সচেতন হলে কিডনি রোগ প্রতিরোধ করা যায় 

ফাইল ছবি

আজ বিশ্ব কিডনি দিবস

সচেতন হলে কিডনি রোগ প্রতিরোধ করা যায় 

অনলাইন ডেস্ক

দেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ কিডনি বা বৃক্ক, যা সম্পূর্ণরূপে অকার্যকর হয়ে গেলে মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না। পরিপূর্ণ বিকল হওয়া ছাড়াও কিডনির নানা ধরনের রোগ হয়। অথচ সচেতনতা অবলম্বন করলে এ রোগ অনেকাংশে ঠেকানো যায়। এ বিষয়ে সাক্ষাতকার দিয়েছেন কিডনি ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুন আর রশিদ

সাক্ষাতকার নিয়েছেন আতাউর রহমান কাবুল

কিডনি দেহে কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
মানবদেহের গুরুত্বপূর্ণ অর্গান দুটি কিডনি। গর্ভধারণের ছয় সপ্তাহের মধ্যেই এই দুটি কিডনি পরিপূর্ণভাবে কাজ করে। দেহের প্রবহমান রক্ত পরিশোধন করা ছাড়াও রক্ত তৈরিতে ভূমিকা রাখা, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা, ভিটামিন ‘ডি’ তৈরি করে হাড়ের শক্তি জোগানোর মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে থাকে এই কিডনি।

দুটি কিডনি সঠিকভাবে কাজ না করলে উপরোক্ত কাজগুলো বন্ধ থাকে এবং রোগীর জীবন ঝুঁকিতে চলে যায়। বিশ্বে ৮৫ কোটি এবং বাংলাদেশে দুই কোটির মতো মানুষ কোনো না কোনোভাবে কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়।

ঠিক কী কারণে কিডনি রোগ হয়? 
কিডনি রোগের মূল কারণ ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, নেফ্রাইটিস বা প্রস্রাবের প্রদাহ। এটা ছাড়া যেকোনো কারণে কিডনির ছাঁকনির কার্যকারিতা বিঘ্নিত হওয়ায় হঠাৎ বা ধীরগতিতে কিডনি বিকল হতে পারে। হঠাৎ রক্তচাপ কমে যাওয়া বা অত্যধিক বৃদ্ধি পেলেও কিডনির কার্যক্ষমতা তাড়াতাড়ি লোপ পায়। এ ছাড়া ডায়রিয়া, অতিরিক্ত বমি, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হলে রক্তচাপ অতিরিক্ত কমে যায়। তখন কিডনির রক্ত পরিশোধন ক্ষমতা কমে যায়। এ ছাড়া সন্তান প্রসবের সময় রক্তক্ষরণ হলে বা ইনফেকশন হলেও হঠাৎ কিডনি বিকল হয়। অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ও ব্যথার ওষুধ খেলেও কিডনির সমস্যা হতে পারে।

এই রোগের লক্ষণসমূহ কী কী?
হঠাৎ কিডনি বিকল হলে তার কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায়। ধীরে ধীরে কিডনি বিকল হলে তেমন লক্ষণ প্রকাশ পায় না। যখন লক্ষণ প্রকাশ পায় তখন দেখা যায় ৭০ শতাংশের মতো কিডনি বিকল হয়ে গেছে। প্রস্রাব কমে যাওয়া বা বন্ধ হয়ে যাওয়া, শরীর ফুলে যাওয়া ইত্যাদিও কিডনি রোগের লক্ষণ। তবে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, নেফ্রাইটিসের কারণে কিডনি বিকল হলে সহজে বোঝা যায় না। সমস্যা হলো ৫০ শতাংশ ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপের রোগীরা জানে না যে তারা এসবে আক্রান্ত।

বোঝার জন্য কী কী পরীক্ষা-নিরীক্ষা?
প্রস্রাব পরীক্ষা, রক্তের ক্রিয়েটিনিন, ইউরিয়া, এক্স-রে, আল্ট্রাসনোগ্রাম ইত্যাদি পরীক্ষা করলে কিডনির কার্যকারিতা ও জটিলতা বোঝা যায়।

ক্রনিক কিডনি রোগের ধাপ বা পর্যায় কয়টি?
ক্রনিক কিডনি রোগের পাঁচটি ধাপ রয়েছে। তৃতীয় ধাপ পর্যন্ত চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করলে ভালো থাকা যায়। কিন্তু শেষ ধাপে বা ৭০-৮০ শতাংশ কিডনি বিকল হয়ে গেলে যত চেষ্টা করাই হোক না কেন, চিকিৎসায় পরিপূর্ণ সুস্থতা আনা যায় না। তখন হেমোডায়ালিসিস ও কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট ছাড়া কোনো বিকল্প থাকে না।

বংশগত সূত্রে কাদের এ রোগ হতে পারে?
বংশগত কিছু কিডনি রোগ আছে, যা জন্মের পরপরই, ৫ বা ১০ বছর পরও হতে পারে। ইউরেটার, ইউরিনারি ব্লাডার ও ইউরেথ্রা অবস্ট্রাকশন বা বাধা থাকলে তখন আমরা তাকে জন্মগত কিডনি রোগ বলি। ৪০ বছরের পর পলিসিস্টিক কিডনি রোগে আক্রান্ত রোগী রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করলে এবং বেশি পরিমাণ পানি খেলে ভালো থাকে।

ডায়াবেটিসের সঙ্গে কিডনি রোগের সম্পর্ক কী?
ডায়াবেটিসের সঙ্গে কিডনি রোগের একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগীর ২০ শতাংশের উচ্চ রক্তচাপ, ৪০ শতাংশের ডায়াবেটিস এবং ৩০-৪০ শতাংশের প্রস্রাবে প্রোটিন নির্গত হয়। প্রায় ৬০ শতাংশ রোগী জানেই না যে তাদের ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপ অথবা প্রস্রাবে প্রোটিন নির্গত হয়। ফলে তারা চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না। পরবর্তী সময়ে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে ভুগে ক্রমান্বয়ে দুটি কিডনিই বিকল হয়।

এই রোগ হলে আরো কী কী জটিলতা হতে পারে?
ডায়াবেটিসজনিত কিডনি রোগ হলে কিডনি রোগের পাশাপাশি চোখের সমস্যা দেখা দেয়, হার্টে জটিলতা বৃদ্ধি পায়, উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে। কেউ কিডনি রোগে আক্রান্ত হলে তার শারীরিক জটিলতা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং অন্যান্য অঙ্গেও জটিলতা তৈরি করে। বেশির ভাগ রোগী কিডনির জটিলতা থেকে নয়, বরং হার্টের জটিলতা থেকে মারা যায়। তাই কিডনি রোগীকে খেয়াল রাখতে হবে হার্টের জটিলতাগুলো বৃদ্ধি পাচ্ছে কি না।

খাবারদাবার কি কোনো ভূমিকা রাখে?
কিডনি রোগীদের খাবারদাবার নিয়ন্ত্রণ খুব জরুরি। কিডনি আক্রান্ত ডায়াবেটিসের রোগীরা ডায়াবেটিস ডায়েট গ্রহণ করবে। প্রোটিনজাতীয় খাবারেও কিছুটা নিষেধাজ্ঞা থাকে। তবে ওই সময় প্রথম শ্রেণির প্রোটিন, যেমন—দুধ, ডিম, মাছ, মাংস হিসাব করে খেতে হবে। গরুর মাংস, খাসির মাংস, মগজ, কলিজা ইত্যাদি বর্জন করার পরামর্শ দেওয়া হয়। ফসফেট ও ইউরিক এসিড কম এমন খাবারের পরামর্শ দেওয়া হয়।

বেশি পানি খেলে কি কিডনি ভালো থাকে?
অনেকের ধারণা, বেশি পানি খেলে কিডনি ভালো থাকে। প্রকৃতপক্ষে দিনে দুই-তিন লিটার পানি বা তরলজাতীয় খাবার খেলেই যথেষ্ট। দেহের জন্য পানি পান করা খুব জরুরি; কিন্তু অবশ্যই তা মাত্রাতিরিক্ত নয়। অনেক সময় কিডনিতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাথর বা স্টোন থাকলে, প্রস্রাবে ইনফেকশন থাকলে ওই সব রোগীকে পরিমাণে একটু বেশি পানি পান করার কথা বলা হয়। কিন্তু কিডনিতে জটিলতা তৈরি হলে তখন চিকিৎসকের পরামর্শে পানি পান করতে হবে।

কিডনি রোগ কি আয়ু হ্রাস করে?
অবশ্যই। একজন সুস্থ মানুষ ৬০ থেকে ৭০ বছর বয়স পর্যন্ত বাঁচলেও কিডনি আক্রান্ত ব্যক্তির আয়ু ১০ থেকে ১৫ বছর কমে যেতে পারে।  

কিডনি বিকল হলে চিকিৎসা বা করণীয় কী?
কারো কিডনি বিকল হয়ে গেলে তিনটি পদ্ধতি বা চিকিৎসা গ্রহণ করতে হয়। এগুলো হলো—হেমোডায়ালিসিস, পেরিটোনিয়াল ডায়ালিসিস ও কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট। তবে নিকটাত্মীয়ের মাধ্যমে কিডনি দান করে ট্রান্সপ্লান্ট করতে পারা হচ্ছে সবচেয়ে সফল চিকিৎসা। পাঁচ-ছয় বছর থেকে ৬৫ বছর বয়সী শেষ ধাপের কিডনি বিকল রোগীরা তাদের নিকটাত্মীয়ের মাধ্যমে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করালে নতুন জীবন ফিরে পেতে পারে। বাংলাদেশে প্রায় ২৫ বছর ধরে সফলভাবে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট হয়ে আসছে।

উচ্চ ঝুঁকিতে থাকলেও কি কিডনি রোগ প্রতিরোধ করা যায়?
উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা রোগীদের কিডনি রোগ প্রতিরোধ করা প্রায় অসম্ভব।

কিডনি রোগ প্রতিরোধে করণীয় কী কী?
কিডনি রোগ প্রতিরোধে সচেতন হতে হবে শিশুকাল থেকেই। ফাস্ট ফুড, কোমল পানীয় বর্জন করতে হবে। শিশুকে প্রতিদিন মাঠে খেলাধুলা করার সুযোগ করে দিতে হবে। পড়াশোনার অতিরিক্ত চাপ কমিয়ে দিতে হবে। ভেজাল খাবার পরিহার করে স্বাভাবিক খাবার, যেমন-ডিম, মাছ, মুরগির মাংস ইত্যাদি খেতে দিতে হবে। শিশুটি যেন মুটিয়ে না যায় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।

এ ছাড়া সবার উচিত মাত্রাতিরিক্ত প্রোটিনজাতীয় খাবার, অতিরিক্ত লবণ ও চিনি, ফাস্ট ফুড, কোমল পানীয়, ধূমপান পরিহার করা। দুশ্চিন্তা বা টেনশন না করে নিয়মিত কায়িক পরিশ্রম করা। বিশেষ করে প্রাপ্তবয়স্ক বা ৪০ বছরের বেশি বয়সী এবং স্থূল বা মোটা লোকের উপসর্গ থাকুক বা না থাকুক, তার রক্তচাপ নিয়মিত পরিমাপ করা, প্রস্রাবের সঙ্গে শ্বেত বা লোহিত কণিকা এবং অ্যালবুমিন নির্গত হচ্ছে কি না তা নিরূপণ করা উচিত। এ ছাড়া নিয়মিত রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা উচিত। ডায়াবেটিস শনাক্ত হলে এবং প্রস্রাবে অ্যালবুমিন ও মাইক্রো-অ্যালবুমিন নির্গত হলে সাবধান হতে হবে। ক্রিয়েটিনিনের পরিমাপ দেখতে হবে। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।