ঋণ আদায় বিষয়ে কিছু করণীয়

ঋণ আদায় বিষয়ে কিছু করণীয়

‘দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো’ বা ‘বাকি চাহিয়া লজ্জা দেবেন না’ এই ধরনের প্রবাদ ব্যাংকিং ব্যবসার জন্য প্রযোজ্য নয়। আমানত নেওয়া এবং লোন দেওয়াই ব্যাংকের প্রধান কাজ। ব্যাংকিংয়ে আয়ের প্রধান উৎস হলো ঋণের বিপরীতে সুদ আয়, যেখান থেকে আমানতকারীদেরকে ডিপোজিটের বিপরীতে সুদ দিতে হয়, পরিচালন ব্যয় মেটাতে হয়, সব ব্যয় মিটিয়ে মুনাফা করতে হয়। মুনাফা থেকে শেয়ারহোল্ডারদের ডিভিডেন্ড দিতে হয় এবং সরকারকে কর্পোরেট ট্যাক্স দিতে হয়।

অতএব গোয়াল খালি রাখার কোনো উপায় নেই, বরং দুষ্ট গরু/ খারাপ লোনকে বশে রাখতে হবে।

ঋণ দেওয়ার পরবর্তী কাজ ঋণ আদায়-এটা যতখানি সত্য, এটা খুব সহজ কাজ নয় সেটাও সত্য। কারণ ‘বন্দুক থেকে গুলি ছোড়া হয়েছে, সেই গুলি আবার ফেরত আনতে হবে’! টাকা আদায় করতে গেলে কি কি হয় তার কিছু নমুনা দেওয়া যাক-

ঘটনা ১ : দুই ব্যাংক কর্মকর্তা গেলেন খেলাপি ঋণ গ্রহীতার বাসায় টাকা আদায়ের জন্য। ঋণ গ্রহীতা আশেপাশের লোক জড়ো করে চাদাঁবাজির ধোয়া তুলে গণপিটুনির ব্যবস্থা করলেন।

ঘটনা ২ : বড় অংকের ঋণখেলাপি একজনের কাছে যাওয়া হলো ব্যাংক থেকে ঋণ পরিশোধের তাগাদা দেওয়ার জন্য।  পরিবার থেকে জানানো হলো ‘উনি অসুস্থ, ডিমেনশিয়া সন্দেহ করা হচ্ছে’। ব্যাংকারের গা শিওড়ে উঠল, তার মানে কোনো ব্যাংক থেকে কত টাকা নিয়েছেন তা কিছুই মনে করতে পারবেন না!

ঘটনা ৩ : খেলাপি ঋণ গ্রাহকের কাছে সাড়া না পেয়ে ব্যাংক থেকে প্রথম জামিনদার ঋণ গ্রহীতার স্ত্রীকে ফোন দেওয়া হলো। স্ত্রী ‘আজ আমার মন ভালো নাই’ টাইপ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে’! ব্যাংকার চিন্তা করছেন, লোনের টাকা না দিয়ে কেনো তারা সংসার ভাঙতে গেলো?

ঋণ আদায় করতে গিয়ে এইরকম কঠিন সব অভিজ্ঞতা অর্জন করেন ব্যাংক কর্মকর্তারা, ‘সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম’-কঠিন কে ভালোবেসে নীলকন্ঠী হয়েছেন আজ ব্যাংকাররা।  বর্তমানে ব্যাংক অর্থ মামলা ২ লাখ ৭৭ হাজার।  যাদের সবাই ইচ্ছাকৃত খেলাপি নয়।  অনেক সময় তারা পরিস্থিতির শিকারও হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক  ড. আর এম দেবনাথ যথার্থই বলেছেন, ‘যেই অংকে লোন শ্রেণিবিন্যাস/ প্রভিশনিং হয়, সেই অংকে ব্যবসা চলে না’।  

অর্থমন্ত্রী এই ব্যাপারটাকে মাথায় রেখেই ২০১৮ সালে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা পাল্টে দিয়েছেন কিনা অনেকেই নিশ্চিত নন।  তবে পাঠার গায়ে রঙ করে হরিণ করে দেওয়াতে ব্যাংকগুলোর ঝলসে যাওয়া শরীরে প্রশান্তি এসেছে, সুখ পেয়েছেন বড় অঙ্কের ঋণ খেলাপিরাও। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দেওয়ার প্রাক্কালে খেলাপি ঋণ নিয়ে অনেক টেবিল টক হয়েছে, অনেক তথ্য সামনে এসেছে। ২০১৯ সালে ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ১ বছর গ্রেস পিরিয়ড সহ ১০ বছর মেয়াদে খেলাপি ঋণ রেগুলার করার সুযোগ দেওয়া হয়, এর ফলে ঋণ গ্রাহকরা ঋণ পরিশোধ করতে ভুলে যাচ্ছেন, তাদের আড়মোড়া ভাঙাতে ব্যাংকগুলোকে বেশি পরিশ্রম করতে হচ্ছে।

ঋণ আদায়ে ব্যাংক চেকের মামলা, অর্থ ঋণ মামলা, অর্থ ঋণ জারি মামলা ইত্যাদি করতে পারেন। তবে প্রচলিত পদ্ধতি বা মামলা মোকাদ্দমার বাইরে কিছু করণীয় তুলে ধরা হলো-

১। ঝুঁকিপূর্ণ এবং লার্জ লোনগুলোকে ইন্স্যুরেন্স কাভারেজের আওতায় আনা যেন ব্যবসার যেকোনো দৈব পরিস্থিতিতে কিংবা মালিকের মারা যাওয়ার কারণে লোন পরিশোধ নিয়ে পরিবার বা ব্যাংক বিপাকে না পড়ে। ইনস্যুরেন্স কাভারেজ নিতে উৎসাহিত করতে ঋণের সুদ কম নেওয়া যেতে পারে, ঋণের ঝুঁকি কমে আসায় রিস্ক প্রিমিয়াম কম আসে তাই সুদের হারও কমানো যায়।

২। ইতোমধ্যে মিউটেশন, খাজনা ইত্যাদি অনলাইন হয়ে গেছে, এটা সরকারের অনেক বড় সাফল্য। এক্ষেত্রে ‘বন্ধকী ব্যাংকের তথ্য’ সন্নিবেশিত করা গেলে সহজেই সম্পত্তি কেনা-বেচা বা হস্তান্তরে আগ্রহী ক্রেতা বা বন্ধক নেওয়ার আগে ব্যাংক জানতে পারবেন যে এই সম্পত্তি কেনা/বন্ধক নেওয়া যাবে কিনা। আবার খেলাপি ঋণের তথ্য ভূমি অফিস, রেজিস্ট্রি অফিস বা এসি ল্যান্ড অফিস গ্রহণ করলে সরকারের স্বদিচ্ছায় খেলাপি ঋণগ্রহীতাকে আটকে দেওয়া যাবে এবং খেলাপি ঋণ রেগুলার করতে বাধ্য করা যাবে।  যেমনটা করে জমি কেনা-বেচায় সরকার প্রথমে টিন থাকা এবং এখন রিটার্ন জমা বাধ্যতামূলক করেছেন।

৩। খেলাপি ঋণের তথ্য জরুরি সেবা প্রতিষ্ঠান যেমন- ওয়াসা, ডেসা, ডেসকো, তিতাস ইত্যাদিতে থাকলে সরকার খেলাপি গ্রাহককে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি ইত্যাদির মতো জরুরি সেবা পেতে লোন রেগুলার করার বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে পারেন।

৪। একইভাবে খেলাপি ঋণের তথ্য ইমিগ্রেশনে থাকলে এবং ঋণগ্রহীতার জন্য বিদেশ ভ্রমণে ব্যাংক ক্লিয়ারেন্স নেওয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করলে ঋণ আদায় অটোমেটেড প্রক্রিয়ায় সম্ভব।

৫। ভালো গ্রহীতাদের জন্য সুদ রিবেট সুবিধা আরো বিস্তৃতভাবে চালু করে উৎসাহ দেওয়া যেতে পারে।

৬। ইতোমধ্যে অনেক নেতিবাচকতার মধ্যেই ভোক্তা ঋণের সুদের হার বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। লোনের মেয়াদগুলো বাড়ানো না হলে রি-পেমেন্ট চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়বে। খেলাপি ঋণ বাড়ার আশঙ্কা প্রবল থাকবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের আশু উদ্যোগ প্রয়োজন হবে।

৭। ব্যাংকগুলোতে প্রজেক্ট কস্ট এসেস করার জন্য বা কাজের অগ্রগতি নিরূপণের জন্য সিভিল ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ দেওয়া জরুরি। ওভার অ্যাসেসমেন্টের কারণে ফান্ড ডাইভার্ট হওয়ার সুযোগ থাকে, যা আদায় অসম্ভব হয়ে পড়বে পরে। পাশাপাশি জমির মূল্যায়নের জন্য ব্যাংকের তালিকাভূক্ত সার্ভেয়ারদের আরও দায়িত্বশীলতা এবং জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে হবে।

৮। লোন বিতরণের পূর্বে ঋণ গ্রহীতা/গ্রহীতাদের পাশাপাশি তাদের পরিবারের সবারই তথ্য রাখতে হবে, যেমন স্পাউসের কন্টাক্ট নাম্বার, ইমেইল, চাকরির তথ্য, সন্তানের স্কুলের পূর্ণাঙ্গ তথ্য, নিকটাত্মীয়দের তথ্য, স্থায়ীভাবে বসবাসকারীদের তথ্য ইত্যাদি রাখতে হবে। খেলাপি ঋণ গ্রহীতাদের অনেক সময়ই তার ঘোষিত ঠিকানায় পাওয়া যায় না, ঋণ আদায়ে এটা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ।

৯।  লোন দেওয়ার ক্ষেত্রে এসএমই গ্রাহকদেরকে বিশেষভাবে পরিচর্যা করতে হবে, কারণ উনারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অশিক্ষিত হয়। নিজেদের ব্যবসার হিসাব রাখতে অক্ষম। সারাদেশে অঞ্চল ভিত্তিক ক্যম্পেইন করে সেরা ব্যবসায়িক আইডিয়াগুলোতে স্টার্ট আপ ফাইন্যান্স করা যেতে পারে। ব্যাংকগুলো নিজেরা এসব উদ্যেক্তাদেরকে ব্যাংকিং ও ফাইন্যান্স, বিজনেস করস্পোন্ডেন্স, বিপণন কৌশল ইত্যাদির উপর ট্রেনিং দিয়ে তাদের সক্ষমতা বাড়াতে পারেন। ব্যবসা ভালো করলে এবং মনিটরিংয়ে রাখলে ক্ষুদ্র গ্রাহকরা বড় গ্রাহক হলেও ব্যাংকের প্রতি অনুগত থাকবেন, কোনোদিন খেলাপি হবেন না।

১০। গ্রাহকরা ইতোমধ্যেই জেনে গেছেন ব্যাংকারদের বিজনেস ও রিকভারি টার্গেট থাকে। তাই অনেক খেলাপি ঋণ গ্রহীতারা অপেক্ষা করেন বছর শেষে ব্যাংক ক্লোজিং এর সময় কীভাবে সুদ মওকুফ আদায় করা যায়। লোন অনুমোদনের সময়ও অনেক সময় সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তাদেরকে ব্যংকিং নীতিমালার সঙ্গে আপোষ করার কু-ইঙ্গিত দেন এই ধরনের গ্রাহকরা। ব্যাংক সেন্ট্রালাইজেশন প্রক্রিয়া এক্ষেত্রে কিছুটা স্বস্তি দিলেও অনুমোদন প্রক্রিয়াকে বিভিন্ন সূচক নির্ধারণপূর্বক স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে করা গেলে ব্যাংকে এক ধরনের নৈতিক পরিবেশ তৈরি হবে, গ্রাহকরা নিজেরাও ব্যাংকিং শৃঙ্খলার মধ্যেই এপ্রোচ করবেন।

১১। কোনো ঋণ একদিনেই খারাপ হয় না, তাই কনকারেন্ট অডিট ব্যবস্থাকে আরও জোড়ালো করতে হবে। সাপ্তাহিক/পাক্ষিক/বা মাসিক ভিত্তিক করা যেতে পারে এবং হেড অফিসে রিপোর্ট করতে হবে। একদল দক্ষ, নম্র, ব্যাংকিং আইনের প্রতি অনুগত ব্যংকারদের মাধ্যমে লোন ডকুমেন্টেশন, লোনের জন্য আবশ্যিক কাগজ সংগ্রহ, স্টক ভেরিফিকেশন, সেলস মনিটরিং, ভাউচারিং ইত্যাদি নিরীক্ষা করবেন।

১২। অর্থ মামলা নিষ্পত্তিতে এবং দীর্ঘসূত্রতা কমাতে কোর্টের সংখ্যা বাড়ানো প্রয়োজন এবং পাশাপাশি মামলা নিষ্পত্তির সময়সীমা বেধে দেওয়া দরকার।

১৩। লিজহোল্ড সম্পত্তি বন্ধক রেখে লোন পেতে ঋণ গ্রাহককে বন্ধক অনুমতি জোগাড় করতে হয়। এই ক্ষেত্রে অথরিটি যেমন- রাজউক, গণপূর্ত, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ ইত্যাদি যতটা দ্রুত বন্ধক অনুমতি দেন, অজানা কারণে বন্ধকী সম্পত্তি বিক্রিতে ততটি ধীর গতি লক্ষ্য করা যায়, বছরের পর বছর পার হলেও ফাইল নড়ে না, এবং এই ধরনের সম্পত্তি বিক্রিতে অথরিটি ক্লিয়ারেন্স পেতে লাখ লাখ টাকার ডিমান্ড থাকে বলে জানা যায়। সম্প্রতি তুমুল জনপ্রিয় রহস্যময় থ্রিলার ওয়েব সিরিজ ‘কারাগার’ এ দেখা যায় ছবির মূল রহস্য ছিলো একটি সুড়ঙ্গ, এই ‘সুড়ঙ্গ’ দিয়েই পিকে হালদার এসেছিলেন, ১০,০০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে নিরাপদে চলে গেছেন। এই সুড়ঙ্গ দিয়ে এর আগে আরও অনেকেই এসেছিলেন, কয়েকজন আটকা পড়েছেন, বাকীরা চলে গেছেন। সরকারের ঐকান্তিক ইচ্ছাতেই এই সুড়ঙ্গ বন্ধ হবে, ব্যাংকিং এ শৃঙ্খলা আসবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ১৮/০৭/২০২২ তারিখের বিআরপিডি সার্কুলার ১৬ এর মাধ্যমে ঋণ পুনঃতফসিল ও পুনঃগঠন সংক্রান্ত মাস্টার সার্কুলার এর মাধ্যমে ‘কোন গাছের ফল খাওয়া যাবে আর কি খাওয়া যাবে না’ তার নির্দেশনাসহ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বোর্ডের উপর পুরো ক্ষমতা দিয়ে ভারমুক্ত হয়েছেন। কিন্তু এই মুহূর্তে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে গেলে ভালো হতো। বাবা আপেল হয়তো কেজি ৩০০ টাকাতেই বিক্রি করতেন, কিন্তু ভাত খেতে যাওয়ার সময় বাচ্চা ছেলেকে অতি সতর্কতায় ধমক দিয়ে কেজি ৩২০ এর কমে বিক্রি না করার কথা বলে গেছেন। এখন এই বাচ্চা কি গ্রাহককে বাবার জাজমেন্ট বা উদারতা দেখাতে পারবে কিনা তা বুঝতে আরও সময়ের প্রয়োজন হবে।

লেখক : ভোক্তা ও ভোক্তা ঋণবিষয়ক গবেষক, mohi.ahmed2008@gmail.com

 (মত-ভিন্নমত বিভাগের লেখার আইনগত ও অন্যান্য দায় লেখকের নিজস্ব। এই বিভাগের কোনো লেখা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়। )