দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতায় স্বস্তি দেবে আইএমএফ ঋণ

ফাইল ছবি

দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতায় স্বস্তি দেবে আইএমএফ ঋণ

অনলাইন ডেস্ক

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বৈদেশিক মুদ্রাসংকটে পড়া বাংলাদেশ রিজার্ভ ধরে রাখতে এই অর্থের প্রত্যাশায় ছিল। গত সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে আইএমএফের সদর দপ্তরে এই ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করেছে সংস্থাটির নির্বাহী পর্ষদ। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে আইএমএফের ওয়েবসাইটে এই ঋণ অনুমোদনের বিষয়টি জানানো হয়েছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষায় সহায়তা করবে।

অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ঋণ দেশের অর্থনীতির অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক চাপে কিছুটা স্বস্তি দেবে। একই সঙ্গে দীর্ঘ মেয়াদে পূর্ণ সমাধানের পথও কিছুটা এগিয়ে দেবে।

আইএমএফের ঋণের পূর্ণ সদ্ব্যবহারে সংস্কার বাস্তবায়ন করতে হবে। এ জন্য সাহসী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

দীর্ঘ মেয়াদে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতায় সক্ষমতাও বাড়াতে হবে।  

বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশ ৪৫০ কোটি (৪.৫ বিলিয়ন) ডলার চেয়েছিল, তবে আইএমএফ তার চেয়ে ২০ কোটি ডলার বেশি অর্থাৎ ৪৭০ কোটি (৪.৭০ বিলিয়ন) ডলার দিচ্ছে। প্রতি ডলার ১০৫ টাকা হিসাবে বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৯ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। যার প্রথম কিস্তি ৪৭৬ মিলিয়ন বা ৪৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার শিগগির দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে আইএমএফ।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশ আইএমএফের কাছে এসডিআর থেকে মোট ৩৫০ কোটি ডলারের ঋণ প্রস্তাব দিয়েছিল। ঋণ প্রস্তাব করার সময়, এসডিআরের বিপরীতে ডলারের দর হিসাব করে এর পরিমাণ ছিল ৪৫০ কোটি ডলার। এখন ডলারের দরপতনের কারণে ৩৫০ কোটি এসডিআর ৪৭০ কোটি ডলারের সমান। তাই ঋণের অঙ্ক ২০ কোটি ডলার বেশি হয়েছে।

আইএমএফ বলেছে, এই ঋণ দেশটির সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা অক্ষুণ্ন রাখবে, দুর্বলকে সুরক্ষিত করবে এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পরিবেশসম্মত প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করবে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আইএমএফের ঋণ তখনই সদস্য দেশকে দেওয়া হয়, যখন তারা অর্থনৈতিকভাবে চাপের মুখে পড়ে। এতে দুটি বিষয় থাকে-একটি আর্থিক সহায়তা, আরেকটি নীতিগত সহায়তা। আমাদের এখন রিজার্ভের সংকট আছে, এই ঋণ রিজার্ভ বাড়াবে। সেখান থেকে আমরা আমদানি ব্যয় মেটাতে পারব। অর্থনীতিকে চালিয়ে রাখতে হলে আমদানি একটা পর্যায়ে অবশ্যই ধরে রাখতে হবে। শুধু আর্থিক সহায়তায় আমাদের সমস্যার সমাধান হবে না। প্রতি মাসে দেড় বিলিয়ন ডলার করে আমরা রিজার্ভ হারাচ্ছি। কাজেই আইএমএফের অর্থ দিয়ে আমাদের চাহিদা মেটানো যাবে না। আমাদের অন্যান্য পলিসি নিতে হবে, যা পরিস্থিতি পরিবর্তনে সহায়তা করবে। ’

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিডিপি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আইএমএফের ঋণ আমাদের সংকটকালে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা মেটাতে কিছুটা হলেও সহায়ক হবে। এর মাধ্যমে অন্য উন্নয়ন সহযোগীদের কাছেও বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক বার্তা যাবে। আইএমএফের পরামর্শের অনেকটি বাংলাদেশ যখন ২০১২ সালে আইএমএফ থেকে ঋণ নিয়েছিল, তখনো এমন পরামর্শগুলো দেওয়া হয়েছিল, যার মধ্যে ছিল ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন, খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা, ঋণ ব্যবস্থাপনা, সুদের হার বাজারমুখী করা, বিনিময় হারকে বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করা। ’ 

বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আইএমএফের অর্থায়ন আমাদের প্রয়োজনের তুলনায় খুব বেশি টাকা নয়। গত সাত মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক ৯০০ কোটি ডলারের কাছাকাছি বিক্রি করেছে। সেখানে আমরা পাচ্ছি মাত্র ৪৭০ কোটি ডলার। কাজেই টাকাটা বড় বিষয় নয়। অর্থনৈতিক প্রভাবকে কিছুটা চাঙ্গা করবে। ’

এই অর্থনীতিবিদ আরো বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতি একটা চাপের মধ্যে আছে। এ ধরনের চাপের মধ্যে আইএমএফের সঙ্গে ৪২ মাস মেয়াদি একটি কর্মসূচির দিকে যাচ্ছি আমরা। এটি ম্যাক্রো ম্যানেজমেন্টের জন্য সহায়ক হবে। ’

পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান ও বিশ্বব্যাংক গ্রুপের সাবেক জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ মাশরুর রিয়াজ বলেন, ‘আইএমএফের ঋণে দুই ধরনের সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে। একটি স্বল্পমেয়াদি, আরেকটি অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তনে দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন। এসব সংস্কার বাস্তবায়নে সাহসী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত জরুরি। ’

কী সংস্কার করতে হবে তা-ও বলে দিয়েছে আইএমএফ। সংস্থার উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) অ্যান্তইনেত মনসিও সায়েহ সংস্থাটির বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, ‘আর্থিক খাতের দুর্বলতা কমলে, নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা উন্নত করা হলে ও পুঁজিবাজারের উন্নতি করা গেলে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রয়োজনীয় অর্থায়ন করা সম্ভব হবে। ’ কর নীতি ও রাজস্ব প্রশাসন-উভয় খাতেই হাত দিতে হবে। রাজস্ব সংস্কার হলে সরকারি অর্থায়ন, বিনিয়োগ ও ঋণ ব্যবস্থাপনা উন্নত হবে। এতে সরকারের ব্যয় সক্ষমতা ও স্বচ্ছতা বাড়বে এবং শাসনব্যবস্থা উন্নত হবে।

সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক কী সংস্কারে হাত দিয়েছে, যাতে আইএমএফ সমর্থন করছে-আইএমএফের ডিএমডির ঢাকা সফরের সময় এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে জানা যায়, ভর্তুকি কমাতে জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে সরকার। এরপর গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি করা হয়। রিজার্ভের গণনা পদ্ধতি আইএমএফের চাওয়া অনুযায়ী করা হচ্ছে এবং জ্বালানি তেলের দাম মাসে মাসে সমন্বয় করার ঘোষণাও দিয়েছে সরকার।

এর আগে সোমবার রাতে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এক বিবৃতিতে আইএমএফকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, যাঁরা ভেবেছিলেন সামষ্টিক অর্থনীতির মৌলিক এলাকাগুলো দুর্বল বলে ঋণ দেবে না আইএমএফ, তাঁদের সেই ধারণাও মিথ্যা প্রমাণিত হলো। দেশের অর্থনীতি শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশ ভালো আছে।