সাত মার্চের মহাকাব্য রচনায় বঙ্গবন্ধুর মনস্তাত্ত্বিক প্রস্তুতি ও অজানা ঘটনা!

সাত মার্চের মহাকাব্য রচনায় বঙ্গবন্ধুর মনস্তাত্ত্বিক প্রস্তুতি ও অজানা ঘটনা!

সোহেল সানি 

মহান একাত্তরের ঐতিহাসিক সাত মার্চের মহাকাব্য রচনায় বঙ্গবন্ধুর মনস্তাত্ত্বিক প্রস্তুতির নেপথ্যে রাজনীতির অন্দরমহলে সংঘটিত অনেক ঘটনাই অপ্রকাশিত রয়ে গেছে। বিশেষ করে ঐতিহাসিক ভাষণদানের আগে-পরে ডাকসু ও ছাত্রলীগের তৎকালীন এবং সাবেক নেতৃবৃন্দসহ আওয়ামী লীগ নেতারা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর বাসভবনে একের পর এক বৈঠক করে কে কী ভুমিকা রেখেছিলাম তার অনেক কিছুই অনানুষ্ঠানিকতার কারণে অজানা থেকে গেছে। এমনকি বঙ্গবন্ধুর ওপর তাঁর পরিবার কতটা প্রভাব রাখছিলেন তাও অপ্রকাশিত রয়ে গেছে। মূলত বঙ্গবন্ধুর জ্বালাময়ী ভাষণই হয়ে উঠেছিল সংবাদমাধ্যমের খোঁড়াক।

ফলে অন্দরমহলে ঘটে যাওয়া বিষয়গুলো চাপা পড়ে থাকে। অথচ রাষ্ট্রীয়ভাবে রচিত কবি হাসান হাফিজুর রহমানের মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রে এসব ঘটনা সন্নিবেশিত হলে মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতার ইতিহাস আরও সমৃদ্ধ হতো। ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম এবং বঙ্গবন্ধুর জামাতা প্রখ্যাত পরামানু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার লেখা গ্রন্থগুলোতে অপ্রকাশিত এসব ঘটনার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত হতে পারে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ থাকা এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি অব্যাহত থাকার কারণে গণমানুষের মধ্যে বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের মধ্যে সন্দেহ, সংশয় ও বিভ্রান্তিই শুধু নয়, সামরিক শাসক জিয়া ও এরশাদ উভয়ই পাকিস্তানী ভাবধারায় রাষ্ট্র পরিচালনা করে প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বাধীনতার মূল্যবোধ বিরোধী মানস-গঠনে বিশিষ্ট ভুমিকা রেখেছেন। এসব করে তারা কার্যত ব্যাহত করেছেন সাংস্কৃতিক মুক্তির সংগ্রামকে।

নোবেলবিজয়ী রাসেল ঠিকই বলেছেন, একটি দেশের স্বাধীনতা সুসংহত হয়না যদি দেশটির সাংস্কৃতিক মুক্তির সংগ্রাম স্তদ্ধ হয়ে যায়। ইতিহাসের সাময়িক গতি মন্থর করা যায় ধামাচাপা দিয়ে রাখা যায় কিন্তু ইতিহাসের প্রকৃতিকে পাল্টে ফেলা যায় না- তার আপন পরিণতিই হচ্ছে সে সত্যকেই কেবল আগলে রাখে। আজকের বাস্তবতা সেই সত্যকেই বহন করছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যে ঐতিহাসিক সাত মার্চের ভাষণকে রাষ্ট্রীয় আর্কাইভে লুকিয়ে রেখে, রেডিও-টিভিতে প্রচারিত হতে দেওয়া হয়নি, সেই ভাষণকেই বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে সুমহান মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জাতি সংঘের ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃত হয়ে। সুপ্রিমকোর্ট কর্তৃক শাসক হিসাবে জিয়া-এরশাদ অবৈধ ঘোষিত হয়েছেন। কোর্ট কর্তৃক বঙ্গবন্ধুই ঘোষিত হয়েছেন "স্বাধীনতার ঘোষক। " জাতির পিতা প্রতিকৃতি প্রদর্শন আইন অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি শোভা পাচ্ছে সরকারী আধা সরকারী সংবিধিবদ্ধ কর্তৃপক্ষীয় প্রতিষ্ঠানসমূহে। যে প্রতিকৃতি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর নামিয়ে ফেলা হয়েছিল। সুপ্রিমকোর্টের ঐতিহাসিক রাযে সংবিধানে পুনঃস্থাপিত হয়েছে চার মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র।

যাহোক এবার ১৯৭১ সালের পহেলা মার্চ থেকে টানা সপ্তাহব্যাপী রাজনীতির অন্দরমহলের সেই ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর সঙ্গে এবার পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি। আর সংশ্লিষ্টদের দিচ্ছি স্মরণ করিয়ে। পাকিস্তানের সামরিকজান্তা প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া এক ভাষণে ঘোষণা করেন যে, ৩ মার্চ প্রাদেশিক পূর্বপাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে।

উল্লেখ্য, ১৯৭০ সালের ৭ এবং ১৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদ নির্বাচন। কিছু আসনের নির্বাচন হয় জানুয়ারিতে বন্যার কারণে। জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ ১৬০টি আসনে জয়লাভ করে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। দুটি আসনের একটিতে জয়ী হন মুসলিম লীগ নেতা নূরল আমিন ও পার্বত্য এলাকায় রাজা ত্রিবিধ রায় (দুজনই স্বাধীনতা বিরোধী)।

সাধারণ নির্বাচনের সঙ্গে প্রাদেশিক নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টিতে জয়লাভ করে। জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি পশ্চিম পাকিস্তানে ১৩৮টি আসনের ৮১টিতে জয়লাভ করে। পিএমএল (কাইয়ুম), পিএমএল (কাউন্সিল), পিএমএল (কনভেনশন), জমিয়তে উলেমা-ই-ইসলাম, জমিয়তে উলেমা-ই-পাকিস্তান এবং জামায়াতে ইসলামী একত্রে ৩৭টি আসন পায়।

প্রাদেশিক নির্বাচনের ফলাফল: প্রাদেশিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনের ২৮৮টি জিতে নেয়। পশ্চিম পাকিস্তানের অপর চারটি প্রাদেশিক পরিষদে তারা কোনো আসন পায়নি। পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশের প্রাদেশিক পরিষদে পাকিস্তান পিপলস পার্টি ভালো করে, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে কোনো আসনে জয় পায়নি। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং বেলুচিস্তানে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ওয়ালি) এবং পিএমএল (কাইয়ুম) ভালো করে।

পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ্যতালাভ করায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবান করতে হয়। জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা পাকিস্তানের ভবিতব্য প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ পরিষদের অন্যান্য দলগুলোর নেতারা প্রেসিডেন্টের অধিবেশন আহবানকে স্বাগত জানান। কিন্তু জাতীয় পরিষদের ভবিতব্য বিরোধী দলের নেতা পাকিস্তান পিপলস পার্টির সভাপতি জুলফিকাট আলী ভুট্টো বেঁকে বসেন। তিনি পেশোয়ারে সংবাদসম্মেলন ডেকে বলেন, "মুজিব ৬ দফার পক্ষে আপোষ না করলে তা়ঁর দল পিপলস পার্টি জাতীয় অধিবেশনে যোগদান করবে না। " তিনি ১৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় পরিষদে পশ্চিম পাকিস্তানী দলগুলোর সদস্যদের প্রতি হুমকি প্রদর্শন করে বলেন, "ঢাকা পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্যদের জন্য কসাইখানা হবে। " তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের প্রতি আহ্বান জানান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করতে।

শুরু হয় ষড়যন্ত্র। জুলফিকার আলী ভুট্টো পাখি শিকারের নামে চলে যান সিন্ধু প্রদেশের লারকানায়। যা ছিল ডাহামিথ্যে কথা। আসলে ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে গোপনে মিলিত হতে সম্ভাব্য করণীয় নির্ধারণ করতে সেখানে যান। এ খবর প্রকাশ হয়ে যায় সংবাদপত্রে। প্রেসিডেন্ট পহেলা মার্চ অপরাহ্নে রেডিওতে জাতির উদ্দেশে দেয়া এক ভাষণে ৩ মার্চের অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিল ঘোষণা করেন।

যে মুহূর্তে ঢাকার হোটেল পূর্বাণীতে শাসনতন্ত্রের খসড়া তৈরি করতে বঙ্গবন্ধু সহকর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করছিলেন। সকাল নয়টা থেকে শুরু হওয়া নীতিনির্ধারণী বৈঠকে ছিলেন, পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক এএইচএম কামরুজ্জামান, প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ, অন্যতম নেতা ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও ড. কামাল হোসেন।

দুপুর বারোটার দিকে প্রেসিডেন্টের আকষ্মিক ভাষণে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিলের খবর শুনা মাত্র হাজার হাজার ছাত্রজনতা রাস্তায় নেমে আসে। বঙ্গবন্ধু বৈঠক থেকে বেরিয়ে আসেন। তিনি হোটেল পূর্বাণীর সামনে বিক্ষুব্ধ ছাত্রজনতার সম্মুখে হাজির হয়ে বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের অধিবেশন বাতিল করার ঘোষণা গভীর ষড়যন্ত্রের ফলশ্রুতি। বাঙালিরা এই ষড়যন্ত্রকে জীবন দিয়ে হলেও প্রতিহত করবে। " তিনি ২ মার্চ ঢাকায়, ৩ মার্চ দেশব্যাপী হরতাল এবং ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসভা করে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করবেন বলে জানান এবং ছাত্র-জনতাকে আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান। ৩ মার্চ পূর্বপাকিস্তানের গভর্নর এডমিরাল আহসানকে পদচ্যুত করে তার স্থলে জেনারেল ইয়াকুব খানকে ভারপ্রাপ্ত গভর্নরের দায়িত্ব অর্পণ করেন। আবার পরের দিন ৪ মার্চ তাকে বাদ দিয়ে গর্ভনর পদে নিয়োগ দেন "কসাই" খ্যাত জেনারেল টিক্কা খানকে। ৫ মার্চ টিক্কা খান ঢাকায় পৌঁছান। ৬ মার্চ শপথ নেয়ার কথা থাকলেও জনরোষের মুখে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বি এ সিদ্দিক তাকে শপথ পড়াতে অস্বীকৃতি জানান। ৩ মার্চ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত দেশব্যাপী স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালিত হয়।

৬ মার্চ বিকেল পাঁচটায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন এমন বার্তা ঘোষণা করা হয় পাকিস্তান রেডিও থেকে- আগের দিন ৫ মার্চ। স্বভাবতই গোটা দেশবাসীর দৃষ্টি তখন ভাষণের দিকে।

বঙ্গবন্ধু ওদিন তাঁর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বিরাজমান পরিস্থিতি নিয়ে কয়েকদফা বৈঠক করেন। ৫ মার্চ ঢাকাস্থ পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক প্রশাসক জেনারেল ইয়াকুবের ফোন আসে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে। বঙ্গবন্ধুর জামাতা ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া ফোন রিসিভ করলে ওপাশ থেকে বলা হয়, "শেখ সাহেবের সঙ্গে মাননীয় প্রেসিডেন্ট কথা বলবেন। " এ কথা শুনে বঙ্গবন্ধু গিয়ে রিসিভার কানে তুলে বলতে থাকেন "কিছু শুনতে পাচ্ছি না, কিছু শুনতে পাচ্ছি না। " পরক্ষণে বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্টের কণ্ঠ শুনে পূর্ব পাকিস্তানে পরিস্থিতি অবহিতপূর্বক তদন্ত কমিশন গঠন এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠানের কথা বলেন। ৬ মার্চ বিকেলে প্রেসিডেন্টের ভাষণ শোনার জন্য বঙ্গবন্ধু একটি ট্রানজিস্টার নিয়ে তাঁর শয়নকক্ষে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দেন। তার আগে জ্যেষ্ঠকন্যা শেখ হাসিনাকে বলেন ভাষণটি টেপ করে রাখার জন্য।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ভাষণে বলেন, "আওয়ামী লীগের একগুয়েমির জন্য ৩ মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিল করতে বাধ্য হয়েছি। ১০ মার্চ ঢাকায় গোলটেবিল সম্মেলন ডেকে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের প্রশ্নে সকল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। " ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের কথাও ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধু ভাষণ শেষ হওয়ার পর দরজা খুলে ব্যক্তিগত সহকারী মোহাম্মদ হানিফকে শীর্ষ ছয় নেতাকে ডেকে পাঠানোর নির্দেশ দেন। নেতারা আসলে ঘণ্টাব্যাপী আলোচনাশেষে কতিপয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এর পরপরই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বৈঠকে বসেন পরবর্তীতে স্বাধীনতার নিউক্লিয়াস বলে পরিচিত শেখ ফজলুল হক মনি ও সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে। এরপর বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ভাষণের জবাব দিতে ইংরেজিতে একটি ইশতেহার তৈরি করতে বলেন তাজউদ্দীন আহমদ ও ড. কামাল হোসেনকে। ইংরেজিতে লেখা ও ইশতেহারে বলা হয় যে, "শহীদের রক্তে রঞ্জিত রাস্তার রক্ত এখনো শুকোয়নি। পবিত্র রক্তের ওপর পা রেখে ১০ মার্চ গোলটেবিল বৈঠকে আওয়ামী লীগ যোগদান করতে পারে না। "

মুখোমুখি এবার সেই ৭ মার্চের। সকালে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে লোকে লোকারণ্য। বঙ্গবন্ধু প্রথমেই সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, এএইচএম কামরুজ্জামান, মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও ড. কামালের সঙ্গে লাইব্রেরিরুমে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। এরপর বৈঠকে মিলিত হন যুব-ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে। যারা পরবর্তীতে মুজিব বাহিনী অধিনায়ক হওয়া চার নেতা শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন খলিফা খ্যাত নেতা- স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নূরে আলম সিদ্দিকী, আ স ম আব্দুর রব, শাজাহান সিরাজ ও আব্দুল কুদ্দুস মাখন। দুপুরের সেই বৈঠকে তারা বঙ্গবন্ধুকে পূর্বপাকিস্তানকে স্বাধীন করার পক্ষে মত দেন। ভাষণে স্বাধীনতার ঘোষণা দিতেও দাবি জানান। বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে যাওয়ার আগেই যেন চার দফা ঘোষণাপত্রটি জনসভাস্থলে বিতরণ করা হয় - সেই মর্মে নির্দেশ দেন ছাত্র ও যুব নেতাদের। দফাগুলো ছিল, এক- সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়া, দুই- হত্যার তদন্ত করতে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন কমিশন গঠন, তিন- সামরিক আইন প্রত্যাহার ও চার-নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতার কাছে রাষ্ট্রের ক্ষমতা হস্তান্তর করা।

বঙ্গবন্ধু বাড়ির সামনে জড়ো হওয়া সমবেত সকলের উদ্দেশে শুধু বলেন, "আমরা ঐকমত্যে পৌঁছেছি। ছাত্রজনতার দাবি অনুযায়ী চার দফা দাবির প্রতি সমর্থনের কথাও বলেন। এরপর আহারের জন্য নেতারা নিজ নিজ বাড়িতে চলে যান। বঙ্গবন্ধু প্রিয়তম সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কাছে জানতে চান - সবাই তো বলছে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দিতে, তোমার মতামত কি? প্রতিত্তোরে বেগম মুজিব বলেন," মন থেকে যেটা আসবেই সেটাই বলা হোক। " সত্যিই বঙ্গবন্ধু তাই করেছিলেন। অনেকে অনেকে চিরকুট দিয়েছিলেন। লিখিত ভাষণের কথাও বলেছিলেন কেউ কেউ। কিন্তু বঙ্গবন্ধু মন থেকে যা এসেছিল তাই বলে এমন এক ইতিহাস সৃষ্টি করলেন যে, পাকিস্তানীদের সম্ভাব্য বিমান হামলার হাত থেকে জনগণমহাসমাবেশে যোগ দেয়া জনগণকেও রক্ষা করলেন আবার জনগণকে যুদ্ধের নির্দেশনাও দিলেন। প্রকৃতঅর্থে একেই বলে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির দুরদর্শিসম্পন্ন অবিসংবাদিত নেতা।

এরপর বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দান অভিমুখে একটা ট্রাকে করে রওয়ানা হন। ওই ট্রাকে ছিলেন গাজী গোলাম মোস্তফা, শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, আব্দুর রউফ, খালেদ মোহাম্মদ আলী, নূরে আলম সিদ্দিকী ও আব্দুল কুদ্দুস মাখন প্রমুখ।

পেছনের আরেকটি ট্রাকে ছিলেন, আসম আব্দুর রব,শাজাহান সিরাজ, মোস্তফা মোহসীন মন্টু, কামরুল আলম খান খসরু ও মহিউদ্দিন আহমেদ। বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে পৌঁছার আগেই সেখানে হাজির হয়ে যান বঙ্গবন্ধুর জামাতা এম এ ওয়াজেদ মিয়া, শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা, শেখ জেলি (শেখ হাসিনার খালাতো বোন) এবং এটিএম সৈয়দ হোসেনের বড় মেয়ে শেলি। সেদিনের রেসকোর্স ময়দানে বিশালাকৃতির নৌকাশোভিত সভামঞ্চটি স্থাপন করা হয়েছিল বর্তমান শিশুপার্কের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সম্প্রচারিত হবে রেডিওতে বারবার এমন ঘোষণা হচ্ছিল। শেখ হাসিনা যে কারণে একটি রেডিও সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুরুর কয়েক মিনিটের মধ্যে রেডিও নিস্তব্ধ হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর সেই জ্বালাময়ী ভাষণে "এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম" উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লাখো লাখো জনতার জনসমুদ্র থেকে জয়বাংলা স্লোগান ভেসে আসে। বঙ্গবন্ধুও প্রত্যুত্তরে জয়বাংলা বললে তার ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়ে আকাশ বাতাসে অনুরণের সৃষ্টি করে।

বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দান থেকে বাড়িতে ফেরেন। রাত আটটার দিকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন জনপ্রিয় বাংলা সংবাদ পাঠক ইকবাল বাহার চৌধুরীর নেতৃত্বে পাকিস্তান রেডিও ঢাকাস্থ কেন্দ্রের কর্মকর্তা ও কর্মচারিরা। তারা জানান, সেনাবাহিনীর হাইকমান্ডের নির্দেশে তারা ভাষণ সম্প্রচার করতে পারেননি। এখন ভাষণ সম্প্রচারের অনুমতি না দেয়া পর্যন্ত অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট করার কথা বলেন তারা। ফলে সকাল অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। ৮ মার্চ সকাল আটটায় হঠাৎ পাকিস্তান রেডিও ঘোষণা করে যে, ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ নয়টায় প্রচার করা হবে।

বঙ্গবন্ধু রাতে সহধর্মিণী ফজিলাতুন নেছা মুজিব, ছেলে-মেয়ে শেখ হাসিনা, শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রেহানা, শেখ রাসেলের উপস্থিতিতে বলেন, "আমার যা বলার তা প্রকাশ্যে বলে ফেলেছি-সরকার এখন আমাকে যেকোনো মুহূর্তে হয় গ্রেফতার নয়তো হত্যা করবে। আজ থেকে প্রতিদিন আমার সঙ্গে খাবে। ২৪ মার্চ পর্যন্ত সবাই এক সঙ্গে খেয়েছেন। কিন্তু ২৫ মার্চ ব্যতিক্রম ঘটে। বঙ্গবন্ধু রাত ১১টা পর্যন্ত বাড়ির নিচতলায় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, কৃষক লীগ, শ্রমিক লীগ নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত সময় পার করেন। ৭ মার্চের ভাষণের পর থেকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। কার্যত বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের শাসনভার গ্রহণ করেন। ৯ মার্চ পল্টন ময়দানে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বলেন, "প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে বলি, অনেক হয়েছে আর নয়। তিক্ততা বাড়াইয়া আর লাভ নাই। লা কুম দ্বিনুকুম ওয়ালইয়া দ্বিন (তোমার ধর্ম তোমার, আমার ধর্ম আমার)-এর নিয়মে পূর্ববাংলার স্বাধীনতা স্বীকার করিয়া লও। মুজিবের নির্দেশমত আগামী ২৫ তারিখের মধ্যে কোন কিছু করা না হইলে আমি শেখ মুজিবুর রহমানের সহিত হাত মিলাইয়া ১৯৫২ সালের ন্যায় তুমুল আন্দোলন শুরু করিব। খামাকা কেহ মুজিবকে অবিশ্বাস করিবেন না, মুজিবকে আমি ভালো করিয়া চিনি। "

১৫ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকায় আসেন। ১৬ ও ১৭ মার্চ তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হাউসে (বর্তমান সুগন্ধা) ইয়াহিয়া-মুজিব বৈঠক হলো। ১৯ মার্চ জয়দেবপুরে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা ছাত্রজনতার ওপর গুলিবর্ষণ করে। কারফিউ জারি করা হয়। ২০ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ও ইয়াহিয়ার পরামর্শদাতাদের মধ্যে পৃথক বৈঠক হয়। ইতোমধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের ৩৫ জন জাতীয় পরিষদ সদস্য অধিবেশনে যোগদান করতে ঢাকায় এসে পৌঁছান। বঙ্গবন্ধু বাড়ি আক্রমণের আশঙ্কা করে ড. ওয়াজেদকে বাসা নিতে বলেন। সাত মসজিদ রোডের ওপর ধানমন্ডির (পুরাতন) ১৫ নম্বর রোডস্থ (নতুন ৮/এ-১৭৭ নম্বর) নিচতলাটি মাসিক ৯০০ টাকায় ভাড়া নেয়া হয়। ২১ মার্চ জুলফিকার আলি ভুট্টো ঢাকায় এসে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ওঠেন। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে তিনি গোপন সলাপরামর্শ করেন। ২২ মার্চ বঙ্গবন্ধু বলেন,"লক্ষ্য অর্জনের জন্য যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। এদিন মুজিব-ভুট্টো বৈঠক হয়। একই দিন ইয়াহিয়া-মুজিব-ভুট্টো বৈঠক হলে আবারও সংকট আরও প্রকট হয়ে ওঠে। বলা হয় ২৫ মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বিস্তৃত আলোচনার জন্য বাতিল করা হলো। বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ থেকে অবরোধ আন্দোলন শুরু করার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।

২৩ মার্চ পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের জনসভায় "আমার সোনার বাংলা" গানটিকে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে বাজিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী, ডাকসু ভিপি আ স ম আব্দুর রব,ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ ও ডাকসু সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কুদ্দুস মাখন ছিলেন ছাত্রলীগের প্রধান নেতা। গাঢ় সবুজ কাপড়ের মাঝখানে লাল গোলাকার বলয়ের ভেতর সোনালী রং-এ অঙ্কিত বাংলাদেশের মানচিত্রসহ তৈরি করা পতাকাটি বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দেন তাঁর বাড়িতে এসে। সামরিক কায়দায় ছাত্রলীগ নেতা হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বে একটি বিশেষ দল বঙ্গবন্ধুকে অভিবাদন জানায়। ওদিন সচিবালয়, হাইকোর্ট ভবনসহ সর্বত্র বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। উল্লেখ্য, এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবেশে ছাত্রলীগের পক্ষে ২ মার্চ আ স ম আব্দুর রব প্রথম পতাকাটি উত্তোলন করেন এবং ৩ মার্চ ছাত্রলীগের পক্ষে শাজাহান সিরাজ স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা করেন।

২৫ মার্চ সকালে বঙ্গবন্ধু নিজ বাড়িতে নেতাদের সঙ্গে কাটান। সবার চোখে মুখে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। সবাইকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়ে চলে যেতে বলেন। বিকেল তিনটায় শেখ ফজলুল হক মনি বঙ্গবন্ধুর শয়নকক্ষে ছিলেন। রাত আটটার আবার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও এএইচএম কামরুজ্জামান। রাত ১১টার দিকে বঙ্গবন্ধু বাড়ির সিঁড়িরগোড়ায় দাঁড়িয়ে সিরাজুল আলম খান, আ স ম আব্দুর রব ও শাজাহান সিরাজের সঙ্গে কথা বলেন। লন্ডন আওয়ামী লীগ নেতা জাকারিয়া চৌধুরীর ভাই পরিচয় দিয়ে ঝন্টু নামে এক ব্যক্তি দেহরক্ষী মহিউদ্দিন আহমেদের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর মুখোমুখি হন।

সে জানায়, পাকিস্তান সেনাবাহিনী হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছে। আপনাকে হত্যা করার জন্য তারা আসছে। বঙ্গবন্ধু এসময় শেখ হাসিনাকে বলেন, তোমরা চলে যাও। আমার অন্যত্র চলে যাওয়ার উপায় নেই। তারা মারতে চাইলে আমাকে এ বাড়িতেই মরতে হবে। কামাল চলে গেছে। জামাল ওর মাকে ছাড়া থাকতে পারবে না। মুখে একথা শুনে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেন।

একদিকে চললো গণহত্যার তাণ্ডবলীলা, আরেকদিকে বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতারের ঘটনা। গ্রেফতারের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা করে দিয়ে গেলেন সেই ঐতিহাসিক বার্তা আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আর সেজন্য সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের আলোকে ২৬ মার্চ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ এর স্বাধীনতা দিবস এবং নয় মাসের যুদ্ধে পরাস্ত পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের দিন-১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয় দিবস।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও ইতিহাস বিশেষজ্ঞ

এই রকম আরও টপিক