একনজরে পারভেজ মোশাররফ

পাকিস্তানের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী প্রেসিডেন্ট ছিলেন পারভেজ মোশাররফ

একনজরে পারভেজ মোশাররফ

অনলাইন ডেস্ক

পারভেজ মোশাররফের জন্ম ১৯৪৩ সালের ১১ আগস্ট, ব্রিটিশ ভারতের দিল্লিতে। তিনি করাচী এবং তুরস্কের ইস্তানবুলে বড় হন। লাহোরের ফরমান ক্রিশ্চিয়ান কলেজে গণিত নিয়ে ভর্তি হলেও ১৯৬১ সালে পরিবারের অমতে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে যোগ দেন। ১৯৬৪ সালে একাডেমি থেকে ২য় লেফটেন্যান্ট হিসেবে বের হয়েছিলেন।

এই পদবীতেই ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। পারভেজের ডাক নাম ছিলো কাউবয়, মুশ, পাল্লু।

আশির দশকে ব্রিগেডিয়ার পদবীতে একটি গোলন্দাজ ব্রিগেডের অধিনায়কত্ব লাভ করেন পারভেজ মোশাররফ। নব্বইয়ের দশকে মেজর-জেনারেল মুশাররফ একটি পদাতিক ডিভিশনের অধিনায়ক এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডো বাহিনী 'স্পেশাল সার্ভিসেস গ্রুপ' এর প্রধান অধিনায়ক হন।

পরে সেনাবাহিনী সদর দপ্তরে ডেপুটি মিলিটারি সেক্রেটারি এবং ডাইরেক্টর জেনারেল অব মিলিটারি অপারেশন্স ডাইরেক্টরেট ছিলেন।

ক্ষমতা দখল করে রাষ্ট্রপতি হন
১৯৬১ সালের ১৯ এপ্রিল তিনি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি কাকুল থেকে কমিশন পান। এর পর তিনি যোগ দেন স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপে। ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালের যুদ্ধেও অংশ নেন তিনি। ১৯৯৮ সালে জেনারেল পদে উন্নীত হন এবং সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এর এক বছর পর ১৯৯৯ সালের ১২ অক্টোবর অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নওয়াজ শরিফকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন মোশাররফ। পরে ২০০১ সালের ২০শে জুন তারিখে তিনি রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করেন।  

সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী প্রেসিডেন্ট 
পারভেজ ২০০২ সালে একটি গণভোটের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং ২০০৮ সাল পর্যন্ত পদে বহাল ছিলেন। তিনি ছিলেন পাকিস্তানের পাকিস্তানের ১০ম রাষ্ট্রপতি ও সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী প্রেসিডেন্ট। মাঝে ২০০৪ সালে ১৭তম সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট হন।  

ভারতে হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন 
১৯৯৮ সালের অক্টোবর মাসে পারভেজ মুশাররফের পদবী লেফটেন্যান্ট-জেনারেল থেকে পূর্ণ জেনারেল পদবীতে উন্নীত করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ। পূর্ণ জেনারেল হিসেবে পারভেজ সেনাবাহিনী প্রধান এবং চেয়ারম্যান অব দ্যা জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ কমিটির দায়িত্ব পেয়েছিলেন। ১৯৯৯ সালে ভারতে হামলার মূল পরিকল্পনা পারভেজই করেছিলেন যেটা পরে কার্গিল যুদ্ধে রূপ নেয়। প্রধানমন্ত্রী শরীফের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে পারভেজের মতবিরোধ থাকায় তাকে সামরিক বাহিনী থেকে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন নেওয়াজ শরীফ। জেনারেল পারভেজ এর পাল্টা জবাব হিসেবে নওয়াজ শরীফকে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেন ১৯৯৯ সালে। এরপর শরীফকে গৃহবন্দী করে রাওয়ালপিন্ডির সেন্ট্রাল জেলে রাখা হয়।

নিজেকে প্রকৃত রাষ্ট্রপতি ঘোষণা 
পারভেজ দেশের শাসনক্ষমতা পরিপূর্ণভাবে নিজের হাতে তুলে নেন এবং ২০০১ সালে চেয়ারম্যান অব দ্যা জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ কমিটির পদ ছেড়ে দেন; যদিও তিনি আর্মি চিফের দায়িত্বে থেকে যান। ২০০১ সালের ২০শে জুন পারভেজ নিজেকে দেশের প্রকৃত রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন এবং ২০০২ সালের ১ মে একটি রেফারেন্ডামের মাধ্যমে তিনি পাঁচ বছরের জন্য রাষ্ট্রপতি থাকবেন বলে জানান।

জঙ্গীদের হামলায় হত্যাচেষ্টার শিকার হন

ক্ষমতায় আসার কয়েক বছরের মধ্যেই ইসলামপন্থী জঙ্গীদের হামলার দ্বারা হত্যাচেষ্টার শিকার হয়েছিলেন জেনারেল পারভেজ। যদিও প্রত্যেকবারই তিনি বেঁচে যান। তবে ক্ষমতায় বসার সঙ্গে সঙ্গেই পারভেজ মোশাররফ দেশের অর্থনীতি এবং সমাজ-ব্যবস্থা পরিবর্তনের দিকে মনোযোগ দেন। তিনি ‘থার্ড ওয়ে’ রাজনৈতিক ধারার সমর্থক ছিলেন। তিনি শওকত আজিজকে দেশের নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আরো ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলেন।  

ট্রেড ইউনিয়ন নিষিদ্ধ করেছিলেন
২০০২ সালে তিনি দেশের সংবিধানে পরিবর্তন আনেন। তিনি সামাজিক উদারনীতিবাদের একজন গোঁড়া সমর্থক ছিলেন এবং পাকিস্তানের জন্য 'এনলাইটেন্ড মোডারেশোন প্রোগ্রাম' চালু করেন।  সঙ্গে সঙ্গে তিনি 'ইকোনমিক লিবারেলাইজেশন' শক্তভাবে চালু করে ট্রেড ইউনিয়ন নিষিদ্ধ করেছিলেন।

বিচারকদের পদচ্যুত করেছিলেন 
জেনারেল পারভেজের শাসনামলে ৯/১১ ঘটনার পর পাকিস্তানকে ফ্রন্টলাইন মিত্র হওয়ার মার্কিন প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলেন এই সামরিক নেতা। ২০০৭ সালের নভেম্বরে তিনি দেশটির সংবিধান বাতিল করে জরুরি অবস্থা জারি করেন। ২০০৭ সালের নভেম্বরে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের পদচ্যুত করার কারণে সংবিধান-বিরোধী পদক্ষেপের জন্যও পরিচিতি পান। ফলে আইনজীবীরা ব্যাপক আন্দোলনের সূচনা করে। সেটিকে বিচারব্যবস্থা পুনরুদ্ধারের আন্দোলন নামেও বলা হয়েছিল। সেই ধারাবাহিকতকায় রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বে ব্যাপক আন্দোলনের মূখে ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এর বিরুদ্ধে ওই সময় ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। অভিশংসনের ঝুঁকি এড়াতে তিনি ২০০৮ সালে পদত্যাগ করেন।

মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হয়
২০১৬ সালের মার্চে পাকিস্তান ছেড়ে চলে যান পারভেজ। চিকিৎসার উদ্দেশ্যে তাঁকে দেশ ছাড়ার অনুমতি দেওয়া হয়। রাষ্ট্রদ্রোহের গুরুতর অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে ২০১৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর ইসলামাবাদের বিশেষ আদালত মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন পাকিস্তানের লাহোর উচ্চবিচারালয়ের বিচারক শহীদ করিমের বেঞ্চ। এরপর সেই আদেশ নিয়ে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন পারভেজ। মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পর লাহোর হাইকোর্টের কাছে আবেদন জানিয়ে তিনি বলেছিলেন, রায় ঘোষণার ক্ষেত্রে সংবিধানের ৪, ৫, ১০ ও ১০-ক অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করা হয়েছে। রায় পুনর্বিবেচনার আবেদনও জানান তিনি। পরে যে প্রক্রিয়ায় পারভেজ মোশাররফের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছিল, তাকে অসাংবিধানিক উল্লেখ করে ওই বছরের ১৩ জানুয়ারি মৃত্যুদণ্ডাদেশের সিদ্ধান্ত বাতিল ঘোষণা করে লাহোরের হাইকোর্ট।

অসুস্থ ছিলেন দীর্ঘদিন
আজ রোববার (৫ ফেব্রুয়ারি) ৭৯ বছর বয়সে দুবাইয়ের একটি হাসপাতালে মারা যান পাকিস্থানে সাবেক এই প্রেসিডেন্ট। পারিবারিক সূত্রের বরাতে জিও নিউজ জানায়, সাবেক এই সামরিক শাসক দুবাইয়ের আমেরিকান হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। সেখানেই তার মৃত্যু হয়।  পারভেজ মোশাররফের মৃত্যুর পর বলা যায়, একটি ইতিহাসের সমাপ্তি হলো।

news24bd.tv/desk