কিস্তিতে ক্রয়-বিক্রয় ইসলামী বিধান মতে কী বৈধ?

প্রতীকী ছবি

কিস্তিতে ক্রয়-বিক্রয় ইসলামী বিধান মতে কী বৈধ?

মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহ

কিস্তিতে ক্রয়-বিক্রয় মানে, পণ্য নগদে গ্রহণ আর মূল্য বাকিতে পরিশোধ। অর্থাৎ বিক্রেতা ব্যাবসায়িক পণ্য ক্রেতাকে বিক্রয় চুক্তির সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দেবে; কিন্তু ক্রেতা তখন ক্রয়মূল্য পরিশোধ করবে না; বরং চুক্তি মোতাবেক বিক্রয়মূল্য পর্যায়ক্রমে পরিশোধ করবে। বর্তমানে জমি থেকে শুরু করে নানা ধরনের পণ্য বিক্রি হয়। এতে ক্রেতা সহজে পণ্য ক্রয় করতে পারে।

অন্যদিকে বিক্রেতাও নগদের তুলনায় দেরিতে উসুলের কারণে অতিরিক্ত মূল্য লাভ করতে পারে। ইসলামী ফিকহের পরিভাষায় এ ধরনের ক্রয়-বিক্রয়কে ‘বাইয়ে বিত তাকসিত’ বলা হয়। এ ধরনের লেনদেন ইসলামে বৈধ। আর কিস্তিতে পণ্য ক্রয়ের কারণে নগদ মূল্যের অতিরিক্ত মূল্য নেওয়া সর্বসম্মতভাবে বৈধ।
এটি সুদ নয়। এ ব্যাপারে চার মাজহাবের ইমামসহ বেশির ভাগ আলেম একমত। (আল ফিকহুল ইসলামী ওয়া আদিল্লাতুহু : ৪/২৪২)

নবীযুগে কিস্তিতে ক্রয়-বিক্রয়ের প্রমাণ হলো, হাদিসে এসেছে : আমর ইবনু শারিদ (রহ.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি সাদ ইবনু আবু ওয়াক্কাস (রা.)- এর কাছে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তখন মিসওয়ার ইবনু মাখরামাহ (রা.) এসে তাঁর হাত আমার কাঁধে রাখেন। এ অবস্থায় নবী (সা.)-এর আজাদকৃত গোলাম আবু রাফি (রা.) এসে বললেন, হে সাদ, আপনার বাড়িতে আমার যে দুটি ঘর আছে, তা আপনি আমার কাছ থেকে ক্রয় করে নিন। সাদ (রা.) বললেন, আল্লাহর কসম, আমি ওই দুটি ক্রয় করব না। তখন মিসওয়ার (রা.) বললেন, আল্লাহর কসম, আপনি এ দুটো অবশ্যই ক্রয় করবেন। সাদ (রা.) বলেন, আল্লাহর কসম, আমি তোমাকে কিস্তিতে চার হাজার (দিরহাম)-এর বেশি দেব না। আবু রাফি (রা.) বললেন, এই ঘর দুটির বিনিময়ে আমাকে পাঁচ শ দিনার দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। আমি যদি আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে এ কথা বলতে না শুনতাম যে প্রতিবেশী বেশি হকদার তার নৈকট্যের কারণে, তাহলে আমি এ দুটি ঘর আপনাকে চার হাজার (দিরহাম)-এর বিনিময়ে কিছুতেই দিতাম না। আমাকে এ দুটি ঘরের বিনিময়ে পাঁচ শ দিনার দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। তারপর তিনি তা তাঁকে [সাদ (রা.)-কে] দিয়ে দিলেন। বুখারি, হাদিস : ২২৫৮)

এ হাদিস থেকে কিস্তিতে ক্রয়-বিক্রয়ের বৈধতা পাওয়া যায়।

আর কিস্তিতে লেনদেনের ব্যাপারে বারিরা (রা.)-এর হাদিসেও সুস্পষ্ট বক্তব্য আছে। আয়েশা (রা.) বলেন, বারিরা (রা.) আমাদের কাছে এসে বলল, আমি আমার মনিবের সঙ্গে ৯ উকিয়ার বিনিময়ে কিতাবত (গোলামি থেকে মুক্তির জন্য) চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছি। এ শর্তে যে বছরে এক উকিয়া করে পরিশোধ করব। (বুখারি, হাদিস :২৫৬৩)

তা ছাড়া ইসলামে বাঈ মুয়াজ্জাল তথা ভবিষ্যতে নির্ধারিত কোনো সময়ে একসঙ্গে অথবা কিস্তিতে উভয় পক্ষের সম্মতিতে মূল্য পরিশোধের শর্তে ক্রয়-বিক্রয় জায়েজ। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনরা, তোমরা যখন একে অন্যের সঙ্গে নির্ধারিত সময়ের জন্য ঋণের কারবার করো, তখন তা লিখে রেখো...। ’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৮২)

তবে নগদের তুলনায় কিস্তিতে বেশি দামে লেনদেন করা শুদ্ধ হবে কয়েকটি শর্ত সাপেক্ষে-

ক.  ক্রয়-বিক্রয়ের মজলিসেই পণ্যের মূল্য নির্দিষ্ট হতে হবে।

খ.  পরিশোধের সময় নির্দিষ্ট হতে হবে। হাদিসে এসেছে, আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (সা.)-এর মদিনায় আগমনকালে মদিনাবাসীরা এক বা দুই বছর মেয়াদে বিভিন্ন ধরনের ফল অগ্রিম ক্রয় করত। তিনি বলেন, যে কেউ খেজুর অগ্রিম ক্রয় করবে, সে যেন নির্ধারিত পরিমাপে বা নির্ধারিত ওজনে এবং নির্ধারিত মেয়াদে ক্রয় করে। (মুসলিম, হাদিস : ৩৯৭৩)

গ.  নির্ধারিত সময়ে টাকা পরিশোধ না করলে জরিমানা হিসেবে অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার শর্ত দেওয়া যাবে না। কেননা এটি সুদ। (আল ফাতাওয়াল হিন্দিয়্যা ৩/৩)

ঘ.  সম্ভব হলে সেই চুক্তি লিপিবদ্ধ করে রাখবে বা এর জন্য সাক্ষী রাখবে। যদি কত দিনে বা কত কিস্তিতে মূল্য পরিশোধ করবে নির্দিষ্ট না থাকে কিংবা নির্দিষ্ট কিস্তি পরিশোধ না করতে পারলে দাম বৃদ্ধি করার শর্ত থাকে, তাহলে উক্ত ক্রয়-বিক্রয় বৈধ হবে না।

আর হ্যাঁ, এ ক্ষেত্রে বিক্রেতা উক্ত কিস্তি উসুলের নিশ্চয়তার জন্য বন্ধক হিসেবে কোনো কিছু রাখতে পারে। হাদিস শরিফে এসেছে, আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (সা.) একজন ইহুদির কাছ থেকে নির্দিষ্ট মেয়াদে খাদ্য শস্য ক্রয় করেন এবং নিজের বর্ম তার কাছে বন্ধক রাখেন। (বুখারি, হাদিস : ২৫০৯)

বন্ধক বা গ্যারান্টি রাখার দুটি পদ্ধতি আছে। যথা : ১. কোনো ব্যক্তিকে জামিন হিসেবে সাব্যস্ত করা। প্রয়োজনের সময় ওই ব্যক্তির মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করে কিস্তির টাকা আদায় করা যাবে। ২. ক্রেতা তার মালিকানাধীন কোনো বস্তু বিক্রেতার কাছে বন্ধক হিসেবে রেখে দেওয়া। তবে বন্ধক গ্রহীতা বন্ধকি সম্পত্তি ব্যবহার করতে পারবে না। কোনো সময় যদি ক্রেতা তার ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করে বা টালবাহানা করে তবে বিক্রেতা ইচ্ছা করলে ক্রেতা কর্তৃক রাখা বন্ধককৃত বস্তু বিক্রয় করে তার ঋণের টাকা নিয়ে নিতে পারবে। এতে কম-বেশি হলে পরস্পর বিনিময় করে নেবে। (হিদায়া : ৪/১১৪)