ভোক্তাবান্ধব ভোক্তাঋণ : প্রত্যাশা ও প্রস্তাবনা

ফাইল ছবি

ভোক্তাবান্ধব ভোক্তাঋণ : প্রত্যাশা ও প্রস্তাবনা

অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে এবং ভোক্তাঋণের সর্বোচ্চ সুদের হারের নীতি শিথিল করেছে।  আমানতের ক্ষেত্রেও ন্যূনতম প্রদেয় ৬ শতাংশ সুদের হার প্রত্যাহার করেছে। ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ২০২০ সাল থেকে চলমান ৯ থেকে ১২ শতাংশ পর্যন্ত সুদের হার বাড়াতে পারবে। দেশের ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি  মোকাবেলায় যতগুলো বিকল্প পথ আছে এর মধ্যে এটিই সবচেয়ে সহজে নেয়া সম্ভব হচ্ছে।

 

ভোক্তা ঋণের ওপর সুদ বাড়ানোর প্রভাব     
করোনাকালীন দুর্যোগ এবং এর পরপরই রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিতে যে ধাক্কা দিয়েছে তা সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনকে নাড়িয়ে দিয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য থেকে শুরু করে  জ্বালানি তেল, ভোজ্যতেল, শিশুখাদ্য, নির্মাণসামগ্রী, শিক্ষা খরচ, চিকিৎসা ব্যয়, বিদ্যুৎ বিল/গ্যাস বিল সবই বেড়েছে বহু গুণে। কিন্তু এর মধ্যে অনেকের চাকরি গেছে বা বেতন ভাতা কমেছে, বাড়ির মালিক বাড়ি ভাড়া বাড়াতে পারছেন না। কারণ ভাড়াটিয়ারা বর্তমান ভাড়াই ঠিকমতো দিতে পারছেন না অথবা অনেকে গ্রামে চলে গেছেন।

বাড়ির মালিক যিনি হোম লোন নিয়ে বাড়ি নির্মাণ করেছিলেন, তিনি ঠিকমতো কিস্তি দিতে পারছেন না। ভোক্তাঋণ স্বল্প টাকার হয়ে থাকে। সাধারণত মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তরা এই ধরণের লোন নিয়ে থাকেন। কারণ তাদের হাতে এককালীন সঞ্চয় বা অলস টাকা থাকে না।  

ভোক্তাঋণের ওপর বাড়তি সুদ আরোপ প্রান্তিক এই  ভোক্তাদেরকে আরও চাপে  ফেলবে। ভোক্তা পর্যায়ের সুদ বাড়ানোর কারণে টিভি, ফ্রিজ, ওভেন, ওয়াশিং মেশিন, মোবাইল, ল্যাপটপ, বাসা বড়ির ফার্নিচার, রেডিমেট গার্মেন্টস, মোটরসাইকেল, আবাসিক ফ্ল্যাট ইত্যাদি বিক্রি অনেক কমে যাবে। সংশ্লিষ্ট শিল্পপ্রতিষ্ঠান চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। এমনিতেই নির্মাণ সামগ্রীর দাম বহুলাংশে বাড়ার কারণে ফ্ল্যাটের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নয়। তার ওপর সুদ বাড়ানো হলে ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা আরও কমে যাবে। অবিক্রীত অবস্থায় অনেক ফ্ল্যাট পড়ে থাকলে ডেভেলপারদের ব্যাংক ঋণ পরিশোধ কঠিন হয়ে যাবে।  ডলার সংকটের কারণে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি ইত্যাদি নানা কারণে পণ্য উৎপাদন খরচ বহুলাংশে বেড়েছে। পণ্যের বাড়তি দাম, ভ্যাট ইত্যাদি সব সাধারণ ভোক্তাদেরকেই বহন করতে হয়।

মুদ্রানীতিতে ব্যবসায়ীদের লোনে ৯ শতাংশ সুদ বহাল থাকলেও ভোক্তাদের লোনে তা বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা আরও সঙ্কুচিত হয়েছে। নতুন ঘোষণায় শিক্ষা ঋণকেও বর্ধিত সুদের আওতায় রাখার কথা বলা হচ্ছে।  
অতি সম্প্রতি ইউনেস্কোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিক্ষা খাতে ব্যয়ের ৭১ ভাগবহন করে পরিবার। করোনাকালে দেশের সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কমেছে প্রায় আড়াই লাখ। এদেরকে ক্লাসে ফেরানোই একটা বড় চ্যালেঞ্জ যা শিক্ষা ঋণ বাড়ানোর কারণে আরও সঙ্কটাপন্ন হবে। করোনার কারণে বিদেশে উচ্চ শিক্ষার একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে। একে কাজে লাগাতে শিক্ষার মতো সংবেদনশীল খাতের জন্য আরও সহায়ক নীতিমালা প্রয়োজন।

ভোক্তা ঋণের গ্রাহকদের স্বস্তিতে কিছু প্রস্তাবনা 
লোনের সর্বোচ্চ সীমা ১২ শতাংশ নির্ধারণ না করে আমানত ও ঋণের স্প্রেড (ব্যবধান) নির্ধারণ করা : কোন ব্যাংক যদি আমানতকারীদের আমানতের বিপরীতে ২ শতাংশ সুদ দেয় (অর্থাৎ যাদের কস্ট অব ফান্ড কম) এবং অতিরিক্ত মুনাফার আশায় ১২ শতাংশ সুদে লোন দেয় তাহলে ভোক্তার সঙ্গে তা ‘ন্যায়সঙ্গত’ হয় না। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সক্ষমতার ব্যবধান অনেক বাড়ে এবং বাজারে অস্থিরতা  তৈরি হয়।  

গত বছরের আগস্টে ডলার সংকটের সময় বাংলাদেশ ব্যাংক বাংলাদেশের প্রথম সারির কিছু ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের ৬ কর্মকর্তাকে অপসারণের সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন ‘ডলার সংরক্ষণ করে দর বৃদ্ধির প্রমাণ পাওয়ায়’। পরে অবশ্য এই মর্মে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা/দিকনির্দেশনা না থাকার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক তার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছিল। তবে পুরনো প্রজন্মের ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা আশা করেছিলেন মনে হয়েছে। সুদের হার ফিক্সড না করে আমানত ও ঋণের ব্যবধান সর্বোচ্চ কতো রাখা যাবে সেই নির্দেশনা যদি বাংলাদেশ ব্যাংক দেয় তাহলে গ্রাহকরা সুফল পাবে।  

চলমান ঋণগুলোতে বাড়তি সুদের হার কার্যকরী না করা : সরকারের ৬-৯ শতাংশ পলিসির আলোকে ভোক্তা নিজের আয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে লোন নিয়েছেন এবং ব্যাংক  ডেট-বার্ডেন রেশিও (উইজ) হিসাব করে লোন দিয়েছেন। অর্থাৎ বাজারে টাকার সরবরাহ করে দিয়েছেন। অতএব সুদের হার বাড়িয়ে এখানে রাশ টানা যাবে না; বরং ব্যাংকের লোন ক্লাসিফিকেশন বাড়বে।  

শিক্ষা খাতের লোনকে আওতামুক্ত রাখা : উচ্চ শিক্ষার সুযোগকে প্রসারিত করার লক্ষ্যে এ খাতে ঋণের সুদের হার বাড়ানো  থেকে অব্যাহতি দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক স্বল্প সুদের রিফাইন্যান্স স্কিম চালু করলে সুফল আসবে।

হোম লোন ও হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্সগুলোকে আওতামুক্ত রাখা : এগুলোর ক্ষেত্রে ব্যাংকের জন্য প্রভিশন ইতিমধ্যে কমিয়ে ১ শতাংশ করা হয়েছে। তাছাড়া এগুলো সিকিউরড লোন/মর্টগেজ লোন, জামানতবিহীন  লোনের তুলনায় ঝুঁকি কম বিধায় রিস্ক প্রিমিয়াম কম। অতএব সুদের হারও কম হওয়া বাঞ্ছনীয়। তাছাড়া আবাসন খাত সুরক্ষায় এটি কার্যকর হবে।  

ট্যাক্সের তথ্য দিয়ে সুদের হারের বিভিন্ন কাস্টমাইজ ধাপ করা : নতুন লোন পাওয়ার ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে কর রিটার্ন জমা স্লিপ প্রদান বাধ্যতামূলক করেছে সরকার। এখান থেকে গ্রাহক বাৎসরিক কতো টাকা ট্যাক্স দিচ্ছেন বা তার নিট সম্পদের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। সবার জন্য সমান সুদ হার না করে লোন দেয়ার ক্ষেত্রে লোন অ্যামাউন্ট বা ট্যাক্স অ্যামাউন্ট অথবা নিট সম্পদের স্ল্যাব করে সুদের হারের স্ল্যাব নির্ধারণ করা যেতে পারে। এতে সাম্যতা নিশ্চিতের সুযোগ হতে পারে। সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রে সরকার বিভিন্ন অঙ্কের ধাপ করেছেন এবং সুদের তারতম্য করেছেন। ছোট অঙ্কের গ্রাহকদের বেশি সুদ দিয়েছেন এবং বড় অঙ্কের গ্রাহকদের সুদ কিছুটা কমিয়েছেন।

গ্রাহকের রিস্ক গ্রেডিং করে কাস্টমাইজড সুদের হার নির্ধারণ করা : বিভিন্ন পেশার ধরণ ও রিস্ক যাচাই করে সে অনুযায়ী সুদের হার নির্ধারণ করা। যেমন- গ্রাহকরা যখন একাউন্ট করেন তখন তার পেশা, লেনদেন, সম্পদ, রেফারেন্স ইত্যাদি নানা সূচকে তার রিস্ক  গ্রেডিং করা হয়। লোন গ্রাহকদের রিস্ক গ্রেডিং করে সুদের হার নির্ধারণ করা যেতে পারে। ‌‌'কম ঝুঁকি কম সুদ, বেশি ঝুঁকি বেশি সুদ'-এই নীতিতে সুদের হার নির্ধারণ করা যেতে পারে।  

ভালো গ্রহীতাদের প্রণোদনা চালু করা :  BRPD সার্কুলার ০৬, তারিখ ১৯/০৩/২০১৫ তে ভালো গ্রহীতা (GOOD BORROWER) দেরকে আদায়কৃত সুদের ওপর ১০ শতাংশ রিবেট ঘোষণা করা হয়েছিল যা ব্যাংকগুলো স্ব-উদ্যোগে করবেন। ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে আমানত-সুদের হার ৬-৯ শতাংশ করার পর এই সুবিধা রহিত করা হয়। এক্ষণে ভোক্তাদের চরম সংকটেও যারা লোন নিয়মিত পরিশোধ করছেন তাদের জন্য এই সুবিধা আরও বিস্তৃত পরিসরে  চালু করা আবশ্যক। ২০১৫-এর সার্কুলার মোতাবেক ৩ বছর টানা অশ্রেণিকৃত থাকলে তৃতীয় বছরের আরোপিত সুদের ওপর ১০ শতাংশ রিবেট এবং পরবর্তীতে বাৎসরিক ভিত্তিতে তা প্রদান করার নির্দেশনা ছিল। করোনা পরবর্তী সংকটের কারণে এই রিবেট সুবিধা প্রথম বছর থেকেই দেয়া যেতে পারে এবং ১০ এর বদলে ২০ শতাংশ করা গেলে গ্রাহকের স্বস্তি হবে। ভোক্তা ঋণের ক্ষেত্রে জেনারেল প্রভিশন কমানোতে ব্যাংকগুলোর এই প্রণোদনা সক্ষমতা দিতে সমস্যা হবে না।  

তাছাড়া লোন সাব স্ট্যান্ডার্ড (SS) মানে শ্রেণিকৃত হলে ২০ শতাংশ প্রভিশন রাখা হয়। ডাউটফোল হলে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ মানে শ্রেণীকৃত হলে ১০০ শতাংশ প্রভিশন রাখা হতো এবং আরোপিত সুদ আয় খাতে নেয়া যেতো না। পাশাপাশি আদায় খরচ (ফোন, ফিজিক্যাল ভিজিট, লিগ্যাল নোটিশ, মামলা, রিকভারি অফিসারের বেতন ইত্যাদি) অনেক বাড়তো।  

ভালো গ্রহীতাদেরকে উৎসাহিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের আরও কিছু নির্দেশনা রয়েছে যার পরিপালন যথার্থভাবে হচ্ছে না বলে ভালো গ্রাহকদের মধ্যে হতাশা আছে। যেমন: সিআইবিতে STD-Good Borrower মার্ক  করা, ছবি ও  প্রোফাইল ব্যাংকের ম্যাগাজিনে প্রকাশ, পুরষ্কার/সার্টিফিকেট প্রদান ইত্যাদি আয়োজনে সম্মানিত করা। ভালো গ্রহীতাদের জন্য আরও কিছু প্রণোদনা ঘোষণা করলে তারা উৎসাহিত হবে, পরিচালন ব্যয় কমবে, সুদ আয় বাড়বে। যেমন: ভালো গ্রহীতাদের সন্তানদের শিক্ষা বৃত্তি চালু করা, সম্মানসূচক ভিআইপি কার্ড দেয়া, বিমানবন্দরে ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহার করতে দেয়া, ফ্যামিলি কার্ড  দেয়া যেন সুপার শপে ডিসকাউন্ট পান ইত্যাদি।  

মোটকথা, গুণীর কদর যত বেশি হবে তত গুণী তৈরি হবে বলে আশা করা যায়। ভালো গ্রহীতারা মূল্যায়িত হলে এর সংখ্যা আরো বাড়বে। পরিশেষে, ভোক্তাঋণ বাংলাদেশের মোট ঋণের প্রায় ১০ শতাংশের মতো। অতএব  ভোক্তা পর্যায়ে সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি মোকাবেলার চেষ্টায় ‘রিস্ক বেনেফিট’ এনালাইসিস দরকার। প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষদেরকে বিবেচনা নিয়েই পলিসি করা হয়। অতএব ভোক্তঋণ সংক্রান্ত নীতিমালায় চূড়ান্ত ভোক্তাদের জন্য সহনীয় কোনো দিকনির্দেশনা আসবে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে-এই আশা সবার।  

লেখক : ভোক্তা ও ভোক্তা ঋণবিষয়ক গবেষক 
ইমেইল : mohi.ahmed2008@gmail.com