলের সহযোগিতায় সৃষ্টি করা সম্ভব হয়, তাহলে আগামী পাঁচ বছরে পরিবর্তন দেখতে পাব। আর ১০ বছর পর একটি বড় পরিবর্তন দেখব। ক্রীড়াঙ্গন তো সব সময় পরিবর্তনের সপক্ষে।

দেশের সর্ববৃহৎ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বসুন্ধরা গ্রুপ তাদের সামাজিক কার্যক্রমে প্রথম থেকেই পুরুষ-নারী সমতায় বিশ্বাসী। বসুন্ধরা গ্রুপের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত ক্লাব বসুন্ধরা কিংসে পুরুষ ও নারী দলকে ঘিরে বৈষম্য এবং ভেদাভেদ নেই। দুটি দল একজন প্রেসিডেন্টের অধীনে শৃঙ্খলার সঙ্গে পরিচালিত হয়। ক্লাব প্রেসিডেন্ট মো. ইমরুল হাসান ন্যায়ভিত্তিক ক্রীড়াঙ্গনের বিষয়ে সদা সচেতন। সচেতন সম-অধিকারে।

কিছুদিন আগে সমতার ক্রীড়াঙ্গন নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ইমরুল হাসান বলেছেন, ‘বসুন্ধরা গ্রুপের ক্লাব বসুন্ধরা কিংস তো শুধু একটি ক্লাব হিসেবে পরিচিত হতে চায় না। ক্লাব চায় দেশের পুরুষ ও নারী ফুটবল তথা দেশের সার্বিক ফুটবলে কার্যকর ইতিবাচক অবদান রাখতে। আর এ লক্ষ্য নিয়েই ক্লাব কাজ করছে। ’

বসুন্ধরা কিংসের আধুনিক স্টেডিয়াম তৈরি তো শুধু ক্লাবের জন্য নয়, দেশের ফুটবলের বৃহত্তর স্বার্থে। স্টেডিয়ামের পাশেই কমপ্লেক্সের মধ্যে মেয়েদের জন্য পৃথক মাঠ নির্মাণের কাজ চলছে। আশা করা যাচ্ছে, দুই মাসের মধ্যে মাঠের কাজ শেষ হয়ে যাবে। পুরুষ ও নারী ফুটবলারদের জন্য পৃথক ফুটবল একাডেমি আবাসিক সুযোগসহ একাডেমি বিল্ডিং নির্মাণের কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পৃথকভাবে এর ‘কার্যক্রম’ শুরু হবে। আশা করি একটি সময়ে বসুন্ধরা কিংস তার একাডেমিতে তৈরি খেলোয়াড়দের থেকেই স্থানীয় খেলোয়াড়দের চাহিদা পূরণ করতে পারবে। এ ছাড়া কিংস একাডেমির তৈরি খেলোয়াড় অন্য ক্লাবে বিক্রি করা যাবে। এসব কার্যক্রমের পেছনে কিন্তু দেশের ফুটবল। দেশের ফুটবলের মানোন্নয়ন এবং অগ্রগতি। বসুন্ধরা গ্রুপের কর্ণধাররা ক্লাবের মাধ্যমে দেশের ফুটবল নিয়ে যে স্বপ্ন দেখছেন, তাঁরা বিশ্বাস করেন সেই স্বপ্ন বাস্তবে বাস্তবায়িত হওয়া সম্ভব। গ্রুপ চায় ক্লাব চলুক শতভাগ পেশাদারি মনোভাব, সুশাসন এবং জবাবদিহির মধ্য দিয়ে।

পুরুষ দলের মতো বসুন্ধরা নারী দলও নারী লীগে পর পর তিনবার চ্যাম্পিয়ন হয়ে হ্যাটট্রিক করার গৌরব অর্জন করেছে। পুরুষ ও নারী উভয় দলের জার্সিতে এখন তিনটি করে ‘তারা’ স্থান পেয়েছে। বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে এখন পর্যন্ত কোনো করপোরেট প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা ফুটবল ক্লাব এ ধরনের বিরল সাফল্যের অধিকারী হতে পারেনি। নারী দলের সাফল্য তো আরো বৈচিত্র্যময়। উপমহাদেশে কোনো নারী ক্লাব দল তার দেশের লীগে পর পর তিনবার চ্যাম্পিয়ন হয়ে হ্যাটট্রিকের গৌরব অর্জন করেছে কোনো পয়েন্ট না হারিয়ে—বসুন্ধরা নারী ফুটবল দলের এই কৃতিত্বের আর কোনো নজির নেই। কিংস নারী দল নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করেছে উপমহাদেশের ফুটবলে। নারী দলের এই কৃতিত্বে বসুন্ধরা কিংসের ‘ব্র্যান্ড ইমেজ’ বৃদ্ধির পাশাপাশি ব্র্যান্ডের গ্রহণযোগ্যতা এবং জনপ্রিয়তা আরেক ধাপ বেড়ে গেল। নারী ফুটবল দলের সঙ্গে এবিজি বসুন্ধরার স্পন্সরশিপ চুক্তি দেশের নারী ফুটবলের উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।

লেখক : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক, সাবেক সহসভাপতি এআইপিএস এশিয়া