‘দক্ষিণ আফ্রিকায় ৮-৯ বার হামলার শিকার হয়েছি’

দক্ষিণ আফ্রিকা ফেরত বাংলাদেশি উজ্জ্বল হোসেন

‘দক্ষিণ আফ্রিকায় ৮-৯ বার হামলার শিকার হয়েছি’

নিউজ টোয়েন্টিফোর ডেস্ক

দক্ষিণ আফ্রিকা ফেরত উজ্জ্বল হোসেন। বাড়ি মেহেরপুরের মুজিবনগরে। একটু সুখের আশায় তিনি দীর্ঘ সময় দক্ষিণ আফ্রিকার বিভিন্ন প্রদেশে থেকেছেন। ফিরে এসে তার সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন।

সেখানকার ড্রয়ার ভর্তি র‌্যান্ড (সে দেশের মিদ্রা) ছেড়ে গ্রামের ব্যবসায় বেশ আছেন বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।

উজ্জ্বল বলেন ‘১০ লাখ টাকা খরচ করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গিয়েছিলাম হীরের দেশ দক্ষিণ আফ্রিকায়। দেশটিতে আসার পর থেকেই কেমন জানি আতঙ্ক কাজ করতো। কষ্ট, হতাশা ও অনিশ্চয়তায় প্রতিটা মুহূর্ত কাটতো আমার।

‘লোকমুখে কতো কথাই না শোনা যায়। তেমনি আমিও শুনেছিলাম। স্বর্গরাজ্য দেখবো বলে টাকা-পয়সা জোগাড় করেছিলাম। অবশেষে পাড়িও জমিয়েছিলাম, তবে সফল হতে পারিনি। পর্বত ঘেরা দেশ, চারদিকে ফলমূলের সমাহার,খাবারের ছড়াছড়ি। আপেল, কমলালেবুসহ আরও কত কী। ’

তিনি বলেন, ‘শুরুর দিনগুলো খুব একটা ভালো যাচ্ছিলো না। জোহানেসবার্গের রাস্তাঘাট পরিবেশ পরিস্থিতি সবই অচেনা-অজানা। ধীরে ধীরে জানাশোনার পরিধি বাড়তে থাকলো। ব্যবসা-বাণিজ্য বুঝতে শিখলাম। একটা সময় নিজেই একটা দোকান দিয়েছিলাম। ’

কিভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা হচ্ছিলো জানতে চাইলে উজ্জ্বল জানান, ‘যখন অভাবে ছিলাম তখনই ভালো ছিলাম। টাকাই আমার কাল হয়ে দাঁড়ায়। একটা থেকে ধীরে ধীরে ৪টা দোকানের মালিক হলাম। কর্মচারীর সংখ্যাও বাড়তে থাকলো। মূলত আমার দোকানে ৪জন বাংলাদেশি ও ২জন আফ্রিকান নারী কাজ করতো। ’

তিনি আরও জানান, ‘আফ্রিকায় আসার এক বছরের ভেতর আমি বেশ কিছু টাকার মালিক হই। আশপাশের বাঙালিরাও জেনে গেলে আমার ব্যবসার পরিস্থিতি। বাঙালিরাই আমার সঙ্গে শত্রুতা করেছে। তাদের কারণেই বেশিরভাগ সময় সমস্যায় পড়েছি। কতো রাত যে আমার নির্ঘুম কেটেছে, তার কোনো হিসেব নেই। ’

‘শুরু হলো কষ্টের জীবন। আফ্রিকার কালোরা রাতে ঝাঁপিয়ে পড়তো বাঙালিদের ওপর। দোকানে হামলা করে সব লুটে নিতো। কিছু বলতে চাইলে গুলি করার হুমকি আসতো। প্রতিবাদ করলে নিশ্চিত মৃত্যু। কিছুতেই কিছু করার ছিলো না। আমার উন্নতি যেভাবে শুরু হয়েছিল, ঠিক সেভাবেই পতন হতে লাগলো। আফ্রিকার সন্ত্রাসীদের হাত থেকে শেষ পর্যন্ত মুক্তি মেলেনি। একটা সময় শখের দোকান ছেড়ে কোনো রকমে জীবন নিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছি। ’
news24bd.tv
দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গ শহর। এই শহরে দীর্ঘদিন ব্যবসা করেছেন উজ্জ্বল হোসেন

নিরাপত্তার বিষয়ে উজ্জল বলেন, ‘দক্ষিণ আফ্রিকার চারদিকে আতঙ্ক। সব সময় আল্লাহকে ডাকতাম রাতটা যেন ভালোভাবে কাটে। রাতে টাকা-পয়সা সঙ্গে নিয়ে কোথাও যেতে পারতাম না। আবার ঠিকমতো ঘুমও আসতো না সন্ত্রাসীদের ভয়ে। শুধু ভাবতাম জানি না দেশে ফিরতে পারব কিনা? বেশিরভাগ নিগ্রো (কালো) কোনো কাজ করে না। সবসময় মদ্যপ অবস্থায় রাস্তায় প্রকাশ্যে মাতলামি করে। সরকার মাসে মাসে ওদের নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দেয়। সেই টাকা দিয়েই সংসার চালায় ওরা। ’

‘দেশটিতে আসার পর থেকে ৮-৯ বার হামলার শিকার হয়েছিলাম। দোকানের মালামাল লুট হয়েছে অনেকবার। দু’বার আমার হাতে গুলি করেছে সন্ত্রাসীরা। প্রতি দিনই ঝরছে কারও না কারও প্রাণ। অভিযোগ করার মতো কাউকে পেতাম না। তাছাড়া আফ্রিকার পুলিশও আমাদের সহযোগিতা করেনি। নিগ্রোদের সবাই ভয় করে। ’

দক্ষিণ আফ্রিকায় কিভাবে গিয়েছিলেন জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘দেশটিতে যাওয়া খুবই সহজ,কিন্তু লম্বা পথ। বৈধ কাগজপত্র লাগে না ঢুকতে। পাসপোর্ট আগেই জমা দিয়েছিলাম। ভিসার কাজ ওরা আগেই করে রেখেছিল। ১ লাখ টাকা সঙ্গে আনতে হয়েছিল। চট্টগ্রামের একটি হোটেলে রাতেই আমাদের ৭ জনকে বিস্তারিত বিষয় বুঝিয়ে দেয়া হলো। ’

‘প্রথমে চিটাগাং এয়ারপোর্ট (শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর) থেকে ভোরে ফ্লাইট। সেখান থেকে দুবাইয়ে। দুবাই থেকে কেনিয়া, কেনিয়া থেকে ইথিওপিয়া। এরপর ইথিওপিয়ার পাশের দেশ মোজাম্বিকে পৌঁছাই। মোজাম্বিকে দু’দিন রেখেছিল আমাদের। ভোরে আমাদের দক্ষিণ আফ্রিকা বর্ডারের কাঁটাতার কেটে ঢোকানো হয়েছিল। ’

‘দালালদের শর্ত মোতাবেক দেশ ত্যাগ করেছিলাম। সঙ্গে ছিল প্রায় ১২০০ ডলার। ডলার ওরাই ভাঙিয়ে দিয়েছিল। চুক্তি অনুযায়ী বাকি টাকা দক্ষিণ আফ্রিকায় পৌঁছানোর পর দিতে হবে। ওই ডলার বিভিন্ন দেশে খাবার, মোবাইল রিচার্জ ও আনুষঙ্গিক কাজে লেগেছিল। কারণ, ভেঙে ভেঙে দক্ষিণ আফ্রিকায় পৌঁছাতে কমপক্ষে ৫দিন লাগে। ’

‘সাউথ আফ্রিকায় সীমানায় পৌঁছার পর আমাদের রাখা হয় পাকিস্তানিদের কাছে। আমাদের কাছে যা ছিল সবই কেড়ে নেয় পাকিস্তানি আদম দালালরা। তারা ৩দিন একটা বদ্ধরুমে আমাদের আটকে রাখে। খাওয়া-দাওয়া সবই বন্ধ। ঠিক ৩দিন পর বর্ডার পার করে দেয়। এরপর আফ্রিকান দালালরা আমাদের রিসিভ করে। রিসিভ করার পর আমাদের ফোন দিতে বলে বাড়িতে বাকি টাকা পরিশোধ করার জন্য। পৌঁছামাত্রই আরও ২ লাখ টাকা দালালদের দিতে হয়। তবেই আমরা মুক্ত। ’

‘এতো বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্যবসা করার সুযোগ তৈরি হয়। অবৈধভাবে যাওয়ায় সে দেশে সরকারি চাকরির সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায় না। দীর্ঘদিন থাকার পর ২ লাখ টাকা দিয়ে বৈধ হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। তবে অবৈধ প্রবাসীদের আইনি ঝামেলা নেই বললেই চলে। পুলিশকে টাকা দিলেই সব সমস্যার সমাধান। ’

 

অরিন▐ NEWS24

সম্পর্কিত খবর