উষ্ণতার ছোঁয়া পেল উত্তরের ১৩ হাজার মানুষ

সংগৃহীত ছবি

উষ্ণতার ছোঁয়া পেল উত্তরের ১৩ হাজার মানুষ

অনলাইন ডেস্ক

জানুয়ারিতে উত্তরে বেড়েছে শীতের তীব্রতা। সন্ধ্যা হলেই টুপটুপ করে শিশির পড়ে। প্রচণ্ড শীতে দরিদ্র মানুষের দুর্দশা চোখে পড়ার মতো। দৈনিক কালের কণ্ঠ শুভসংঘের একটি দল প্রতিবারের মতো এবারও ছুটে গেল উত্তরের জেলাগুলোতে।

বসুন্ধরা গ্রুপের দেওয়া কম্বলের উষ্ণতার ছোঁয়ায় শিশু ও প্রবীণের মুখে দেখা দিল হাসির রেখা।

দিনাজপুরের বোচাগঞ্জে শীতার্তদের হাতে শুভসংঘের বন্ধুরা তুলে দিলেন বসুন্ধরা গ্রুপের কম্বল। এর মধ্যে একজন আয়েশা বেগম, বয়স ৮০ পেরিয়েছে। একাত্তরের এই বীরাঙ্গনা।

একাত্তরে হারিয়েছেন সব, পরিবার থেকে হয়েছেন নিগৃহীত। কপালের ভাগ্যরেখা একাত্তরেই মুছে গিয়েছিল তাঁর। ভাগ্যদেবী  যেন  জীবনসায়াহ্নেও বিমুখ এই অসহায় মানুষটির ওপর। কনকনে এই শীতে গায়ে জড়ানোর মতো একটা কম্বলটুকুও নেই। তাঁর মতো নির্মম ভাগ্যহীন কপাল চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার আরো ১৪ বীরাঙ্গনার। সম্প্রতি এসব দরিদ্র মানুষকে একটু উষ্ণতার ছোঁয়া দিতে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বসুন্ধরা গ্রুপ। কালের কণ্ঠ শুভসংঘের সহায়তায় উত্তরবঙ্গে চলছে কম্বল বিতরণ।

গল্পের শুরুটা হয় জানুয়ারির ১৬ তারিখে। শুভসংঘের পরিচালক জাকারিয়া জামানের নেতৃত্বে কম্বল নিয়ে শুভসংঘ দল ঢাকা থেকে দিনাজপুরের উদ্দেশে রওনা হয়। সঙ্গে ছিলেন জীবন, রাফি, আবিরসহ আরো কয়েকজন। সাড়ে ৩০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সন্ধ্যায় শুভসংঘ দল দিনাজপুরে পৌঁছে। পথে বগুড়া, গোবিন্দগঞ্জ ও দিনাজপুরের শুভসংঘের বন্ধুদের সঙ্গে সাক্ষাৎ। দিনাজপুরে পৌঁছেই পরের দিন শুরু হয়ে যায় কম্বল বিতরণের পরিকল্পনা। সঙ্গে ছিলেন দিনাজপুর শুভসংঘের বন্ধুরা। পরদিন সকাল ৬টায় শুরু। কুয়াশায় দুই হাত দূরের কিছুও তখন দেখা যায় না। ৭টায় প্রথম কম্বল বিতরণ কার্যক্রম শুরু হলো। বসুন্ধরা গ্রুপের সহায়তায় দিনাজপুর জেলার ছয়টি উপজেলার সাতটি স্থানে এক হাজার ৫০০ শীতার্ত মানুষের হাতে কম্বল তুলে দিল শুভসংঘ। কম্বল হাতে পেয়ে অসহায় শীতার্ত মানুষগুলোর মলিন মুখে যেন হাসি ফিরে আসে।

মানুষগুলোর যে এই তীব্র শীতে গায়ে জড়ানোর কম্বলটুকু ছিল না, তেমনই একজন দিনাজপুর শহরের সুইহারী এলাকার শাহজাহান। কম্বল পেয়ে তাঁর মুখে ফুটে ওঠে আনন্দের আভা। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমি তো চোখে ভালো দেখতে পাই না। তাই অন্যদের মতো কাজ করতে সমস্যা হয়। কিন্তু মানুষের কাছে হাত পাততেও খারাপ লাগে। তাই ভিক্ষা না করে এখানে চেহেলগাজী স্কুল আছে, সেখানে আয়না-চিরুনি বিক্রি করি। সেখান থেকে যা আয় করি, তা দিয়ে সংসার চালানো কষ্ট হয়ে যায়। এর মধ্যে শীতের কাপড় কেনা কষ্টকর। আজকে বসুন্ধরা গ্রুপের কম্বল পাইলাম। এটা দিয়ে শীতটা কাটাতে পারব। আমার মতো আরো অনেক গরিব মানুষ কম্বল পাইছে। বসুন্ধরা গ্রুপ আমাদের কম্বল দিল, আল্লাহ তাদের ভালো করুক। ’ বিরল উপজেলার একটি এতিমখানায় কম্বল বিতরণের মধ্য দিয়ে শেষ হয় প্রথম দিনের কম্বল বিতরণ। রাত ১০টায় কম্বল বিতরণ শেষ করে শুভসংঘ দল হোটেলে পৌঁছে। হোটেলে ফিরেই পরদিনের পরিকল্পনা সেরে নেন শুভার্থীরা।

দ্বিতীয় দিন দিনাজপুরের বেশ কয়েকটি উপজেলায় কম্বল বিতরণ করা হয়। জেলার চিরিরবন্দর, পার্বতীপুর, ফুলবাড়ী, নবাবগঞ্জ ও হাকিমপুরের বিভিন্ন জায়গায় দেড় হাজার কম্বল বিতরণ করা হয়।  দিনাজপুরে শুভসংঘের পরিচালক জাকারিয়া জামানের নেতৃত্বে পুরো আয়োজনটিতে সহযোগিতা করেন শুভসংঘের বন্ধুরা।

দুই দিনে দিনাজপুরের তিন হাজার মানুষের হাতে বসুন্ধরা গ্রুপের পক্ষ থেকে কম্বল তুলে দিয়ে শুভার্থীরা এবার রওনা হন  জয়পুরহাটের দিকে। পরের দিন শুরু হয় জয়পুরহাটে কম্বল বিতরণ। জয়পুরহাট সদর, পাঁচবিবি, কালাই, ক্ষেতলাল ও আক্কেলপুর উপজেলায় পৃথক আয়োজনে এক হাজার কম্বল বিতরণ করা হয়। কম্বল হাতে পেয়ে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট সবার জন্য প্রাণভরে দোয়া করেছেন সবাই। জয়পুরহাট কালেক্টরেট মাঠে সকাল ১০টায় কম্বল নিতে আসেন ৪০০ দরিদ্র মানুষ। সেখানে ছেলের সঙ্গে রিকশায় চড়ে কম্বল নিতে এসেছিলেন শতবর্ষী বৃদ্ধা মোহিনী বালা। কম্বল পেয়ে তাঁর অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘এমন শীত কোনো দিন অনুভব করিনি। বৃদ্ধ মানুষের শীত তো আরো বেশি। শীতে করুণ অবস্থা হলেও কেউ সাহায্য করেনি। বসুন্ধরা গ্রুপের দেওয়া কম্বল পেয়ে হামার খুবই উপকার হলো। শীতে ঘুম আসে না। কম্বলের উশুমে এখন থেকে ভালো করে ঘুম পারা পারমো। ভগবান তোমাগেরে মঙ্গল করবে।

কালেক্টরেট মাঠে কম্বল বিতরণ অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন জয়পুরহাটের জেলা প্রশাসক সালেহীন তানভীর গাজী। তিনি বলেন, ‘বসুন্ধরার মতো দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী গ্রুপ জয়পুরহাটের হতদরিদ্র শীতার্ত মানুষদের জন্য শীত নিবারণে এক হাজার কম্বল উপহার দেওয়ায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। সেই সঙ্গে তাদের ব্যাবসায়িক সফলতা কামনা করছি। আশা করছি, আগামী দিনেও মানুষের কল্যাণে তারা এমন উদ্যোগ অব্যাহত রাখবে। এটি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। ’

এরপর নওগাঁয় বসুন্ধরা গ্রুপের সহায়তায় দীঘা, বক্তারপুর ও বরুনকান্দি হাফেজিয়া কওমি মাদরাসার কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মাঝে কম্বল বিতরণ করা হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন নওগাঁ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি ও এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক মোহাম্মদ ইকবাল শাহরিয়ার রাসেল।

নওগাঁয় কম্বল বিতরণ শেষ করে শুভসংঘ দল রওনা হয় রাজশাহীর পথে। মাঝখানে পত্নীতলা উপজেলার মেধাবী শিক্ষার্থী মাছুমা আক্তারকে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তির সহায়তা তুলে দেওয়া হয়। এরপর নির্ধারিত সময়ে রাজশাহীতে শুরু হয় কম্বল বিতরণ। পদ্মা নদীর একেবারে পার ঘেঁষে গড়ে ওঠা গোদাগাড়ীর পিরিজপুর গ্রামের একটি আমবাগানে পাঁচ শতাধিক নারী-পুরুষের জটলা। সবাই এসেছেন  কম্বল নিতে। এরই মধ্যে পদ্মার দিক থেকে হু হু করে বাতাস বয়ে যাওয়ায় শীতে যেন কাঁপছেন বৃদ্ধ কয়েকজন নারী-পুরুষ। পদ্মার হু হু বাতাস আর তীব্র ঠাণ্ডায় কাবু হওয়া ওই বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা কম্বল হাতে পেয়েই জড়িয়ে নিলেন নিজের শরীরে।

তাঁদেরই একজন হলেন আছিয়া বেওয়া। তিনি কম্বল পেয়ে অনেকটা আবেগাপ্লুত হয়ে বলতে থাকেন, ‘এমন জাড় (শীত) ল্যাগছে, পাওগুলানো ঠিকমুতন মাটিতে র‌্যাখতে প্যারছি না। এই জাড়ে কম্বলডা এখুন খুব আরাম দিবে। রাতেও আরামে ঘুমাতে পারবো। আল্লাহ বসুন্ধরার ভালো করুক। আমার মুতন অসহায় মানুষকে মুনে করিছে, আল্লাহ তিনাদের ভালো করুক। ’ শুধু আছিয়া বেওয়াই নন, তাঁর মতো গোদাগাড়ীর এমন ৬০০ অসহায় শীতার্ত নারী-পুরুষের হাতে তুলে দেওয়া হয় কম্বল। আর কম্বল পেয়ে সবাই খুশি মনে বাড়ি ফিরেছেন। রাজশাহীতে মোট এক হাজার অসহায় মানুষের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে কম্বল। রাজশাহীর কম্বল বিতরণ শেষ করে পরের গন্তব্য চাঁপাইনবাবগঞ্জ। সেখানে ১৫ বীরাঙ্গনাসহ মোট এক হাজার মানুষের মাঝে কম্বল বিতরণ করা হয়।

এখানেই শেষ নয়। শুভসংঘ অনুভব করছে উত্তরের শীত। কেননা এই জানুয়ারিতেও উত্তরে শীত যেন বাড়ছেই, যার ফলে উত্তরে আরো কম্বল দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। শুভসংঘ দল ফের রওনা হয় ৩০০ কিলোমিটার দূরে পঞ্চগড়ের পথে। প্রথমে পঞ্চগড় বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম স্টেডিয়ামে শীতবস্ত্র বিতরণের কার্যক্রম শুরু হয়। পরে তেঁতুলিয়া উপজেলার ডিমাগছ ও তিরনইহাট এলাকা, আটোয়ারী উপজেলার বিএম কলেজ, বোদা উপজেলার একুশ স্মৃতি পাঠাগার চত্বর, দেবীগঞ্জের ধনমণ্ডল ও পঞ্চগড় সদরের চাকলাহাটসহ বিভিন্ন এলাকায় কম্বল বিতরণ করেন শুভসংঘের সদস্যরা। পুরো জেলায় এক হাজার কম্বল বিতরণ করা হয়। সেখানে কম্বল বিতরণ শেষ করে শুভসংঘের এবারের গন্তব্য নীলফামারী। নীলফামারীতে এক হাজার মানুষের মাঝে কম্বল বিতরণ শেষ করে শুভার্থীরা ঠাকুরগাঁওয়ে এক হাজার কম্বল বিতরণ করেন। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জে এক হাজার মানুষের মাঝে কম্বল বিতরণ করা হয়।

শুভসংঘের পরিচালক জাকারিয়া জামান বলেন, ‘বসুন্ধরা গ্রুপের মাননীয় চেয়ারম্যানের নির্দেশে আমরা উত্তরবঙ্গের ৯ জেলাসহ এবং ঢাকার নারায়ণগঞ্জ মিলে মোট ১৩ হাজার কম্বল বিতরণ করেছি শুভসংঘের মাধ্যমে। এতিম শিশু, বৃদ্ধ, প্রতিবন্ধী, বীরাঙ্গনাসহ সব মানুষের কাছে আমরা বসুন্ধরা গ্রুপের এই উপহার পৌঁছে দিয়েছি শুভসংঘের মাধ্যমে। সবাই আমাদের চেয়ারম্যান মহোদয়ের জন্য দোয়া করেছেন। আমরা বসুন্ধরা গ্রুপের সহায়তায় আমাদের এই ভালো কাজের ধারা ভবিষ্যতেও অক্ষুণ্ন রাখব। ’