যে কারণে তুরস্ক-সিরিয়ায় এত শক্তিশালী ভূমিকম্প

সংগৃহীত ছবি

যে কারণে তুরস্ক-সিরিয়ায় এত শক্তিশালী ভূমিকম্প

অনলাইন ডেস্ক

তুরস্ক-সিরিয়ায় সোমবার আঘাত হানা ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে এখন পর্যন্ত সাড়ে তিন হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছেন। এই ভূমিকম্পকে এই দশকের সবচেয়ে মারাত্মক হিসেবে মনে করা হচ্ছে। ভূমিকম্পবিদরা বলেছেন, ভয়াবহ এই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল অস্থিতিশীল ভূপ্রাকৃতিক এক অঞ্চলের আশপাশে। আর সেই অঞ্চলটিকে বলা হয়, পূর্ব আনাতোলিয়ান ফল্ট।

বিবিসি বলছে, বিপজ্জনক এই ফল্ট তুরস্কের দক্ষিণ–পূর্ব সীমান্তের দক্ষিণ পশ্চিম থেকে উত্তর-পশ্চিম বরাবর অবস্থিত। আনাতোলিয়ান এবং আরব প্লেটের মধ্যে ১০০ কিলোমিটারেরও বেশি ফাটল রয়েছে। ভূমিকম্পবিদরা তুরস্কের ওই পূর্ব আনাতোলিয়ান ফল্টকে অত্যন্ত বিপজ্জনক হিসেবে আগেই শনাক্ত করেছিলেন।

আরও পড়ুন...ঘানার সেই ফুটবলারের খোঁজ মিলেছে

ভূপৃষ্ঠের নিচে যা ঘটেছিল এবং এরপরে আরও কী ঘটতে পারে সে বিষয়ে বিজ্ঞানীরা যা বলেছেন:

উৎপত্তিস্থল কোথায়?

ভূমিকম্পটি উত্তর-পূর্ব দিকে এগিয়ে গিয়ে মধ্য-তুরস্ক এবং সিরিয়ায় ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে।

ভয়াবহ এই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল অস্থিতিশীল ভূপ্রাকৃতিক এক অঞ্চলের আশপাশে তুর্কি শহর নুরদাগি থেকে ২৬ কিলোমিটার পূর্বের পূর্ব আনাতোলিয়ান ফল্টের প্রায় ১৮ কিলোমিটার গভীরে। । আর সেই অঞ্চলটিকে বলা হয়, পূর্ব আনাতোলিয়ান ফল্ট। বিংশ শতাব্দিতে পূর্ব আনাতোলিয়ান ফল্টলাইনে বড় ধরনের ভূমিকম্পের কার্যকলাপ সামান্যই দেখা যায়। ব্রিটিশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থার গবেষণা সহযোগী রজার মুসন বলেন, ‘আমরা যদি সিসমোমিটার দিয়ে রেকর্ড করা (প্রধান) ভূমিকম্পগুলোকে সহজভাবে দেখি, তাহলে এটি কিছুটা কম কিংবা বেশিই দেখা যাবে। ’

আরও পড়ুন..তুরস্কে নিখোঁজ এক বাংলাদে‌শিকে উদ্ধার

মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএস বলছে, ওই অঞ্চলে ১৯৭০ সালের পর থেকে মাত্র তিনটি ভূমিকম্প রিখটার স্কেলে ৬ মাত্রার ওপরে হয়েছে। কিন্তু ১৮২২ সালে একটি ৭ মাত্রার ভূমিকম্প এই অঞ্চলে আঘাত হানে। এতে আনুমানিক ২০ হাজার মানুষ মারা যায়।

• ভূমিকম্পটি কতটা ভয়াবহ ছিল?

গড়ে যেকোনও বছরে ৭ মাত্রার বেশি ভূমিকম্প হয় ২০টিরও কম। এই বছরের প্রথম অর্থাৎ সোমবারের ভূমিকম্প সেই হিসেবে প্রথম অত্যধিক প্রাণঘাতী।

ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের ইনস্টিটিউট ফর রিস্ক অ্যান্ড ডিজাস্টার রিডাকশনের প্রধান জোয়ানা ফাউর ওয়াকারের মতে, ২০১৬ সালে ইতালির মধ্যাঞ্চলে ৬ দশমিক ২ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়েছিল। এতে প্রায় ৩০০ জনের প্রাণহানি ঘটে। সেই তুলনায় আজ তুরস্ক-সিরিয়ায় ২৫০ গুণ বেশি শক্তিতে আঘাত হেনেছে ভূমিকম্প।

আরও পড়ুন...বিশ্বের ভয়াবহ সব ভূমিকম্প 

২০১৩ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সবচেয়ে মারাত্মক ভূমিকম্পগুলোর মধ্যে মাত্র দুটির মাত্রা ছিল সোমবারের ভূমিকম্পের সমান।

• কেন এত শক্তিশালী? 

পূর্ব আনাতোলিয়ান ফল্টকে একটি স্ট্রাইক-স্লিপ ফল্ট হিসেবে মনে করা হয়। এতে কঠিন শিলাযুক্ত প্লেটগুলো উল্লম্ব ফল্ট লাইনজুড়ে একে অপরের সঙ্গে ধাক্কা খায়। শিলাযুক্ত প্লেট যতক্ষণ পর্যন্ত আনুভূমিক গতিতে পিছলে না যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের মাঝে ঘর্ষণ চলতে থাকে। পরে প্রবল বেগে সেখান থেকে শক্তি উৎপন্ন হয়; যা ভূমিকম্পের সূত্রপাত করে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার সান আন্দ্রিয়াস ফল্টকে বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্ট্রাইক-স্লিপ ফল্ট বলে বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে দিয়েছেন। এই ফল্টে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ বিপর্যয়কর এক ভূমিকম্প দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষা করছে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।

আরও পড়ুন...তুরস্ক-সিরিয়া যেন মৃত্যুপুরী, নিহত ছাড়ালো ৩৮০০ 

তুরস্ক-সিরিয়ায় আঘাত হানা ভূমিকম্পের প্রাথমিক ফাটলটি ভূপৃষ্ঠের তুলনামূলক অগভীর গভীরতায় উৎপত্তি হয়েছে। ব্রিটেনের ওপেন ইউনিভার্সিটির ভূ-বিজ্ঞানী ডেভিড রথারি বলেন, ‘উৎস থেকে একই মাত্রার গভীর ভূমিকম্পে ভূ-পৃষ্ঠের কম্পন বেশি তীব্র হবে। ’

• কী ধরনের আফটারশক হতে পারে?

প্রাথমিক ভূমিকম্পের এগারো মিনিটের মাথায় তুরস্ক-সিরিয়ায় ৬ দশমিক ৭ মাত্রার আফটারশক অনুভূত হয়েছে। এর কয়েক ঘণ্টা পর ফের সিরিয়া-তুরস্কে সাড়ে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। পরে বিকেলের দিকে আবারও ৬ মাত্রার আফটারশক অনুভূত হয়।

মুসন বলেন, ‘আমরা এখন যা দেখছি তা হল পূর্ব আনাতোলিয়ান ফল্টলাইনের সংঘর্ষ আশপাশের ফল্টেও ছড়িয়ে পড়ছে। আমরা আশা করছি, এই ধরনের ভূমিকম্প আরও কিছু সময়ের জন্য দেখা দিতে পারে। ’

আরও পড়ুন...বিভিন্ন দেশ থেকে উদ্ধারকারী দল যাচ্ছে তুরস্কে 

এর আগে ১৮২২ সালের ভয়াবহ প্রাণঘাতী ভূমিকম্পের পরের বছরও দেশটিতে আফটারশক অব্যাহত ছিল।

• শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে?

এর আগে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় একই মাত্রার ভূমিকম্পে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। ২০১৫ সালে নেপালে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পে প্রায় ৯ হাজার মানুষের প্রাণ যায়।

আরও পড়ুন...ধসে পড়েছে তুরস্কের ঐতিহ্যবাহী মসজিদ

রজার মুসন বলেন, তুরস্ক-সিরিয়ার ভূমিকম্পে প্রাণহানি নেপালের তুলনায় কম হওয়ার শঙ্কা নেই বললেই চলে। মৃত্যুর সংখ্যা কয়েক হাজারও হতে পারে। তিনি বলেন, শীতের ঠান্ডা আবহাওয়ার অর্থ হল, ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়া মানুষদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কম।

সূত্র: রয়টার্স ও বিবিসির বিশ্লেষণ

news24bd.tv/ইস্রাফিল